
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০৪:০৬ এএম
রক্তের ইফতার : গাজার রাত ও নিঃস্ব মানবতা

পিনাকী ভট্টাচার্য
প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
রাত গভীর। গাজার আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা। বিস্ফোরণের প্রতিটি শব্দ যেন আকাশকে ফুঁড়ে চিৎকার করে জানিয়ে দিচ্ছে এখানে জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে কোনো ব্যবধান নেই। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষের আর্তনাদ বাতাসে মিশে গেছে। এক মায়ের কণ্ঠ ভেসে আসছে, আমার বাচ্চাকে বাঁচান। কেউ কি শুনতে পাচ্ছেন? কিন্তু এখানে কেউ কারও কান্না শোনে না। এখানে কান্নার চেয়ে বড় শব্দ হলো ক্ষেপণাস্ত্রের গর্জন।
ইফতারের পর ক্লান্ত শরীরে একটু বিশ্রামের আশায় যে পরিবার শুয়ে পড়েছিল, কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে তারা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। একটি শিশুর ছোট্ট হাত ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে বেরিয়ে আছে; কিন্তু তার শরীরের আর কোনো অংশ নেই। এটা যুদ্ধ না, এটা নিছক প্রতিরোধের বিরুদ্ধে লড়াই না। এটা একপাক্ষিক গণহত্যা।
ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি বলবৎ ছিল। বিশ্ব আশায় ছিল, হয়তো কিছুটা শান্তি আসবে। কিন্তু শান্তি আসেনি। বরং নতুন রক্তপাত শুরু হলো। ১৮ মার্চ রাতে কসাই নেতানিয়াহুর বাহিনী যুদ্ধবিরতি ভেঙে বেসামরিক মানুষের ওপর ভয়াবহ হামলা চালাল। এক রাতেই চারশজনের বেশি মানুষ শহিদ হলো, যাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ। যুদ্ধবিরতি নয়, বরং সেখানে আবারও নির্বিচারে বিমান হামলা চালানো হলো। এক ফিলিস্তিনি সাংবাদিক বললেন, আমি ধ্বংসস্তূপের নিচে লাশের সারি দেখেছি, কিছু লাশ এতটাই ছিন্নভিন্ন যে চেনার উপায় নেই। একটা শিশুর কেবল মাথাটুকু খুঁজে পাওয়া গেছে। এটা কি কোনো সভ্যতার পরিচয় বহন করে? গাজার শিশুরা কোথায় যাবে? সমস্ত শিশুর স্বপ্ন এখানে এক ধ্বংসস্তূপ।
একটা শিশু, নাম আমাল। তার পুরো পরিবার গতরাতে একসঙ্গে ইফতার করেছিল। সে খুব খুশি ছিল। কারণ তার বাবা বলেছিল, যুদ্ধ শেষ হলে তোমার পছন্দের খেলনাটা এনে দেব। সেই রাতেই এক বোমা এসে তাদের ঘরটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিল। আমাল বেঁচে আছে, কিন্তু তার বাবা-মা নেই। তার ছোট ভাইটি তার হাত ধরে শুয়ে ছিল, কিন্তু এখন সে নিথর। গাজার প্রতিটি শিশুই এখন এতিম। তারা আর বাবা-মায়ের গল্প শুনবে না। তারা আর স্কুলে যাবে না। তারা আর খেলতে পারবে না। তাদের জীবন এখন একটাই-জীবন থেকে পালাও।
এই বর্বরতা কি প্যারিসে ঘটলে বিশ্ব চুপ থাকত? আর যদি লন্ডন, নিউইয়র্ক বা প্যারিস, বার্লিনে এমন একটি হামলা হতো, তাহলে কি বিশ্ব এতটাই নিশ্চুপ থাকত? যদি প্যারিসের শিশুদের ওপর বোমা ফেলা হতো, তাহলে কি জাতিসংঘ শুধু নিন্দা প্রকাশ করত? যদি ওয়াশিংটনের হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে যেত, তাহলে কি বিশ্ব চুপ থাকত? যদি লন্ডন শহরে একটা স্কুলে তিনশ শিশু নিহত হতো, তাহলে কি বিশ্ব উদ্বেগ প্রকাশ করেই থেমে যেত? না, তখনই বিশ্বমানবতা জেগে উঠত, তখনই জাতিসংঘ চিৎকার শুরু করত। কিন্তু যেহেতু এ হত্যাযজ্ঞ গাজায় হচ্ছে, তাই বিশ্বের বিবেক ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু এই নীরবতা কি চিরকাল থাকবে?
একজন বাবা তার মৃত সন্তানের নিথর দেহের পাশে বসে আছে। শিশুটির হাতে আঁকা ছিল একটা ছবি। একটা সূর্য, একটা ঘর আর একটা ছোট্ট পরিবার। কিন্তু সেই ঘর এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। সেই বাবা এখন নিঃস্ব। তার অশ্রু ঝরছে না, কারণ গাজার মানুষ এত কেঁদেছে যে তাদের চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। তিনি শুধু একটাই প্রশ্ন করেছেন-কবে থামবে এই গণহত্যা? ইসরাইল কী চায়?
