
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০৮:১৩ এএম
কেন যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভাঙল ইসরাইল

রবার্ট ইনলকেশ
প্রকাশ: ২৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মঙ্গলবার সকালে গাজায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভাঙে ফিলিস্তিনিদের। তারা জানতে পারে, ইসরাইলিরা যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। হামাসের পক্ষ থেকে তখন অবশ্য কোনো সশস্ত্র প্রতিক্রিয়া আসেনি, তারা কূটনীতির পথ অনুসরণের চেষ্টা চালিয়ে গেছে। উল্লেখ্য, ইসরাইল গাজায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়ার প্রথম দিন থেকেই অন্তত ১ হাজারবার তা ভঙ্গ করেছে। তারা বারবার গাজার ওপর বোমাবর্ষণ করেছে, তাদের বেশিরভাগ প্রতিশ্রুতি পালন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে এবং আবারও ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তির প্রক্রিয়া বিলম্ব করেছে। শেষ দুই সপ্তাহে ইসরাইলি দখলদার বাহিনী গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর নতুন করে হামলার আগে সেখানে সাহায্য প্রবেশের সব পথ বন্ধ করে দেয়।
এর আগে আন্তর্জাতিক চাপে অবরুদ্ধ অঞ্চলটিতে সীমিত হলেও সাহায্য প্রবেশের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছিল তেলআবিব। কিন্তু মার্চের শুরু থেকে আবারও আগের নীতি অনুসরণ করতে দেখা যায় ইসরাইলকে। যদিও তা মিডিয়ার মনোযোগ কাড়েনি। অবরুদ্ধ গাজায় মানবেতর পরিস্থিতির শিকার ফিলিস্তিনিদের কাছে কোনো সাহায্য পৌঁছানোর অনুমতি দেওয়া হয়নি। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হামাসকে যে নতুন যুদ্ধবিরতি চুক্তি গ্রহণে চাপ দিতে চেয়েছেন, সেখানে যুদ্ধ শেষ করার কোনো প্রতিশ্রুতি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। মূল যুদ্ধবিরতি চুক্তির শুরু থেকেই ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি যুদ্ধের সম্পূর্ণ সমাপ্তির জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবেন না। তবে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে তিনি সই করেছিলেন, তা কিন্তু তারই প্রতিশ্রুতি দেয়। এ কারণে নেতানিয়াহু তিন স্তরের চুক্তিতে রাজি হন। প্রথম পর্যায়ের পর তাই তিনি দ্বিতীয় পর্যায়ে দিকে আর গেলেন না।
ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর এ চুক্তি থেকে সরে আসার প্রধান কারণ হলো তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার রক্ষা করা। যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের পর নেতানিয়াহুর মন্ত্রিপরিষদ থেকে ইতারমার বেন গ্ভির পদত্যাগ করেন। ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচও হুমকি দেন, যদি চুক্তির দ্বিতীয় ধাপ কার্যকর হয়, তাহলে তিনিও পদত্যাগ করবেন। চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পাশাপাশি ইসরাইলি বাহিনীকে গাজা থেকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহারের উল্লেখ ছিল। নেতানিয়াহুর সমস্যা হচ্ছে, ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তিনি প্রায় সম্পূর্ণরূপে কঠোর ও উগ্রপন্থি বসতি নির্মাতাদের ওপর নির্ভরশীল। যদিও তাদের রাজনৈতিক পরিপক্বতার অভাব রয়েছে। রয়েছে কৌশলগত গভীরতার অভাবও, যা ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর মিত্র, গোয়েন্দা সংস্থা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেতানিয়াহু এক এক করে তার অভ্যন্তরীণ প্রতিপক্ষদের নির্মূল করেছেন। তবে শিন বেটের প্রধানকে অপসারণের প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের দ্বারা আইনগতভাবে চ্যালেঞ্জ করা হয়। অবশ্য এতেও তার বরখাস্তের প্রচেষ্টা থেমে যায়নি। তবে তা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের জন্ম দেয়। ইসরাইলের ভেতরেই তার বিরুদ্ধে সৃষ্টি হওয়া এমন সংকটময় পরিস্থিতি এড়াতে নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি শেষের ঘোষণা দিয়ে গাজা উপত্যকায় একটি বড় ধরনের বিমান হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন, যা পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৪০০ বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে। এ সময় নেতানিয়াহু তার সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের নিয়ে তেলআবিবের এক দুর্গম এলাকায় গোপন বাঙ্কারে অবস্থান নেন।
এ বিমান হামলার মাধ্যমে ইসরাইল বিশ্বকে দেখাতে বাধ্য হয়েছে যে, তারা গাজায় হামাসের কোনো সামরিক লক্ষ্য খুঁজে পায়নি, বরং সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে তাদের আক্রমণ অসংখ্য নিরীহ পরিবারকে হত্যা করেছে। ইসরাইলের অভিযানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এর কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ অভাব। যেখানে তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় হামাসকে নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে বড় অর্জনের প্রচার চেয়েছিল, সেখানে দেখা গেল দুর্ঘটনাক্রমে তারা প্যালেস্টাইনি ইসলামি জিহাদের (পিআইজে) সারায়া আল-কুদসের মুখপাত্র আবু হামজা ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে।
বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু কখনো যুদ্ধ শেষ করার প্রতি আগ্রহী ছিলেন না; বরং তিনি তার সংকুচিত ক্ষমতার বৃত্তটি আরও শক্তিশালী করার জন্য সবসময় স্থায়ী সমাধানগুলোকে বিলম্বিত কিংবা মুলতুবি রাখতে চান। তবে সাম্প্রতিক হামলা সাধারণ ইসরাইলিদেরও খুশি করতে পারেনি। বরং যখন তারা জানতে পারে, এ হামলায় হামাসের হাতে বন্দি থাকা ইসরাইলিও নিহত হয়েছে, তখন তাদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পায়। এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড প্রমাণ করছে, বাস্তবে তিনি ইসরাইল ও সিয়োনিস্ট লবির সঙ্গে নিজের অবস্থান প্রকাশের ক্ষেত্রে আরও দুর্বল। বাইডেন প্রশাসন যুদ্ধবিরতির বিষয়ে যা হোক অগ্রসর হয়েছিল; কিন্তু ট্রাম্প ইসরাইলকে গাজায় মানবিক সাহায্য চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার কথাটাও বলতে সক্ষম হননি। ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ ও ‘ভূখণ্ড সম্প্রসারণের’ মতো বিষষকে ট্রাম্প প্রশাসন বিরোধিতা করতে অস্বীকার করে।
এ পর্যায়ে আমেরিকার নিশ্চুপ থাকা, ইসরাইলের বেপরোয়া হয়ে ওঠা, সব মিলিয়ে বিশ্ব এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এমনকি ইসরাইল ও ইরানের মধ্যেও একটি সংঘর্ষের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটি হলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যই অশান্ত হয়ে উঠবে, যার জের টানতে হবে পুরো বিশ্বকেই।
দ্য প্যালেস্টাইন ক্রোনিকেল থেকে ভাষান্তরিত
রবার্ট ইনলকেশ : সাংবাদিক ও ফিলিস্তিন বিশেষজ্ঞ