
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০২ পিএম
কৃষি সংস্কার ভাবনা

আহমাদ সালাহুদ্দীন
প্রকাশ: ২৫ মার্চ ২০২৫, ১২:১৫ পিএম

আরও পড়ুন
আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতায় কৃষি নিয়ে গভীর আলোচনা এবং বিবেচনা দাবি করে। বর্তমান সরকারের পদক্ষেপে আমরা সাধারনভাবে বলতেই পারি, এই মুহূর্তে তাদের কাছে কৃষি তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। একজন সার্বক্ষনিক উপদেষ্টা পাওয়ার মত জরুরি মন্ত্রণালয় এটি নয়। তার ওপর বিবেচনা হল অন্য একটি অতি জনগুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পার্ট টাইমার হলেই চলবে। আরেকটি জরুরি বার্তা আমরা পেয়েছি সরকারের তরফে। কৃষি খাত সংস্কারের কোন বিষয় হিসেবে যোগ্যতা লাভ করতে পারেনি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় কমিশন করা হয়েছে কিন্তু কৃষি নিয়ে নয়। কেন এমন বিবেচনা আমাদের, এ সিদ্ধান্ত কি সঠিক? এমন অনেক প্রশ্ন আমরা করতেই পারি।
সংঘাত এবং অনিশ্চয়তায় পূর্ণ পৃথিবীর দেশে দেশে যে নিরাপত্তা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে সেরকম ঘটনা বেশি বেশি ঘটতে থাকলে সার্বিক নিরাপত্তা এবং খাদ্য নিরাপত্তা বিষয় দুটিকে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে গণ্য করতে হবে। বিশ্ববাজারে যখন খাদ্যের দাম অস্বাভাবিক হয়ে যায়, যেমন হয়েছিল ২০০৮ সালে, কিংবা করোনা জাতীয় মহামারির প্রকপের সময়ে এই সত্য আমরা অনেক দাম দিয়ে শিখেছিলাম। আমাদের অনেক কাছের মিত্র দেশ তখন আমাদের খাদ্য আমদানি আবেদনে সাড়া দেয়নি। এখন আমরা সেটা ভুলে আছি।
কৃষি গুরুত্বপূর্ণ কারণ এ খাতে দেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক স্বল্পবিত্তের মানুষ জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শ্রমজীবী বিভিন্নভাবে। যারা নিজেরা নিজেদের জন্য খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি অন্যদের জন্যও খাদ্য উৎপাদন করছে অনেকটা বিনা মুনাফায়। কৃষিতে শ্রম দিচ্ছে পুরুষ, মহিলা, বৃদ্ধ, নাবালক বালক বালিকা,বন্যা, খরা, ঝড়-বৃষ্টি, মড়ক, ইত্যাদি উপেক্ষা করে তাদের জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার আশায়। নিজেরা দেশের বোঝা না হয়ে নিজেরা নিজেদের কর্মসংস্থান করছে।
শ্রমিকের মজুরি হার বৃদ্ধি, পাশাপাশি আছে সেচের পানি, সার, বীজ, ইত্যাদির চড়া মূল্য। কমে এসেছে এসবের উপর ভর্তুকির হার। এসব ছাড়াও আছে আরও অনেক সমস্যা টিকে থাকার কঠিন সংগ্রামে।
আরও আছে কৃষিজীবিদের জন্য নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের কাছ থেকে অবহেলা, অধিকারহীনতা, শোষন, বঞ্চনা, না আছে মানবিক অধিকার। নাই তাদের পন্যের কোন ন্যুনতম মুল্যের নিশ্চয়তা। নাই চাহিদামাফিক কম সুদহারে ঋন পাওয়ার ব্যবস্থা। না আছে প্রচলিত সম্প্রসারন ব্যবস্থায় সম্মানজনক সেবা পাওয়ার গ্যারান্টি। যে পন্যটি তারা বাজার থেকে কিনবে তার দাম তাদের সাধ্যের চেয়ে বেশি এবং ক্রমাগত বাড়ছে, কিন্তু যা তারা বিক্রি করবে তা সব সময় কম এবং অনিশ্চিত। দুর্যোগে ফসলহানিতে কোনো রক্ষাকবচ নাই, নাই বীমার কোনো ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের কৃষির একটি একটা বড় সৌন্দর্যের দিক হোল এর চালিকাশক্তি হিসেবে আছে ক্ষুদ্র এবং ছোট কৃষকের অংশগ্রহন। ভুস্বামী বলতে যা বোঝায় সে রকম কোন শ্রেণি নাই। যদিও কিছু কিছু এলাকায় কিছু কিছু