
প্রিন্ট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৩৪ এএম

ড. হাসনান আহমেদ
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
কোন নারী মনমতো রুচিশীল স্বামী না চায়! এদেশের অনেকের জানা কৌতুকটি আবার মনে করিয়ে দিই। মেয়েটার জন্ম নিঃস্ব গরিবের ঘরে। তিন বেলা ভাত জোটে না। চেহারা-গঠনশৈলী খারাপ না। বাপ-মা অকালেই মেয়ের অমতে বিয়ে দিয়েছে পান-সিগারেট-তামাকখোর জেট-ব্লাক মার্কা বিদঘুটে চেহারার দাঁত বেরোনো এক লোকের সঙ্গে। দাঁত পরিষ্কারের অভ্যাস কম, মুখে বিশ্রী গন্ধ। তার সঙ্গে চলতে, মেলামেশা করতে মেয়েটার রুচিতে বাধে। তবুও জীবন তো বসে নেই; দম্পতির একটা মাত্র মেয়ে, নাম হাসনা। কষ্টের কয়েকটা বছরের দুনিয়াবি জীবন পাড়ি দেওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মহিলার রাত-দিনের আরাধনা : বেশি বেশি নামাজ-রোজা করে বেহেশতে যাওয়া; সেখানে অনন্তকালের জন্য একটা ভালো স্বামী পাওয়া। বাড়ির পাশের আনাড়ি হুজুর প্রায়ই বেহেশতি পুরুষদের সঙ্গী হিসাবে পাওয়া হুরের গল্প শোনান। এ গল্পে মেয়েটার মন ভরে না। তার মনের জিজ্ঞাসা, ‘আমি বেহেশতে গেলে কেমন সুন্দর স্বামী পাব?’ উত্তরে হুজুর একদিন বললেন, যার যার স্বামী বহাল থাকবে। মেয়েটার সহজসরল মন ও সব আশা-আকাঙ্ক্ষা ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। ভাত মুখে ওঠে না, মনে নিত্য অশান্তি, মনঃকষ্ট, অপ্রকাশিত অনির্বাণ বেদনা নিরন্তর জ্বলছে। দুনিয়ার স্বল্পদিনের জীবন না হয় অতি কষ্টে পাড়ি দিলাম, কিন্তু সেই অনন্ত জীবনের জন্য ‘আবার সেই হাসনার বাপ!’ শয়নে-স্বপনে মনের গহিনে অসহনীয় অস্ফুট-মর্মপীড়া, একই প্রশ্ন, ‘আবার সেই হাসনার বাপ!’
’৭১-এর মুক্তিসেনারা লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামে একটা স্বাধীন দেশ অর্জন করেছিল; আর আধিপত্যবাদী ভারত কুটিলতার মাধ্যমে পেয়েছিল নব্য একটা উপনিবেশ। গতিপথ হারাল স্বাধীনতা। ঔপনিবেশিক সব আয়োজন ভারত তার সেবাদাসদের সঙ্গে নিয়ে কায়েম করেছিল। শেখ মুজিব আয়োজনের সবটুকু নিজ হাতে সফল করতে চেয়েছিলেন। বিধিবাম। এলো ’৭৫-এর পট পরিবর্তন। মানুষ গড়ে, বিধাতা ভাঙে। ফুলে-ফলে ভরা ভারতের ঔপনিবেশিক বাগান ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। কিছু বেপরোয়া মধ্যম-পর্যায়ের মুক্তিবাহিনী সেনা সদস্য মুজিব ও ভারতের সব সুখের আয়োজন ধ্বংস করে দিলেন। সেনানিবাসে কোনো প্রতিবাদ নেই, সুনসান নীরবতা। সাধারণ মানুষ উল্লসিত হলো। শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়া দেশের স্বার্থে বিনষ্ট-বিবর্ণ বাগান গোছাতে এগিয়ে এলেন। দেশে গণতন্ত্রের ‘রথের মেলা’ বসাতে গিয়ে সঙ্গে উপনিবেশবাদ ও আধিপত্যবাদের পালিত জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত একটি ‘উড়ির বীজ’ও (অকর্ষিত জমিতে উড়ে পড়া বীজে উৎপন্ন ধান্য, নীবার বা উড়িধান) বাংলাদেশের মাটিতে আবার বুনে দিলেন। এই বীজে বিলীনপ্রাপ্ত বাকশালের স্থানে জন্ম নিল নব্য আওয়ামী লীগ। ফলস্বরূপ করুণ পরিণতির একটা অংশ অল্প সময়ের মধ্যেই জীবন দিয়ে ভোগ করে যেতে হয়েছিল রাষ্ট্রপতি জিয়াকে। আধিপত্যবাদের প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায় ‘উড়ির বীজের’ শোষণ ও প্রভু তোষণের উদগ্র কর্মকাণ্ডে বাকি অংশ ৪৭ বছর ধরে ভোগাচ্ছে দেশের স্বাধীনতাকে এবং এদেশের সাধারণ মানুষকে। নিয়তির কী পরিহাস সবাই দেখছে। কথায় আছে, ‘দিও না ভালুকের হাতে খন্তা’। মানুষ দেখেছে আধিপত্যবাদী প্রভুকে সঙ্গে নিয়ে সেবাদাসদের জুলুম, মুসলমানবিদ্বেষী অপকর্ম, কোষাগার লুটপাট, লুণ্ঠিত অর্থ বিদেশে পাচার, নির্বিচারে খুন-গুম, আয়নাঘর-অত্যাচার, নিরঙ্কুশ দলবাজি, গণহত্যা, প্রভু তুষ্টি; যা বর্গিদের অত্যাচার ও ধ্বংসলীলাকেও হার মানায়। পরিশেষে লুণ্ঠিত অর্থসম্পদ ও সাঙ্গোপাঙ্গদের সঙ্গে নিয়ে প্রভুর পদতলে নিজেদের নিঃশর্ত সমর্পণ করেছে। শেখ মুজিব কর্তৃক অসমাপ্ত ঔপনিবেশিক আয়োজনের বাকি অংশ সুযোগ্য কন্যার হাতে অনেকটাই সমাপ্ত। সেজন্য উপনিবেশবাদী প্রভু ’২৪-এর অর্ধসমাপ্ত বিপ্লব এবং দাসদাসীহারা স্বাধীন বাংলাদেশ কোনোমতেই মেনে নিতে পারছে না। সেবাদাসদের সঙ্গে নিয়ে উপনিবেশ পুনর্দখল করার নীলনকশা তৈরি করে চলেছে।
