
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৮ পিএম
ফিলিস্তিনে পশুশক্তির বর্বরতা : মুক্তি কতদূর

আমিরুল মোমেনীন মানিক
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এখন পবিত্র রমজান। মুসলমানদের ইবাদতের ফলবতী মৌসুম। সমগ্র পৃথিবী উবু হয়ে আছে আল্লাহর নৈকট্য লাভের এক রুহানি প্রচেষ্টায়। কিন্তু এই পবিত্র মাসেও বর্বরতা থেমে নেই ফিলিস্তিনে, গাজায়। ফিলিস্তিনজুড়ে পবিত্র রমজানের মধ্যেই যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করে পশুশক্তি ইসরাইল আবারও শুরু করেছে পৃথিবীর নিকৃষ্টতম গণহত্যা। প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাসের পবিত্র ভূমিতে এ অন্যায় ও হত্যাযজ্ঞ চলছে। বায়তুল মুকাদ্দাস, পৃথিবীর সব শৌর্যবীর্যের ইতিহাস যেখানে স্থির। বায়তুল মুকাদ্দাস ও তার আশপাশের এলাকা তথা সমগ্র ফিলিস্তিন ভূখণ্ড বহু নবি-রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত। আল কুরআনে এ পুরো ভূখণ্ডকে ‘পবিত্র ভূমি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণে হাজার হাজার বছর ধরে মসজিদুল আকসা, বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিনের প্রতি ভালোবাসা প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত।
২.
১০৯৬ সাল। ক্রুসেডার খ্রিষ্টানরা সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন শক্তির জোরে দখল করে নেয়। এরপর বায়তুল মুকাদ্দাসের বিভিন্ন ইসলামি স্থাপনায় পরিবর্তন আনে। প্রায় ১০০ বছর পর উদ্যোগী হন এক অসীম সাহসী লড়াকু নেতা, সালাহউদ্দীন আইয়ুবি। তিনি ১১৮৭ সালে বায়তুল মুকাদ্দাসকে নিপীড়কমুক্ত ও দখলমুক্ত করেন।
১৯৪৮ সালের ১৫ মে ফিলিস্তিনি মুসলমানের ভাগ্যে নেমে আসে দুর্ভোগ। ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় ফিলিস্তিনে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর সেখানকার মুসলমানদের ওপর ধারাবাহিকভাবে বিপদ আসতে শুরু করে। সমগ্র পৃথিবীর বিশ্বাসী মুসলমানের হৃদয়ে ক্ষত তৈরি করে এই ইসরাইল। বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে ইহুদিবাদী ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনের ভূমি ও পবিত্র কুদস দখলের পর কঠিন সময় অতিবাহিত হতে থাকে। বিজয়ের নতুন বার্তা নিয়ে আসে ১৯৭৯ সাল। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়ে পশ্চিমা আধিপত্যবাদ এবং স্বৈরাচার রেজা শাহের মসনদ গুঁড়িয়ে ইরানে সংঘটিত হয় ইসলামি বিপ্লব। এ বিজয় ফিলিস্তিন ইস্যুর পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে। বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেনী দখলদার ইহুদিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন করেন এবং কুদস শরিফ ও ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমির মুক্তির হারিয়ে যাওয়া লক্ষ্য ও আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
৩.
ইমাম খোমেনীর পক্ষ থেকে রমজান মাসের শেষ দশকের শুক্রবারকে আল কুদস দিবস পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এটি ছিল একটি বৃহৎ বুদ্ধিবৃক্তিক ও গঠনমূলক রাজনৈতিক উদ্যোগ, যা ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের পথকে আলোকিত ও মসৃণ করে তোলে। সেই পথ ধরে আল কুদস কমিটি বাংলাদেশও সোচ্চার হচ্ছে সম্মিলিত প্রতিবাদে এবং নিপীড়নের বিপক্ষে দাঁড়ানোর কর্মতৎপরতায়।
৪.
অনেক জুলুম-নির্যাতন পেরিয়ে আসে ৭ অক্টোবর ২০২৩। ‘আল-আকসা ফ্লাড’ নামে আকস্মিক ওই হামলার প্রয়োজন ছিল অপরিহার্য। হামাস বলেছে, ‘এটি ছিল প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ এবং ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরাইলের সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় স্বাভাবিক এক প্রতিক্রিয়া।’ এ হামলার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ পশ্চিমা বিশ্বের মোড়লদের হিসাব-নিকাশ পালটে দেওয়া হয়। একতরফাভাবে ইসরাইলকে সমর্থন করার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সব তৎপরতা প্রায় থমকে যায়। পুরো বিশ্বব্যবস্থায় শক্তির একটি ভারসাম্য তৈরির উপলব্ধি ও প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায় পৃথিবী। একদল মজলুমের পক্ষে, অন্যটি নিপীড়কের পৃষ্ঠপোষকতায়।
৫.
হামাসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ৭ অক্টোবরের হামলায় শুধু ইসরাইলি সেনা ও সশস্ত্র ব্যক্তিদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। ইসরাইল সরকারের তথ্য অনুযায়ী, হামাসের ওই হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জনের প্রাণ গেছে। হামাসের হামলার জবাবে একই দিন ফিলিস্তিনের গাজায় পালটা হামলা শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। দেড় বছর হয়ে গেল, এখনো নির্বিচার হামলা অব্যাহত রয়েছে। হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় এরই মধ্যে গাজায় লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ গেছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছেন ২০ লাখের বেশি মানুষ।
৬.
গাজায় ৭ অক্টোবরের পর থেকে জানুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত ২১০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। হিটলারের সময়েও এরকম নির্বিচারে সাংবাদিক হত্যা করা হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬৯ জন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৬৩ জন সাংবাদিক নিহত হন। পৃথিবীর সব নিপীড়নের ইতিহাসকে ছাপিয়ে গেছে ইসরাইলের দেড় বছরের বর্বরতা।
সাংবাদিক হত্যায় সরাসরি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ জড়িত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শুধু সাংবাদিক হত্যার প্রতিবাদে সোচ্চার হলে নিশ্চিত সর্বোচ্চ শাস্তির দণ্ডপ্রাপ্ত হবে সংশ্লিষ্ট ইসরাইলি কর্মকর্তারা। মানবতার তথাকথিত ধ্বজাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এসব ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে ইসরাইলকে আরও বিধ্বংসী হওয়ার সাহস দিয়ে যাচ্ছে।
৭.
গাজা তথা ফিলিস্তিনজুড়ে চলমান গণহত্যার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে পুরো পৃথিবীর কোটি কোটি মানবিক মানুষ এবং শত শত সংগঠন। ইউরোপ-আমেরিকার সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল বিক্ষোভে ভিত নড়ে গেছে শাসকদের। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, জার্মানি, রাশিয়া, চীনসহ দেশে দেশে ইসরাইলের বিরুদ্ধে মানুষের সম্মিলিত প্রতিবাদ ও ঘৃণা এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তরে, জনপদে। দুনিয়াজুড়ে শিক্ষার্থী-জনতার এরকম প্রতিবাদের নজির নিকট অতীত ঘাঁটলে খুব একটা পাওয়া যায় না। জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস ইতোমধ্যে নেতানিয়াহু এবং তার যুদ্ধবাজ পরিষদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। ইউরোপ-আমেরিকার অনেক রাষ্ট্র সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এ খুনিদের সঙ্গে। আরব বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোও জনরোষের ভয়ে ইসরাইলপ্রীতি থেকে আপাতত দূরে সরে এসেছে। বিশ্বের তাবৎ বড় বড় গণমাধ্যম নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখা এবং অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় নিপীড়ক ইসরাইল এবং তার প্রধান মদদদাতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতারণার মুখোশ খুলে দিয়েছে। ফলে এতদিন ধরে মানবাধিকার নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের অব্যাহত বয়ান মুখথুবড়ে পড়েছে।
৮.
৭ অক্টোবর ২০২৩-এর পর ইসরাইল তার সর্বশক্তি নিয়ে হামলে পড়া সত্ত্বেও এখনো কীভাবে টিকে আছে হামাস এবং গাজার অভ্যন্তরে থাকা অন্যান্য মুক্তিকামী সংগঠন, তা রীতিমতো বিস্ময় তৈরি করেছে। নেতানিয়াহুর পশুশক্তি আইডিএফের অত্যাধুনিক ট্যাংক, মিসাইল, যুদ্ধবিমান ও রণকৌশলও দুর্বল করতে পারেনি হামাস, ইসলামিক জিহাদসহ সম্মুখসমরের ফ্রন্টগুলোকে। গাজাজুড়ে যেভাবে বিস্ময়কর ফাঁদ পেতে, অজ্ঞাত সুড়ঙ্গে নিজেদের সুরক্ষিত রেখে লড়াই করে যাচ্ছে প্রতিরোধ যোদ্ধারা, তা পৃথিবীর অভিজ্ঞ সমরবিদদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। তারা বিস্ময়ের সঙ্গে বলছেন, এও কি সম্ভব?
