নিয়োগ বানিজ্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেলো না ইবি
মুঈদ রহমান
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৪:১১ পিএম
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: সংগৃহীত
‘সমস্যা কোনো সমস্যা না, সমস্যার সমাধানটাই সমস্যা’- এই আপ্তবাক্যটির সঙ্গে স্কুল জীবন থেকেই পরিচিত। বাক্যটির প্রতি অজান্তে একটা বিশ্বাসও জন্মায়। তাই ছোটবেলা থেকেই কোনো সমস্যায় খুব বেশি বিচলিত হতাম না, ভাবতাম সমাধানটা খুঁজতে হবে।
বলার মতো তেমন কোনো গুরুদায়িত্বে কোনোকালেই ছিলাম না, তাই ঝক্কিটাও খুব একটা টের পাইনি। কিন্তু বিশ্বাস করে এসেছি যে, যারা রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন তারা কোনো সমস্যার সমাধান খোঁজাতেই নিজেদের দৃষ্টি দেন। কোনো সমস্যাই তাদের খুব একটা বিচলিত করে না।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা জন্মলগ্ন থেকেই। আশির দশকের শুরুতে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ অঞ্চলে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হওয়ার কিছুদিন পর এটি ঢাকার গাজীপুরে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। সেখানেই একাডেমিক কার্যক্রম চালু হয়। পরে ১৯৯০ সালে তা আবার কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের পূর্বের স্থানে ফিরিয়ে আনা হয়।
এ পর্যন্ত বারোজন উপাচার্য নিয়োগ পেয়েছেন। একমাত্র প্রথম উপাচার্য ড. এ এন এম মমতাজ উদ্দিন (মেয়াদকাল: ০১/০১/১৯৮১ হতে ২৭/১২/১৯৮৮)-এর সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো না। বাঁকি এগারো জনের সঙ্গে কাজ করেছি এবং করছি।
প্রভাষক হিসেবে আমার যোগদান ১৯৯০’র মার্চে, দ্বিতীয় উপাচার্য ড. মু. সিরাজুল ইসলাম ( মেয়াদকাল ২৮/১২/১৯৮৮ হতে ১৭/০৬/১৯৯১)-এর হাত ধরে।
তখন দেখলাম সমস্যা। কী সমস্যা? সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুরে রাখা হবে না, তাকে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহে চলে যেতে হবে। কিন্তু ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারির একাংশ বেঁকে বসল। তারা চায় বিশ্ববিদ্যালয় গাজীপুরেই থাকবে। অবশেষে সিরাজ স্যার কুষ্টিয়াতে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেন।
স্থানান্তর সমস্যার সমাধান হলো। কিন্তু নতুন সমস্যা দেখা দিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ছাত্রী ছিলো না, কোনো নারী শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারি ছিলো না, কোনো অমুসলিম ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারি ছিলো না।
এগুলোকে সিরাজ স্যার সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক মনে করতেন। সুতরাং সমাধান প্রয়োজন। কিন্তু একটি মহল শক্তভাবে বিরোধীতায় নেমে পড়লেন। আমরা সিরাজ স্যারের সমর্থনে সরাসরি কাজ করেছিলাম। সে সমস্যার অবসান হলো।
ড. এম এ হামিদ (মেয়াদকাল ২০/০৬/১৯৯১ হতে ২১/০৩/১৯৯৫) ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য। উনার সময়ে দেখা দিল আরেক সমস্যা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই।
কুষ্টিয়া শহরেই অস্থায়ীভাবে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম চলতো। পিটিআই ও ম্যাটস ভবনে ক্লাস-পরীক্ষা চলতো, জিমন্যাসিয়াম ছিলো লাইব্রেরী, জেলা ক্রীড়া সংস্থা ছিলো পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দফতর। কিন্তু এ দিয়ে তো দিনের পর দিন চলা যায় না।
শান্তিডাঙ্গা- দুলালপুরে স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে হবে। ১৯৯২ সালের ১ নভেম্বর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া ছেড়ে তার স্থায়ী ঠিকানা শান্তি ডাঙ্গা-দুলালপুরে স্থান করে নেয়। তাহলে ক্যাম্পাস সমস্যার সমাধান হলো।
হলে কী হবে নতুন সমস্যা দেখা দিল। ক্যাম্পাসটি ভৌগলিকভাবে সমান সমান দুভাগে দুটি জেলায় বিভাজিত। অর্ধেক অংশ কুষ্টিয়া জেলায় বাঁকি অর্ধেক ঝিনাইদহ জেলায়। পুলিশ প্রশাসন বিপাকে। হলগুলো এবং অনুষদ ভবন ঝিনাইদহ জেলার অন্তর্গত আর প্রশাসনিক ভবন ও কোয়ার্টারগুলো কুষ্টিয়া জেলায়। সমস্যার সমাধান কী?
বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের কয়েকটা ইউনিয়ন নিয়ে নতুন থানা করা হলো ইবি (ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থানা)। পুলিশ প্রশাসনের সমস্যা গেল। কিন্তু পোস্টাল এড্রেস কী হবে? দুটি জেলা তো আর একটি পোস্টাল কোডে চলতে পারে না। অবশেষে কুষ্টিয়া-৭০০৩ করে সমস্যার সমাধান করা গেল।
এ পর্যন্ত ঠিকঠাক চলছিলো, সমস্যা সামনে এলে তার সমাধান করে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু অষ্টম ভিসি প্রফেসর রফিকুল ইসলাম (মেয়াদকাল ০৩/০৪/২০০৪ হতে ১০/০৭/২০০৬) এমন এক সমস্যা তৈরী করে গেলেন যা আজও আমরা সমাধান করতে পারলাম না। সেটা হলো ‘নিয়োগ-বানিজ্য’।
এর আগে সাত জন ভিসি কাজ করে গেছেন। দলীয় দৃষ্টিতে, আত্মীয়তার সুবাদে শিক্ষক-কর্মকর্তা নিয়োগের কথা কিছু কিছু শোনা গেছে। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে ঢালাওভাবে চাকরি দেয়ার ইতিহাস রচিত হলো প্রফেসর রফিকুল ইসলামের সময়ে।
যদিও নিয়োগ দেয়ার রাতেই তিনি পালিয়ে রাজশাহী চলে গিয়েছিলেন তবে তার রেখে যাওয়া নিয়োগ-বানিজ্যের ভূত এখনো ক্যাম্পাসে তাড়া করে বেড়ায়।
নবম ভিসি প্রফেসর ফয়েজ মো. সিরাজুল হক ( মেয়াদকাল ১০/০৮/২০০৬ হতে ০৮/০৩/২০০৯) বোধ হয় বুঝতে পেরেছিলেন যে, এই ভূত তাড়ানো তার ‘কম্ম’ নয়, তাই তার মেয়াদে কোনো নিয়োগই দেননি।
দশম ভিসি ড. এম আলাউদ্দিন (মেয়াদকাল ০৯/০৩/২০০৯ হতে ২৭/১২/২০১২) ছিলেন আমাদেরই মতাদর্শের। তারপরও বিএনপি, জামায়াতের লোকদের কাছেও তিনি সমাদ্রিত ছিলেন। দলমত নির্বিশেষে আমরা সবাই আশাবাদী ছিলাম যে, আলাউদ্দিন স্যার অন্তত নিয়োগ-বানিজ্যের দায় থেকে আমাদের মুক্ত করবেন।
নাহ্! আর হলো না। একদিকে ইউজিসির দুর্নীতি তদন্ত অন্যদিকে শিক্ষক সমিতির লাগাতার আন্দোলন (প্রায় দুই মাস ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ ছিলো)। সরকার ভিসি পদ থেকে তাকে অব্যাহতি দিলেন।
একাদশ ভিসি ড. আব্দুল হাকিম সরকার (মেয়াদকাল ৩১/১২/২০১২ হতে ৩০/০৬/২০১৬)। ভদ্রলোক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল ওয়েলফেয়ারের অধ্যাপক ছিলেন।
তার দিকে আমার তেমন আগ্রহ ছিলো না। কেননা ততদিনে আমার মন ভেঙ্গে গিয়েছে। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, ভূত তাড়ানো আমি দেখে যেতে পারলাম না। হ্যাঁ, একই ব্যাপার! তার বিরুদ্ধেও তদন্ত হলো এবং সরকার বাহাদুর যথারীতি তাকে অব্যাহতি দিয়ে দিলেন।
ড. হারুন-উর-রশীদ আসকারী দ্বাদশ ভিসি হিসেবে ২১/০৮/২০১৬ তারিখে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আমার খুব কাছের বন্ধু, সৎ আর উদ্যোমী ব্যক্তিত্ব। আমরা ২৭-২৮ বছর ধরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত।
তার ভিসি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করাটা দলমত নির্বিশেষে সবার কাছেই ছিলো স্বস্তির। বেশ কয়েকটা ভালো উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে। আমার চোখে বড় সাফল্য ছিলো- এ বছরের শুরুতে ৪র্থ সমাবর্তন অত্যন্ত সুন্দর ভাবে সম্পন্ন করা।
কাজটা সহজ ছিলো না। দশ হাজারেরও বেশি গ্রাজ্যুয়েট সমাবর্তনে অংশ নেন। সব মিলিয়ে পনের হাজার মানুষের আয়োজন-আপ্যায়ন নিশ্চিত করাটা কষ্টকরই বটে। সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তা শতভাগ সফলতার দাবি রাখে।
