
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:০১ এএম
এনসিপি আহ্বায়কের বক্তব্যের পোস্টমর্টেম

সাকিব আনোয়ার
প্রকাশ: ২১ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম কয়েকদিন আগে রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, ‘এ বছর জাতীয় নির্বাচন আয়োজন সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না’। পরদিন বাংলাদেশের প্রায় সব গণমাধ্যম নাহিদ ইসলামকে কোট করে রিপোর্ট করল। অধিকাংশ রিপোর্টের হেডলাইন, ‘এ বছর (ডিসেম্বরের মধ্যে) নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়-নাহিদ ইসলাম’। একদিন পরই জাতীয় নাগরিক পার্টি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানালেন রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব নয়’-এভাবে বলেননি। এরপরই একদিন আগের রিপোর্টগুলোর (অনলাইন ভার্সনে) হেডলাইন বদলে গেল। অধিকাংশ গণমাধ্যমের রিপোর্টের হেডলাইন ‘এ বছর নির্বাচন আয়োজন কঠিন হবে’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলো। ‘স্বাধীন’ গণমাধ্যম হেডলাইন পরিবর্তন করতেই পারে। এ আলোচনায় পরে আসছি। তার আগে সেই সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতাদের (সমন্বয়ক) ‘দায়মুক্তি’ বাতিলের ঘোষণার দিকে আলোকপাত করা যাক।
সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম জানালেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি হয়েছে বলে বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক বলে যে পরিচয়টা, এখন আর এক্সিস্ট করে না সেই অর্থে। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অনুরোধ থাকবে, যদি কেউ বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক পরিচয় ব্যবহার করে অপকর্ম করে, তাহলে তারা তাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।’ তার বক্তব্য অনুসারে, যেহেতু বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক পরিচয়টা এখন আর এক্সিস্ট করে না, ফলে এখন বৈষম্যবিরোধী বা সমন্বয়ক পরিচয় ব্যবহার করে অপকর্ম করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দল গঠনের আগে পর্যন্ত যতদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির সাংগঠনিক কাঠামো (সমন্বয়ক) এক্সিস্ট করত, ততদিন পর্যন্ত এ পরিচয়ের একটা দায়মুক্তি ছিল। না হলে এ প্ল্যাটফর্ম দুটি থেকে আত্মপ্রকাশ করা দলের আহ্বায়ককে আলাদা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্দেশে একথা বলার প্রয়োজন ছিল না। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে যে কেউ কোনো অপকর্ম করলে রাষ্ট্র প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেবে, এটাই স্বাভাবিক। ফলে দল গঠনের আগ পর্যন্ত যে দায়মুক্তি ছিল, নাহিদ ইসলাম সেই দায়মুক্তি তুলে নিলেন। এজন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে হয়। কারণ এরপর থেকেই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈষম্যবিরোধী এবং সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজি, হামলা, ভাঙচুরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একইসঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং নবগঠিত ছাত্র সংগঠন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের একাধিক নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, হুমকিসহ বিভিন্ন অপকর্মের জন্য সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে সংগঠনগুলো। নাহিদ ইসলামের মন্তব্যের পরই যেন রাতারাতি দৃশ্যপট পালটে যেতে শুরু করেছে।
রয়টার্সকে দেওয়া নাহিদ ইসলামের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে ফেরা যাক। সেই সাক্ষাৎকারে তার বক্তব্য মিসকোট করা হয়েছে বলে পরদিন (শুক্রবার) বিকাল সাড়ে ৪টায় জাতীয় নাগরিক পার্টির সংবাদ সম্মেলনে জানালেন তিনি। ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে এ বছর নির্বাচন করা সম্ভব নয়, কথাটা তিনি রয়টার্সকে এভাবে বলেননি। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন সেদিনই বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে এএফপির প্রতিবেদনে নাহিদ ইসলামের আরেকটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেখানেও বলা হয়, নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, এ বছর নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়।
রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম আরও বলেছেন, ‘যদি জুলাই ঘোষণাপত্রের বিষয়ে আমরা এক মাসের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারি, তাহলে আমরা অবিলম্বে নির্বাচনের জন্য ডাক দিতে পারব’। এক্ষেত্রে নির্বাচন আয়োজনের জন্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির শর্তটি নেই। অন্যদিকে সংবাদ সম্মেলনে তিনি পতিত স্বৈরাচার হাসিনা এবং তার দোসরদের বিচারের বিষয়টিকে নির্বাচনের দিকে যাওয়ার শর্ত হিসাবে উল্লেখ করেছেন। ফলে একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বলা যায়, জাতীয় নাগরিক পার্টি চেয়েছে কোনোভাবে নির্বাচন যেন পিছিয়ে যায়।
ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশের তিন দিন আগে নাহিদ ইসলাম সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। এরও অন্তত ১৫ দিন আগে থেকেই নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল, নাহিদই হচ্ছেন নতুন দলের প্রধান (আহ্বায়ক)। সেসময়ও তিনি বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, এ ব্যাপারে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নেননি এবং দল গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে তার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যে বৈঠকে নতুন দলের প্রধান হিসাবে নাহিদ ইসলামকে মনোনীত করা হয় এবং বৈঠক সূত্র থেকে গণমাধ্যম তা নিশ্চিত করে, সেসময়ও নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা এবং তার বক্তব্য অনুযায়ী তিনি তখনো এ দলে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেননি এবং দল গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত নন। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সরকারে থাকা অবস্থায়ই তিনি প্রত্যক্ষভাবে দল গঠন প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলেন।
’২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ওপর দাঁড়িয়ে গঠিত হয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। এ দলের কাছে দেশের জনগণের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে পতিত স্বৈরাচার হাসিনার দোসরদের এ দলে পুনর্বাসন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আসছে। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় পদেও আছেন শেখ হাসিনার শাসনামলের সুবিধাভোগীরা। আগস্টের পর যখন জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করা হলো, তখন এ কমিটির সদস্যরা নিজেদের অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী হিসাবে দাবি করতে শুরু করল। অথচ এ কমিটির নেতৃত্বে এমন অনেকে ছিলেন, যারা অভ্যুত্থানের পুরো সময়টাতে দেশেই ছিলেন না কিংবা চুপ ছিলেন বা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত ছিলেন, অনেকে ছিলেন যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসাবে সংশ্লিষ্ট দলের অন্য অনেকের মতো একইসঙ্গে লড়াই করেছেন কিংবা জুলাইয়ের উত্তাল দিনগুলোর বারুদের উত্তাপ থেকে নিজেদের কিছুটা নিরাপদে রেখেছিলেন। কেউ কেউ চিন্তার অর্কেস্ট্রায় পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন। কিন্তু আগস্টের পর তারাই জাতীয় নাগরিক কমিটিতে যোগ দিয়ে নিজেদের অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী হিসাবে দাবি করছেন। এমনকি নিজে ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও অভ্যুত্থানের স্পিরিটের দাবিদার বনে যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলের ভূমিকার সমালোচনা করছেন। আর এ জাতীয় নাগরিক কমিটি থেকেই জন্ম নিয়েছে জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিট ধারণকারী ‘একমাত্র’ রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি।
নাহিদ ইসলামের আরেকটা মন্তব্য নিয়ে দুটো কথা বলে লেখাটা শেষ করব। তিনি বলেছেন, ‘‘প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস, অন্য উপদেষ্টারা এবং সেনাপ্রধান কমিটমেন্ট দিয়েছিলেন মানুষের জানমালের নিরাপত্তা এবং বিচারের দায়িত্ব তারা নিচ্ছেন। ফলে এ কমিটমেন্ট থেকে কিন্তু তারা দূরে সরে যেতে পারবেন না। জনগণের সামনে কিন্তু দাঁড়াতে হবে। ফলে আমরা কিন্তু ‘কড়ায় গণ্ডায়’ জবাবদিহিতা নেব আমাদের বিচার কতটুকু আদায় হলো। সংস্কার কতটুকু আদায় হলো।’’ বোঝা যাচ্ছে, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের ৭ মাসের কর্মকাণ্ডের ওপর সন্তুষ্ট নন। অথচ এই ৭ মাসের মধ্যে সাড়ে ৬ মাস তিনি নিজে এ উপদেষ্টা পরিষদে ছিলেন। সরকার কি নাহিদ ইসলাম পদত্যাগের পরের ১৫ দিনে ব্যর্থ হয়েছে? যদি তা না হয়, তাহলে তার কাছেও জনগণ ‘কড়ায় গণ্ডায়’ হিসাব চাইবে। তিনি নিশ্চয়ই সেই হিসাব দেবেন।
নাহিদ ইসলামকে ধন্যবাদ, কারণ তিনি নিজেকে জনগণের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তাকে ধন্যবাদ, কারণ তিনি তার বক্তব্যে প্রমাণ করেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির ইমডেমনিটি ছিল।
সাকিব আনোয়ার : রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
mnsaqeeb@gmail.com