গাজার বাইরে লেবানন থেকে হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি আর্মি, ইরাকের মিলিশিয়া বাহিনী, বাহরাইনের আল-আশতার ব্রিগেড ইসরাইলের চতুর্দিকে যেভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, তাতে ইসরাইলের নিপীড়ক বাহিনী চোখে শর্ষে ফুল দেখছে। ইতোমধ্যে একগুঁয়ে ও কাপুরুষ নেতানিয়াহু নিশ্চিত হয়েছে যে, যেহেতু পরাজিত হতেই হবে, সুতরাং গণহত্যার দাগ রেখেই নিশ্চিহ্ন হব। এর বাইরে ফিলিস্তিনি জনগণকেও নানাভাবে প্রলুব্ধ করা হয়েছে। বিশেষ করে গাজাবাসীকে অন্যত্র স্থানান্তরেরও কূটচাল দিয়েছে মধ্যস্থতাকারী নানা দেশ। কিন্তু অনমনীয় ও দৃঢ় মানসিকতা, উজ্জীবিত ইমান ও দেশপ্রেমের কারণে বিন্দু পরিমাণ টলাতে পারেনি ফিলিস্তিনিদের।
৯.
তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে, ফিলিস্তিনের পক্ষের শক্তিগুলোর দুর্বলতাও প্রকটভাবে ধরা পড়ছে। চৌকশ সমরনায়ক কাসেম সোলাইমানীর শাহাদাতের পরও গোয়েন্দা ও সমরকৌশলে ত্রুটিগুলো যথাযথভাবে দূর করতে পারেনি ইরান। ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. ইবরাহিম রাইসিসহ হেলিকপ্টারে সফরকারী পুরো দলকে হত্যা, ইরানের তেহরানের সুরক্ষিত এলাকায় হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা, হিজবুল্লাহপ্রধান হাসান নরুল্লাহর শহিদ হওয়া এবং সর্বশেষ গাজায় যুদ্ধ করতে করতে প্রাণ হারানো যুগশ্রেষ্ঠ বীর ইয়াহইয়া সিনওয়ারের মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে মুক্তিকামী মানুষকে। প্রতিরোধ ফ্রন্টগুলোকে আরও শক্তিশালী করা, ইরানের রণকৌশলের দূরদর্শিতা বাড়ানো এবং বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক বিজয়ের জন্য নতুন নতুন প্রস্তুতি এখন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
১০.
এই মার্চে যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গ করে ফিলিস্তিনে প্রায় ১০০০ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার পর ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী জনধিকৃত চিহ্নিত গণহত্যাকারী নিকৃষ্ট নেতানিয়াহু গত ১৮ মার্চ বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় হামাসের বিরুদ্ধে পূর্ণ শক্তিতে যুদ্ধ আবার শুরু করেছে তার দেশ। এটা তো কেবল শুরু।’ দেড় বছর ধরে চলা এত বড় নৃশংসতা, এত বড় গণহত্যার পরও নিশ্চুপ রয়েছে আরবের তথাকথিত মোড়লরা। জনরোষে মসনদ উলটে যাওয়ার ভয়ে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা থেকে সরে এলেও ইসরাইলের পক্ষে এখনো পরোক্ষভাবে নানা কূটকৌশল বাস্তবায়নের পথেই হাঁটছে আরবের মোড়লরা। ফলে এসব শাসক নিজ দেশে যেমন ঘৃণিত মানুষে পরিণত হচ্ছেন, অন্যদিকে বিশ্বও তাদের সামনে ছোট হয়ে আসছে। পশ্চিমাদের পদলেহন করে আরব মোড়লরা নিজেদের তন্ত্রমন্ত্র এবং বিলাসী মসনদ আর কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন, এটাই এখন বড় প্রশ্ন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? পৃথিবীর শক্তিধর শাসক ও রাষ্ট্রগুলো কি বোবা হয়েই থাকবে? ফিলিস্তিনি জনগণ এবং আল-আকসার মুক্তি কি তবে সুদূরপরাহত। কিন্তু মহান আল্লাহ তো ঘোষণা করেছেন, সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত! তাহলে?
আমাদের সামনে কেবল একটাই পথ খোলা। ইমানে উজ্জীবিত হয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে পশুশক্তির বিরুদ্ধে অব্যাহত প্রতিরোধই মুক্তির একমাত্র উপায়।
আমিরুল মোমেনীন মানিক : সাংবাদিক