মৃতপ্রায় বিশ্ববিদ্যালয় যেন প্রান ফিরে পেলো। এ কৃতিত্ব অবশ্যই উনার প্রাপ্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে অভিন্দন জানিয়ে সেদিন বলেছিলাম যে, চেষ্টা করবেন নিয়োগ থেকে যেন দূরে থাকা যায়।
কিন্তু নিয়োগ থেকে দূরে থাকতে চাইলেই তো থাকা যায় না। বেশ কয়েকটি নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে। সব বিভাগের চেয়ারম্যানই অন্য বিভাগ থেকে ধার করা, খন্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে ক্লাস- পরীক্ষার কাজ চলছে।
এভাবে তো বেশি দিন চলতে পারে না, তাই নিয়োগ দেয়াটাই যুক্তিযুক্ত। ভয় ততটা করিনি, কেননা বর্তমান ভিসি আমার ভীষণ আস্থার মানুষ।
এবছরের ফেব্রুয়ারী থেকে দুই দফায় নিয়োগ দেয়া হলো। প্রথম দফায় পত্রপত্রিকায় কিছু আঞ্চলিকতা, আত্মীয়তার কথা তুললেও ভাবলাম যাক ‘বানিজ্যের’ ভূতটাতো গেলো! দ্বিতীয় দফা শেষ হলো ১১ জুলাই’র ১৪১ তম সিন্ডিকেটের মাধ্যমে।
ফোকলোর স্টাডিজ-এ প্রভাষক পদে আবেদন করেছিলেন বাংলা একাডেমির ফোকলোর বিভাগের সহকারী পরিচালক তরুন ফোকলোর বিশেষজ্ঞ ড. সাইমন জাকারিয়া। তার প্রকাশিত গবেষণা-গ্রন্থ রয়েছে পঁচিশটিরও বেশি, সম্পাদনা করেছেন ৭০ টি।
তা ছাড়া আমেরিকা ও ফ্রান্সের ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিয়ে বেড়ায়, তার যোগ্যতার অভাব কই? কিন্তু যোগ্যতার অভাব আমার চোখে ধরা না পড়লেও কর্তৃপক্ষের চোখে ধরা পড়েছে নিশ্চয়ই- এখানে চাকরি হলো না। মনটা বিষন্ন হয়ে গেল।
সাইমন জাকারিয়ার কথা ভাবতে না ভাবতেই কাটা ঘায়ে নুনের ছিঁটা দিয়ে বসলো জাতীয় দৈনিক যুগান্তর। গত ১৫, ১৬, ১৭ জুলাই, পর পর তিন দিন দৈনিক যুগান্তর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ-বানিজ্যের একটি অডিও-ক্লিপ ফাঁস করে।
মনটা ভেঙ্গে গেলো। আরও সমস্যা হলো চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে যে দুজন শিক্ষকের ফোনালাপ প্রকাশিত হয় তারা অন্য বিভাগের হলেও আমি ওদের স্নেহ করতাম। সুতরাং খানিকটা বিব্রতও বোধ করলাম।
তদন্ত কমিটি হয়েছে। তাই এমন কোনো কথা বলা উচিৎ হবে না যা তদন্ত কাজকে প্রভাবিত করতে পারে। সহকর্মীদের অনেকেই মনে করেন যে এটা হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতির কুফল। ঘটনায় সত্য মিথ্যা যাই থাকুক না কেন, আমার বন্ধু ভিসির ওপর যত আস্থাই রাখি না কেন, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় যে নিয়োগ-বানিজ্যের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি তা বিশ্বাস করতে হবে। অপরাধ কে কতটা করেছে জানি না, তবে অপরাধ জগতে ঢোকার পরিবেশ আজও বিরাজমান।
বর্তমান উপাচার্য ড. হারুন-উর-রশীদ আসকারী এ জাতীয় আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে জড়িত- একথা এজনমে বিশ্বাস করা আমার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে শুধু নিজেকেই নির্দোষ প্রমাণ করাটা যথেষ্ট নয়, পারিপার্শিক অবস্থাটাও স্বচ্ছ রাখা অত্যাবশ্যক। বিষয়টাকে ‘অতীব গুরুত্বপূর্ণ’ র তালিকায় আনতে হবে। সকলের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
মুঈদ রহমান: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।