আওয়ামী লীগ যে ভারতের হাতের তৈরি সেবাদাস ও গোলাম, এ কথা ও কাজে আর কোনো রাখঢাক, প্রমাণ ও তঞ্চকতা নেই। বাংলাদেশিদের বোধশক্তি জেগে ওঠা উচিত। শুধু আওয়ামী সুবিধাবাদী দোসর ও নব্য মীরজাফররা বাদে এদেশের সব মানুষ দেরিতে হলেও তা বুঝে ফেলেছে। সেই ’৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কখনো মুজিববাদ, কখনো বাকশাল, আবার কখনোবা আওয়ামী লীগ নামে ভারতের সহযোগিতায় মূলত একই সুর ‘ভারতীয় শোষণবাদ’ এদেশে চালু রয়েছে। শেখ হাসিনা এদেশ থেকে পালানোর আগে প্রভুর কাছে সামরিক অভিযানের জন্য সাহায্য চেয়েছিলেন বলে শোনা যায়। ঠিক একই অবস্থা খালেদ মোশাররফের বিফল বিদ্রোহের সময়ও হয়েছিল বলে কথিত আছে। আবার এ উপনিবেশ শাসনে রক্ষীবাহিনীকেও ভারত থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছিল বলে জানা যায়। আমাদের দেশে ভারতের যেসব গোলাম বিভিন্ন পদে বহাল আছেন, কিংবা যেসব রাজনৈতিক দলের নেতারা এখনো ভারতীয় শাসন এদেশে কায়েম চান, তাদের প্রতি আমার কৃপা হয়। তারা মডিফাইড (সংশোধিত) আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করে শহিদ জিয়ার মতো আবারও ভুল করতে চান, তাদের ঘাড়ে ভূত আসর করেছে। এ অপশক্তি আওয়ামী লীগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়। এ প্রচ্ছন্ন আয়োজন সেবাদাসদের অপসৃষ্টি। যার মাশুল এদেশের বর্তমান ও অনাগত ছাত্র-জনতাকে হাড়ে হাড়ে গুনতে হবে। বলুন তো, যে দেশে তারা হত্যা, গুম, লুটপাট, অত্যাচার চালিয়েছে, সেখানে তাদের আবার রাজনীতি করার অধিকার দেওয়া বিশ্বের বিপ্লবের অভিধানে কোথাও কি আছে? এদেশের সাধারণ মানুষ স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে আওয়ামী রঙ্গমঞ্চের ভিলেন-অস্তিত্বের যবনিকাপাত চায়; প্রতিহিংসাপরায়ণ হিন্দত্ববাদী আধিপত্যবাদ থেকে চির-পরিত্রাণ চায়। পল্লিকবি লিখেছিলেন, ‘মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে, আমি তার বুক ভরি, রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ানো ফুল-মালঞ্চ ধরি...।’ এ সবই ভুল, মরীচিকাময়। প্রকৃতির নিয়মে তা বলে না।
সেই ’৭২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করলে পরিষ্কার বোঝা যায়, এটি এদেশের কোনো রাজনৈতিক দল নয়, হিন্দুত্ব-উপনিবেশবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির লেলিয়ে দেওয়া গোপন সেবাদাস, যার মুখোশ ’২৪-এ এসে প্রকাশ্যে উন্মোচিত হয়ে গেছে। কোনো লুটেরা-গণহত্যাকারী গোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক অধিকার থাকতে পারে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। বিপ্লবে পতিত বা পলাতক শক্তি রাজনৈতিক কোনো অধিকার ফিরে পায় বলে আমার জানা নেই। ইতিহাস ঘাঁটলে অসংখ্য উদাহরণ দেখা যায়। তারা এদেশের সম্পদ লুট করে নিয়ে চিরতরে পালিয়েছে। এদেশে এমন কোনো খারাপ কাজ নেই, যা তারা করেনি। দলের নামেই করেছে। তাদের ও তাদের দলের অপরাধের সুষ্ঠু বিচার হওয়া অবশ্যম্ভাবী। আওয়ামী কর্মকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার আমরা দেখতে চাই। এর আগে ভোটে প্রতিযোগিতা করার অধিকার ‘ভূতের মুখে রামনাম’ শোনাবে। অদূরদর্শী কোনো কাজ কোনো সরকারের জন্যই শোভনীয় হবে না। বরং বুমেরাং ও আত্মঘাতী হবে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে, এটাই কামনা। নইলে এতকিছুর পর একটাই হৃদয়বিদারক অনুশোচনা সাধারণ মানুষের মনের অন্তঃস্তলে রয়েই যাবে, ‘আবার সেই হাসনার বাপ’!
অধ্যাপক ড. হাসনান আহমেদ : সাহিত্যিক, গবেষক ও শিক্ষাবিদ
pathorekhahasnan.com