ইসরাইল জানে, তারা যত বেশি ফিলিস্তিনিদের হত্যা করবে, তত সহজ হবে তাদের দখলদারত্ব। প্রথমে তারা ফিলিস্তিনিদের জমি কেড়ে নিল, তারপর তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করল, তারপর তাদের খাদ্য, পানি বন্ধ করল। এখন তারা একে একে হত্যা করছে, যাতে কেউ বেঁচে না থাকে। এটা ধ্বংসের একটা পরিকল্পিত নীতি। এটাকেই বলে এথনিক ক্লিনজিং।
ফিলিস্তিন মুক্ত না হলে মানবতা মুক্ত নয়। গাজা পুড়ছে। কিন্তু শুধু গাজা নয়, এই আগুন একদিন পুরো বিশ্বকে গ্রাস করবে। আজ যদি ফিলিস্তিন মুক্ত না হয়, তাহলে মানবতা কোনোদিন মুক্ত হবে না। আজ যদি গাজার শিশুরা বাঁচতে না পারে, তাহলে পৃথিবীর কোনো শিশুই নিরাপদ নয়। আজ যদি আমরা চুপ থাকি, তাহলে একদিন আমাদের ঘরেও আগুন লাগবে। তখন কেউ আমাদের জন্য কথা বলবে না।
এখন প্রশ্ন হলো, এই হত্যাযজ্ঞ কবে থামবে? পৃথিবী কি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে? আজ গাজার রাস্তায় শিশুরা কাঁদছে, তাদের বাবা-মা মৃত। আর আমরা যারা নিরাপদ ঘরে বসে এ ঘটনা দেখছি, আমাদের কি কিছুই করার নেই? অন্তত কণ্ঠ তো তোলা যায়। বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হচ্ছে। কারণ গাজার মানুষ শুধু একটা জিনিস চায়-জীবন। গাজার আকাশে আজও আগুনের গোলা উড়ে বেড়াচ্ছে। বাচ্চারা যখন মায়ের কোল জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, তখন ইসরাইলের যুদ্ধবিমান তাদের ঘরগুলো একের পর এক মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। এই নৃশংসতা কেবল গাজার বিরুদ্ধে নয়, এটা মানবতার বিরুদ্ধে নৃশংসতা। এটা মানবতার বিরুদ্ধে এক নির্মম অপরাধ।
তাই আজ যারা আমার এই এপিসোডটি দেখছেন, তাদের সবারই মনে রাখা উচিত, গাজার মানুষ আজ আমাদের সাহায্যের জন্য চেয়ে আছে। আমরা কি চুপ থাকব, নাকি তাদের পাশে দাঁড়াব? পৃথিবীর বিবেক কি জাগবে, নাকি আরও হাজারো শিশু ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়বে নিঃশব্দে?
মাহমুদ নামের এক ছোট্ট ছেলেকে উদ্ধারকারী দল ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করেছিল। তার নিথর দেহের পাশে ছিল একটা স্কুলব্যাগ। ব্যাগের ভেতরে লেখা একটা ছোট্ট চিঠি-‘আম্মু যুদ্ধ কখন শেষ হবে? আমি কি বড় হতে পারব? আমি ডাক্তার হতে চাই।’ এ চিঠির উত্তর কে দেবে? ইসরাইল, আমেরিকা, জাতিসংঘ, নাকি সেই বিশ্ব, যারা শুধু চোখ বন্ধ করে রাখে?
মাহমুদ আর বড় হবে না। গাজার ফাতেমা আর কখনো লাল জামা পরবে না। এই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়েছে শুধু গাজার মানুষ নয়, চাপা পড়েছে বিশ্বমানবতা। যদি আজ ফিলিস্তিন মুক্ত না হয়, তবে পৃথিবীর কোনো মানুষই মুক্ত নয়। যদি এক জাতিকে নিশ্চিহ্ন করা যায়, যদি শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করা যায়, যদি কারও ভূখণ্ড দখল করে পুরো একটা জনগোষ্ঠীকে শরণার্থী বানিয়ে ফেরা যায়, আর বিশ্ব কিছুই না বলে, তবে সেই বিশ্বে একদিন কেউ নিরাপদ থাকবে না।
ফিলিস্তিনের লড়াই শুধু ফিলিস্তিনিদের নয়, এটা পুরো মানবতার লড়াই। কিন্তু একদিন সেই ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে যেদিন নতুন ফিলিস্তিন জন্ম নেবে, যেদিন প্রতিটি শহিদ শিশুর নাম স্মরণ করা হবে, যেদিন মানবতা আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে, সেদিন আমরা গলা উঁচিয়ে বলব-ফিলিস্তিন মুক্ত হয়েছে। আর সেদিনই মানবতা মুক্ত হবে। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের স্বাধীনতা অর্থহীন।
একদিন ঠিক ফিলিস্তিন মুক্ত হবে। একদিন সূর্যের, স্বপ্নের, শান্তির ভোর আসবে। একদিন পৃথিবীর মাটি, আকাশ, বাতাস মধুময় হবে। সেদিনের অনাগত প্রজন্ম আমাদের অক্ষমতাকে, আমাদের কাপুরুষতাকে, আমাদের স্বার্থপরতাকে ক্ষমা করো। হে মহান সৃষ্টিকর্তা, তুমি আমাদের ক্ষমা করো। তুমি বৃথাই আমাদের শক্তি দিয়েছিলে। এই দীনতা, এই কাপুরুষতা, এই অক্ষমতার দায় আমরা নিলাম। ফ্রি ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন। নো মোর মার্ডার, নো মোর লাইস।
পিনাকী ভট্টাচার্যের ইউটিউব চ্যানেলের সৌজন্যে
পিনাকী ভট্টাচার্য : লেখক ও ইউটিউব ইনফ্লুয়েন্সার