কোম্পানি ভুস্বামী আমরা দেখতে পাই। সমস্যা হোল এই বিরাট জনগোষঠী একেবারে অসংগঠিত। একেকটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খামার। বর্তমান উন্নত্ কৃষির যেসব উপাদান আছে যেমন নতুন ফসল করা, যান্ত্রিকিকরন করা, ডিজিটাল তথ্য এবং মেশিন ব্যবহার, আবহাওয়া তথ্য, বাজার বিষয়ে তথ্য, সহজ ঋণ, প্রযুক্তিগত জ্ঞান, পরিবেশ সম্মতভাবে নিরাপদ এবং পুশটিগুন সম্পন্ন খাদ্য উৎপাদন – এসব বিষয়ে হালনাগাদ থাকা এবং কাজে লাগানোর জন্য দরকার ক্ষুদ্র কৃষকদের দলগতভাবে কাজ করা। রাষ্ট্র যদি এ দায়িত্ব নেয় তাহলেই এদেরকে সংগঠিত করার মাধ্যমে কার্যকরী উন্নয়ন করা সম্ভব। এককভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষকদের পক্ষে সংগঠিত হওয়া সম্ভব নয় এবং বর্তমানে জারি থাকা ব্যবস্থা থেকে কার্যকরি কোন সেবা পাওয়াও সম্ভব না।
বিশাল এই ক্ষুদ্র কৃষকদের পাশাপাশি গংগঠিত আছে একটা ক্রম বর্ধনশীল কৃষক উদ্যোক্তা শ্রেনি, যারা নানান রকম শাক-সবজি, ফলমূল, মুরগি, মাছ, ডিম, উৎপাদন করে বাজারে সরবরাহ বাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে কোনরকম সহায়তা ছাড়া। তাদের দরকার নতুন নতুন প্রযুক্তিগত জ্ঞান, বীজ, বাজার তথ্য, ভালো দাম, পরিবহন, সমবায়, মেশিন, ঋণ, ইত্যাদি। সার্বিকভাবে সফল হওয়ার জন্য তাদের দরকার কৃষি ব্যবসায় সংক্রান্ত সব রকম সুযোগসুবিধা, সহায়তা।
দেশের বর্তমান উৎপাদন ব্যবস্থায় প্রায় পুরোটাই পরিচালিত হয় ব্যক্তিখাতে, অল্পকিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। কৃষক যেমন এক একটি ব্যক্তিখাত, তেমনি যারা বীজ, সার, কীটনাশক, যন্ত্রপাতি, চাষ, সেচ, কাটা, মাড়াই, সংরক্ষন, বাজারজাতকরন, এ সবটাই করে ব্যক্তিখাত। এখানে তাদের কাজ কিভাবে বাড়ানো যায়, নিয়ন্ত্রন করা যায়, কাজটাকে কিভাবে সহায়তা দেয়া যায়, উদবৃত্ত পন্য কিভাবে রফতানি করা যায় এসব বিষয়ে অনেক কিছু ভাবার আছে। রাষ্ট্রের প্রধান ভুমিকা হওয়া উচিত সহায়তাকারীর, ব্যক্তিখাত নীতিমালা এবং তদারকির আওতায় মানসম্মত সেবা পরিচালিত করবে।
ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাকে তাদের সুদহার কমিয়ে কিভাবে ব্যাপকভাবে কৃষি সহায়তা দেয়ার কাজে ব্যবহার করা সে ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে। ক্ষুদ্রঋণ যেহেতু গ্রামে গ্রামে কাজ করে তাদের সম্ভাবনাকে সৃজনশীল্ভাবে কৃষির পক্ষে ব্যবহার করতে পারতে হবে।
এখানে আরও যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনায় নেয়া দরকার তা হোল কৃষি ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত বর্তমান যে কেন্দ্রিভুত কাঠামো বিদ্যমান সেটিকে বজায় রেখেও আমরা খুব বেশি এগুতে পারবো না। বিদ্যমান ব্যবস্থায় সবকিছু পরিচালিত এক কেন্দ্রিক প্রশাষনিক কাঠামোয় যা প্রান্তিক অবস্থানে থাকা লক্ষ লক্ষ কৃষক কিংবা এ কাজে নিয়োজিত হাজার কয়েক কৃষি সম্প্রসারন কর্মীর চাহিদা পূরণে কোন কার্যিকরি ভূমিকা রাখতে পারে না। বর্তমানের সমস্যা চাহিদা পূর্ন করা, বিভিন্ন এলাকার মাটি, জলবায়ু, আবহাওয়া,পরিবেশগত ভিন্নতা বিবেচনায় নিয়ে তা সমাধান করা, এর সঙ্গে নিবিড়ভাবে লেগে থেকে কাজ করা, কৃষি ব্যবস্থায় জড়িত সব পক্ষের সঙ্গে কাজ করা কেন্দ্রিভুত কোন সংস্থার পক্ষে সম্ভব না। কৃষি, মৎস্য, পশুপালন, ঋণ, বাজার ব্যবস্থাপনা, কারিগরি জ্ঞান, তথ্য এসব একসঙ্গে একজন মাঠকর্মি যাতে এককভাবে সরবরাহ করতে পারে এমন কর্মিবাহিনী গঠন করতে হবে, যাদের প্রত্যেকের হাতের মুঠোয় থাকবে একটা করে তথ্যভান্ডার। মাঠ পর্যায়ে বর্তমানে এগুলোর সমন্বয় নাই, সবাই বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে। সব দপ্তরগূলোর সব গ্রামে কাজ করার জন্য যথেষ্ট জনবলও নাই।
