
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৭ পিএম
নির্বাচনের ঘোষণা অস্থিরতা নিরসনে সহায়ক হবে

ড. এটিএম জহিরউদ্দিন
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
গত ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জার্মান সরকারের কমিশনার জারাহ ব্রুনের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ বছরের শেষের দিকে নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে। এর আগে সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে নানা ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। জানুয়ারির শুরুর দিকে প্রধান উপদেষ্টা একটি বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাতীয় নির্বাচনের দুটি সম্ভাব্য সময়ের কথা বলেছিলেন, যার একটি হচ্ছে চলতি বছরের শেষে, আরেকটি ২০২৬-এর মাঝামাঝি। এই প্রথমবার সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি আগামী নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নিয়ে কথা বললেন।
এর দুদিন পর ২৮ ফেব্রুয়ারি জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে জাতীয় নাগরিক পার্টি নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের যাত্রা শুরু হয়েছে। নতুন এ রাজনৈতিক দলের জন্য শুভকামনা রইল। বিশেষ করে এ দলের শীর্ষনেতা সদ্য পদত্যাগকারী উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে আন্তরিক অভিনন্দন, তিনি নতুন এ রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য উপদেষ্টার মতো বড় একটি পদ ছেড়ে দিয়ে নজির স্থাপন করেছেন। নতুন দলের আত্মপ্রকাশের দিন এর নেতারা যেভাবে বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন, তা সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। আবার ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ প্রতিষ্ঠা বলতে তারা দেশে কোন পরিবর্তনের কথা বোঝাচ্ছেন, তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। অন্যদিকে শীর্ষ নেতৃত্ব শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের মোটামুটি একই বয়সসীমার ও একই ভাবাদর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে দলটি নিজেই বৈষম্যের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করল কিনা, সে বিষয়েও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এসব প্রশংসা, ধোঁয়াশা ও বিতর্ক ছাপিয়ে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় হলো, এ দলটি তার যাত্রার শুরু থেকে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষিত এ বছরের শেষে নির্বাচনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। গত ৪ মার্চ দলটির অন্যতম নেতা সারজিস আলম একটি দলীয় কর্মসূচিতে বলেছেন, ‘যত দিন না পর্যন্ত খুনি হাসিনাকে ফাঁসির মঞ্চে দেখছি, তত দিন যেন কেউ ভুলক্রমেও নির্বাচনের কথা না বলে।’ গত সপ্তাহে দুটি আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে এ বছর নির্বাচন করা সম্ভব হবে না বলে মত ব্যক্ত করেছেন। ৫ আগস্টের পর থেকে যখনই নির্বাচনের বা নির্বাচনি রোডম্যাপের ইস্যু তোলা হয়েছে, তখনই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীসহ অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুধু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য হয়নি এবং সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার এবং ফ্যাসিস্টদের, বিশেষ করে শেখ হাসিনার বিচার শেষ হওয়ার আগে এভাবে নির্বাচন দাবি করা জুলাই বিপ্লবের চেতনার পরিপন্থি।
আঠারো শতকের বিখ্যাত দার্শনিক এডমুন্ড বার্কের সংজ্ঞা অনুযায়ী, একটি রাজনৈতিক দল হলো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের সমষ্টি, যারা তাদের নিজেদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত কিছু আদর্শ ও নীতিমালার ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব বা ক্ষমতা গ্রহণ করতে চায়। প্রতিটি দল রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে তার আদর্শ ও নীতিতে বিশ্বাসী মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, যে প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল তার আদর্শে বিশ্বাসী লোকদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পন্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং দলের নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ সাধনের চেষ্টা করে। একটি রাষ্ট্রে যেহেতু বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল থাকে, যাদের প্রত্যেকেই যার যার নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা গ্রহণ করতে চায়, তাই তাদের মধ্যে কোন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে তা জনগণ তাদের রাজনৈতিক পছন্দ বা political choice-এর ভিত্তিতে ঠিক করে, যেটি যাচাই করার সংগঠিত এবং সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি হচ্ছে নির্বাচন। কাজেই নিজেদের দলীয় নীতি ও আদর্শ প্রচার করে জনগণের আস্থা অর্জন এবং জনগণের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণে সেই নীতি ও আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের পরিকল্পনার কেন্দ্রে থাকবে নির্বাচন, এটাই স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও দীর্ঘ ষোল বছরের স্বৈরাচার সরকার উৎখাতের পর শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে অনীহা দেখাচ্ছে কেন?
জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতারা দল গঠনের আগে ও পরে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত করার দাবির পেছনে মূলত তিনটি যুক্তি বা অজুহাত দেখাচ্ছেন : সংস্কার, ফ্যাসিস্টের বিচার, আর সাম্প্রতিককালে অবনতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট দেওয়ার পর সংস্কার বিষয়ে এখন পর্যন্ত সামান্যই অগ্রগতি হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর গুম, খুন, আয়নাঘরসহ ফ্যাসিস্টদের বিভিন্ন মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ লুটপাটের বিচারের জন্য যে অগ্রগতি হয়েছে, তাতে আশা করা যায় না, এ বছরের মধ্যে ফ্যাসিস্টদের বিচার শেষ করা যাবে। বিপ্লব-পরবর্তী অরাজকতা কাটিয়ে উঠে ক্রমান্বয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি প্রত্যাশিত থাকলেও ডাকাতি, ছিনতাই, নারীর প্রতি সহিংসতা নিকট অতীতের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। এসব ঘটনায় জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারের সক্ষমতা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তেমনি বিপ্লবের পর বিভিন্ন বিশৃঙ্খল ও ধ্বংসাত্মক ঘটনায় সরকারের নির্বিকার অবস্থান আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সদিচ্ছার বিষয়েও সংশয় সৃষ্টি করছে। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত নির্বাচনের সময়সীমার বাকি নয় মাসেও যদি এ পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তাহলে কি এ নতুন রাজনৈতিক দলের নেতাদের দাবি অনুযায়ী নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলিয়ে রেখে বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের অধীনে জাতি একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু করবে? জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার অবশ্যই জনসমর্থন নিয়েই দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছিল। সুষ্ঠু নির্বাচনকে কবর দিয়ে অনির্বাচিতভাবে অনির্দিষ্টকাল ক্ষমতায় থাকার বাসনা নিয়ে শেখ হাসিনা যে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিলেন, আন্দোলনের মাধ্যমে সেই ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করে ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্যই জনগণ এ সরকারকে সমর্থন জানিয়েছিল। নতুন একটি অনির্বাচিত সরকারের অধীনে অনির্দিষ্টকাল ভোটের অধিকারহীন থাকার জন্য নিশ্চয়ই জনগণ এ সরকারকে সমর্থন দেয়নি।
বিপ্লবের সময় একটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘দেশটা কারো বাপের না’। বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে প্রায় পুরো সময় ধরে নির্যাতিত দেশবরেণ্য আলোকচিত্রী ও সমাজকর্মী এবং এ বছরের একুশে পুরস্কার বিজয়ী ড. শহিদুল আলমও একই ধরনের স্লোগান দিয়েছেন। তিনি যে পাঞ্জাবি পরে তার একুশে পদক গ্রহণ করেছেন, তাতে লেখা ছিল ‘এই বিপ্লবও কারও বাপের না’। আক্ষরিক অর্থেই দেশের মালিকানা জনগণের, বিপ্লবের মালিকানাও জনগণের। দেশ বা বিপ্লবের মালিকানার দাবি থেকেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, দলীয় বা গোষ্ঠীগত স্বৈরাচার জন্ম নেয়। রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি, লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফিসহ সারা বিশ্বে আরও অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে সফল বিপ্লবের নেতারা বিপ্লবের মালিকানা দাবি করে স্বৈরশাসকে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশেও ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের পর নিজেকে দেশের মালিক মনে করায় স্বৈরশাসকে পরিণত হন। জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বের দাবিদার অবশ্যই ছাত্রনেতাদের, কিন্তু আন্দোলনের মালিকানা দেশের জনগণের, যারা ষোল বছরের ফ্যাসিস্ট সরকারকে হটিয়ে নির্বাচনের অধিকার ও রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে আনার দাবিতে পথে নেমেছিল। কাজেই দেশ পরিচালনায় কারা থাকবে, তা নির্ধারণের অধিকার অবশ্যই জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে। তাই নির্বাচন বিলম্বিত করার দাবির বদলে জাতীয় নাগরিক পার্টির উচিত হবে সংস্কার, গণপরিষদ গঠনসহ যে দাবিগুলো তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করতে পারলে তারা কীভাবে এ বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করবে তার বিশদ পরিকল্পনা নিয়ে জনগণের কাছে যাওয়া।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার কাজের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী যে সম্মান, মর্যাদা ও প্রভাব অর্জন করেছেন, তা বাংলাদেশের কোনো সরকারপ্রধান তো নয়ই, বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী রাষ্ট্রের সরকারপ্রধানও অর্জন করেননি। সারা বিশ্বে ব্যক্তি ড. ইউনূসের অবস্থান বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের থেকে কোনো অংশেই কম নয়। এ কারণে নির্বাচন বিলম্বিত করে ক্ষমতার মেয়াদ দীর্ঘায়িত করার কোনো ইচ্ছা ড. ইউনূসের থাকার কোনো কারণই নেই। তবে কয়েকটি মহল এ সরকারকে ব্যবহার করে প্রশাসন, রাষ্ট্রীয় অর্থ ও সরকারের নীতিনির্ধারণী ক্ষমতায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারে, যারা সংস্কার, ফ্যাসিস্টদের বিচারসহ নানা অজুহাতে নির্বাচন অনিশ্চিতভাবে বিলম্বিত করতে চাচ্ছে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার কর্তৃক দেশ পরিচালিত হবে, এটাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রথম শর্ত। কোনো দল বা মহলের যদি ক্ষমতায় যাওয়ার সাধ থাকে, তবে জনগণের রায় নিয়েই তাদের সেই সাধ পূরণ করতে হবে। তাই কোনো মহলের ষড়যন্ত্রে পড়ে নির্বাচন যাতে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময় থেকে বিলম্বিত না হয়, এজন্য অবিলম্বে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া জরুরি। এ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেশের ও বিপ্লবের মালিক জনগণকে সরকার বেছে নেওয়ার অধিকার ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করবে; একইসঙ্গে এ ঘোষণা জনগণ, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও বিভিন্ন বাহিনীসহ পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে নির্বাচনমুখী করে বর্তমান অচলাবস্থা ও অস্থিতিশীলতা নিরসনে সাহায্য করবে।
ড. এটিএম জহিরউদ্দিন : অধ্যাপক, বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
atm.jahiruddin@ba.ku.ac.bd