
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১৫ পিএম
যে নাবিকের রক্ত যমুনা বেয়ে মিশে গেছে সমুদ্রে

কমোডোর (অব.) জসীম উদ্দীন ভূইয়াঁ
প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ নামক এ ভূখণ্ডের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে অসংখ্য মানুষকে আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। সামরিক বাহিনীর অনেক দায়িত্বরত সদস্য মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে জীবনবাজি রেখে দেশমাতৃকার টানে চলে এসেছেন দেশমাতাকে শত্রুমুক্ত করতে। তবে স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও অনেক যোদ্ধা তাদের যথোপযুক্ত মর্যাদা পাননি কিংবা ইতিহাসের পাতায় তাদের যথাযথ স্থান হয়নি। তাই হয়তো পরবর্তী প্রজন্ম তাদের সম্পর্কে অবগত না হয়ে ভুলতে বসেছে সেই বীর যোদ্ধাদের।
মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৌতিক নেতদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও মতানৈক্যের কারণে দেশের সাধারণ যোদ্ধা ও জনগণ ভাবতে থাকে, দেশের জন্য এ মহান লড়াই চালিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব কিনা! যুদ্ধের গতি যখন এভাবে স্তিমিত হতে থাকে (মঈদুল হাসান, মূলধারা ’৭১, পৃষ্ঠা : ৪৩-৪৫), তখনই স্বাধীনতার গতিকে ত্বরান্বিত করতে ভূমিকা রাখেন ফ্রান্সের তুঁলন নৌবন্দর থেকে পালিয়ে আসা আটজন অকুতোভয় বাঙালি সাবমেরিনারের নেতৃত্বে গঠিত নৌ-কমান্ডো দল। তারা মার্চের ২৯ তারিখে ২৫ মার্চের ভয়াবহতার কথা শুনে মুহূর্তেই দেশকে শত্রুমুক্ত করতে যোদ্ধায় পরিণত হয়ে গিয়েছিলেন। তারা নতুন চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে পরদিনই ফ্রান্সের বন্দর ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন এবং মৃত্যুকে তুচ্ছ মনে করে নতুন দেশের স্বাধীনতার জন্য চলে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে পাকিস্তানের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অস্ত্র, রসদ, খাদ্য নিয়ে আসা জাহাজগুলো ডুবিয়ে দেওয়াই ছিল নৌ-কমান্ডোদের মূল লক্ষ্য। যমুনা নদী পাড়ি দিয়ে দেশের পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে সংযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে গাইবান্ধার ফুলছড়িঘাট ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেখান থেকে পাকিস্তানিরা বগুড়া, রংপুর, গাইবান্ধা, দিনাজপুরসহ দেশের উত্তরবঙ্গে যুদ্ধের জন্য যাবতীয় সরঞ্জাম পাঠাত।
১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে নৌ-কমান্ডোরা ফুলছড়িঘাটে অপারেশন পরিচালনার পরিকল্পনা করেন। এ অপারেশনের নেতৃত্ব দেন ২৪ বছর বয়সি তরুণ সাবমেরিনার আবদুর রকিব মিয়া। তাদের কাজ ছিল সাঁতরে জাহাজের নিচে ডুবে ডুবে জাহাজগুলোতে লিমপেট মাইন বেঁধে ফিরে আসা। এরই ধারাবাহিকতায় ২৫ অক্টোবর ১৯৭১ গভীর রাতে গোপন শিবির থেকে বেরিয়ে পড়লেন আবদুর রকিব মিয়াসহ নয় নৌ-কমান্ডো। রাতের অন্ধকারে নদীর তীরে এসে নেমে পড়লেন নদীতে। প্রত্যেকের বুকে বাঁধা লিমপেট মাইন। দুদিন আগেও যেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের আকস্মিক আক্রমণে বিভিন্ন জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তাই নদীতে তখন চলছিল সতর্কতা তল্লাশি। যমুনার স্রোত এবং পাকিস্তানি বাহিনীর তল্লাশিকে পেছনে ফেলে রকিব পৌঁছে গেলেন জাহাজের কাছে। কিন্তু তখনই জাহাজের ইঞ্জিন চালু হয়ে যায় এবং দৈত্যাকার প্রপেলারটি আবদুর রকিব মিয়ার শরীর কেটে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলে। নিমিষেই যমুনার পানি রক্তরঞ্জিত হয়ে যায়। যমুনার প্রবল স্রোতে হারিয়ে যায় তার দেহের টুকরা টুকরা অংশ। এভাবেই শত্রুকে ধ্বংস করতে গিয়ে শহিদ হন অকুতোভয় বীর রকিব।
একইভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিপ্রাপ্ত বীরদের মধ্যে সাহসী মতিউর রহমানের আত্মত্যাগের কথা চিন্তা করি। তিনি যুদ্ধ চলাকালীন দেশ থেকে ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে পরিকল্পনা করেছিলেন, একটি প্রশিক্ষণ বিমান ছিনতাই করে করাচি থেকে ভারতে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করবেন। সে সময়ে তার প্রশিক্ষক ছিলেন বিখ্যাত আকাশযোদ্ধা সাইফুল আজম। মতিউর রহমানের পরিকল্পনা জানার পর সাইফুল আজম (যিনি নিজেও বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন; ফলে বিমান উড্ডয়নে তাকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল) সার্বিক দিক বিবেচনা করে মতিউরকেও নিষেধ করেছিলেন এ রকম কোনো পরিকল্পনা না করার জন্য (উল্লেখ্য, মতিউর রহমান শহিদ হওয়ার পরপরই সাইফুল আজমকে পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা আটক করেছিল)। কিন্তু মতিউর রহমান কারও কথায় কর্ণপাত না করে নিজের পরিকল্পনায় অটল থাকেন। অবশেষে ২০ আগস্ট উড্ডীন বিমানে তার ছাত্র রাশেদ মিনহাজ পরিকল্পনা বুঝতে পেরে বিমানের নিয়ন্ত্রণ নিতে মতিউরের সঙ্গে ধস্তাধস্তি শুরু করে এবং এক পর্যায়ে মতিউর রহমান বিমান থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যান এবং বিমানটিও মিনহাজসহ বিধ্বস্ত হয়। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সাহসিকতার জন্য মতিউরকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ পদক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ প্রদান করা হয়।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের আত্মত্যাগের থেকে রকিবের আত্মোৎসর্গ কোনো অংশেই কম নয়। এমনকি আমরা যদি বাকি ছয় বীরশ্রেষ্ঠের আত্মত্যাগের দিকে লক্ষ করি, সেক্ষেত্রেও সার্বিক দিক বিবেচনা করলে রকিবের এ বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ বীরশ্রেষ্ঠের মতো সর্বোচ্চ বীরত্বপূর্ণ পুরস্কারের দাবিদার। নিশ্চিতভাবে আবদুর রকিব বীরবিক্রম বাংলাদেশ নৌবাহিনীর এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এত বড় আত্মত্যাগের পরও বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে রকিবের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। আমরা জানি, গত ৯ মার্চ বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তিনটি নৌঘাঁটির নাম পরিবারতন্ত্রের বলয় হতে মুক্ত করে পরিবর্তন করা হয়েছে। এর মধ্যে দুটির নামকরণ করা হয়েছে ‘বনৌজা ঢাকা’ এবং ‘বনৌজা পেকুয়া’। একজন সাবেক নৌ-কর্মকর্তা হিসাবে চাই, এ দুটি ঘাঁটির একটি শহিদ রকিবের নামে করার দাবি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পেশ করুক বাংলাদেশ নৌবাহিনী। এটি কোনো কঠিন কাজ নয়। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এমন কোনো কর্মকর্তা ছিলেন না, যিনি তার মতো সাহসী যোদ্ধাদের গৌরবময় আত্মত্যাগের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে পারতেন। ফলে রকিবের আত্মত্যাগ ইতিহাসের অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছিল। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, ৫৪ বছর আগে নাবিক রকিবের ছিন্নভিন্ন দেহ থেকে প্রবাহিত রক্তধারা যমুনার স্রোতে ভেসে অসংখ্য নদীর সঙ্গে মিশে গেছে। সে রক্তধারা শেষ পর্যন্ত গিয়ে মিলেছে সমুদ্রের অতল গহ্বরে। আজ আমাদের বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যদের মনে রাখা উচিত, এ সমুদ্রে মিশে আছে তার অমর আত্মত্যাগের রক্ত, যে সমুদ্রের বুকে আমরা নিরলসভাবে জাহাজ চালাই, যার সীমানা রক্ষায় প্রতিনিয়ত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকি।
নাবিক রকিবের মতো বীরদের আত্মত্যাগকে যদি আমরা যথাযথভাবে স্বীকৃতি না দিই, তাহলে ইতিহাস আমাদের অকৃতজ্ঞ রক্ষক হিসাবে বিচার করতে পারে। কিন্তু আজ আমরা যারা নৌবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করছি, আমাদের সেই ভুল সংশোধনের সুযোগ ও দায়িত্ব উভয়ই রয়েছে। তার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাতে অন্তত একটি নৌঘাঁটির নাম তার নামে করা হোক, যা তার সাহস ও আত্মত্যাগের চিরন্তন স্বীকৃতি হিসাবে থাকবে।
এ নামকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশ নৌবাহিনী যেমন এ বীরের জন্য কিছু করতে না পারার দায়মুক্ত হতে পারে, তেমনই এটি সশস্ত্রবাহিনীর তরুণ সদস্যদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করবে। নতুন প্রজন্ম শিখবে কীভাবে একজন যোদ্ধার আত্মত্যাগ জাতির গৌরবময় ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে।
কমোডোর (অব.) জসীম উদ্দীন ভূইয়াঁ : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান এবং উপ-উপাচার্য, বিইউপি