আমাদের দরকার হবে প্রচলিত প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়ন মডেল থেকে বেরিয়ে আসার। এগ্রইকলজি, চাহিদা, ট্র্যাডিশন, চাহিদা, এসব বিবেচনায় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী কর্মসুচির পরিকল্পনা করে এগুতে হবে। প্রকল্প করা যেতে কোনকিছু পরীক্ষা করার জন্য যেগুলোর প্রাথমিক ফলাফল যাচাইয়ের উপর ভিত্তি করে কর্মসুচী চুড়ান্ত করা হবে। শুধুমাত্র কিছু লোকের স্বার্থে প্রকল্প প্রনয়ন বন্ধ করতে হবে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোরও ব্যাপক পরিবর্তন করতে হবে। এগুলোরও ব্যাপক বিকেন্দ্রিকরন করা দরকার। এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুগের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়ে এগুলোর ব্যাপক পুনর্গঠন দরকার। দেশের বিভিন্নপ্রান্তের সমস্যা এবং সম্ভাবনার কথা বিবেচনায় রেখে এগুলোর পুনর্বিন্যাস করা দরকার। আমাদের কৃষি শিক্ষ্যার বিশ্ববিদ্যালয় গুলিরও পুনর্বিন্যাস করতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি এগুলোকে ব্যাপকভাবে গবেষণা এবং কৃষি সম্প্রসারন কাজে কাজে নিয়জিত করতে হবে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, উভয় পক্ষেরই অনেক বেশি বেশি বাস্তব কৃষির সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
অন্য অনেক বিষয়ের মত কৃষির রুপান্তর করতে হলে দরকার এর ব্যবস্থাপনার একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন। এর কাঠামোগত সংস্কার করতে হবে। ব্যাপকভাবে বিকেন্দ্রিকরন করতে হবে। চুয়ান্ন বছরে গড়ে ওঠা এককেন্দ্রিক ভারি প্রশাশন কাঠামো ভাংতে হবে। কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলির মধ্যে থাকা অনাবশ্যক বিভাজন, প্রতিবন্ধকতা ভাংতে হবে। পানির জন্য, সেচের জন্য, খালের জন্য, বীজ সার যন্ত্রপাতির সরবরাহের জন্য যেসব আন্তবিভাগীয় জটিল সিদ্ধান্তগ্রন প্রক্রিয়া কৃষি উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ করে সেগুলির স্থায়ী সমাধান করতে হবে। স্থানীয় সরকারের অধীনে সব ধরনের কৃষিসেবা একসঙ্গে এক অফিসে পাওয়া যাবে এমনভাবে গড়ে উঠতে পারে জেলায়/উপজেলায় একেকটা নিজস্ব কৃষি অফিস। স্বশাসিত। প্রয়োজনে স্থানীয় সরকারের কাঠামোর সঙ্গে মিলিয়ে দুটিকেই ব্যাপকভাবে সংস্কারের মধ্যে আনতে হবে এবং নির্বাচিত নেতৃত্বের অধীন করতে হবে যাতে তারা এলাকার কৃষকদের চাহিদা মত সেবাদান নিশ্চিত করতে পারে। এবং স্থানীয় সরকারের প্রশাসন তা সঠিকভাবে তদারকি করতে পারে। এসকল বিষয় বিবেচনা, আলোচনা, সার্বিক বিবেচনা, সুপারিশ এবং সে অনুযায়ী সকল পক্ষের সঙ্গে সার্বিক আলোচনা এবং বাস্তবায়ন করার জন্য অবশ্যয়ই একটি কমিশন করা যেতেই পারে। একজন সার্বক্ষণিক কৃষি উপদেষ্টাকে নিয়োগ দেয়া যেতেই পারে এ বিষয়ে কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য এবং আগামিতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা তথা দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে জোরদার করার জন্য।
লেখক: আহমাদ সালাহুদ্দীন
উন্নয়ন গবেষক
ahmad.salahuddin48@gmail.com