
প্রিন্ট: ০১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৭ পিএম

ড. মাহবুব উল্লাহ্
প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67d9d55742e00-67db4a0e4948f.jpg)
আরও পড়ুন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড সোমবার ১৭ মার্চ এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা প্রধানদের একটি সম্মেলনে যোগ দিতে নয়াদিল্লি এসেছেন তুলসী। এনডিটিভিকে তিনি যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তা বাংলাদেশে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে। তুলসী গ্যাবার্ড বাংলাদেশের সমাজ ও মানুষ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা রাখেন না, এই সাক্ষাৎকারে সেটাই প্রতিভাত হয়েছে। এ সাক্ষাৎকার থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের আইডিয়োলোজিক্যাল অবস্থান সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়রের প্রশাসন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন। বুশের দৃষ্টিতে এ সন্ত্রাসবাদ ছিল ইসলামি সন্ত্রাসবাদ। সন্ত্রাসবিরোধী আমেরিকার যুদ্ধে বেশ কটি মুসলিম দেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া ও সোমালিয়া। নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যে সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়, তাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার নিরাপত্তার নামে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামি সন্ত্রাস দমনে একটি ক্রুসেড পরিচালনা করেছে। প্রেসিডেন্ট বুশ উচ্চারিত ক্রুসেড শব্দটি পরে উচ্চারিত না হলেও এর মধ্য দিয়ে বুশ প্রশাসনের মাইন্ডসেট আমরা বুঝতে পারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সেরা সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত। কিন্তু যখন একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ক্রুসেড চালানোর ঘোষণা দেন তখন বুঝতে কষ্ট হয় না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেক্যুলারিজম ঠুনকো একটি বিষয় ছাড়া আর কিছু নয়।
পৃথিবীতে তিনটি রাষ্ট্র ‘জাতীয় নিরাপত্তা রাষ্ট্র’ হিসাবে পরিচিত। এ রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও ভারত। একটি রাষ্ট্র যখন নিজেকে জাতীয় নিরাপত্তা রাষ্ট্র হিসাবে ধারণা করে, তখন বুঝতে হবে, সেই রাষ্ট্রের সমুদয় কার্যকলাপ তথা কথিত জাতীয় নিরাপত্তা বিবেচনার অধীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি মনে করে, পৃথিবীর কোনো বিন্দুতে তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মতো আশঙ্কা রয়েছে, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে অসামরিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ চালাতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ একচোখা নিরাপত্তানীতির বিরোধিতা কোনোক্রমেই সহ্য করা হয়নি। এ ধরনের নিরাপত্তানীতির পেছনে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স। মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের ধারণাটি তুলে ধরেছিলেন এক সময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি আইজেনহাওয়ার। আইজেনহাওয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আটলান্টিকে মার্কিন নৌ-কমান্ডের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করে। এ কমপ্লেক্সের লক্ষ্য হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সবসময় যুদ্ধের মধ্যে রাখা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যদি প্রতিনিয়ত যুদ্ধের মধ্যে রাখা সম্ভব হয়, তাহলে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স যে যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবসা করে, সেই ব্যবসা রমরমা হয়ে উঠবে। মজার ব্যাপার হলো, কোনো যুদ্ধেই দেশটি শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারেনি। তবুও যুদ্ধ করতে হবে। নানা উছিলা ও অজুহাতে যুদ্ধের ময়দান খুঁজে পেতে হবে। তা না হলে সেরকম একটি ময়দান তৈরি করতে হবে।
বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু নির্যাতন’ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের একটি মূল জায়গাজুড়ে রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন দেশটির গোয়েন্দাপ্রধান তুলসী গ্যাবার্ড। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন সারাবিশ্বে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসবাদের ওপর নজর রাখছে এবং একে পরাজিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানিয়েছেন তুলসী গ্যাবার্ড। তুলসী গ্যাবার্ডের উক্তি থেকে মনে হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসলামি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে কিছুটা বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার সেই যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে। অভিযোগ আছে, যাদেরকে সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, যেমন ধরুন ইসলামি স্টেট, যারা ইরাকের একটি বড় অংশ দখলে নিয়েছিল, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরই সৃষ্টি। এর সত্যাসত্য নির্ণয় করা কঠিন। তবে তারা যেমন মারণাস্ত্র ও যানবাহন ব্যবহার করত, সেগুলো ছিল তকতকে ঝকঝকে। এ থেকে অনুমান করা হয়, এসব অস্ত্রের সরবরাহকারী কোনো বড় শক্তি। ইসলামি স্টেটের লক্ষ্য ছিল ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা। ‘ইসলামি খেলাফতে’র আদর্শ নিয়ে কথা বলেন তুলসী গ্যাবার্ড। উগ্রপন্থি উপাদান ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো বৈশ্বিকভাবে কেমন করে এ ধরনের একটি পরিস্থিতি তৈরির লক্ষ্যে কাজ করে, তা নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। তুলসী গ্যাবার্ড বলেন, ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীদের হুমকি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বৈশ্বিক তৎপরতা একই আদর্শ ও লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হয়। সেই আদর্শ ও লক্ষ্য হলো ইসলামপন্থি খেলাফতের মাধ্যমে শাসন করা। এটা অবশ্যই তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছাড়া অন্য যে কোনো ধর্মের মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে। তারা এই আদর্শ সন্ত্রাস ও অন্যান্য সহিংস পন্থায় বাস্তবায়নের পথ বেছে নেয়। এ প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মনে প্রশ্ন জাগে, যে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে তুলসী গ্যাবার্ড এ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সে দেশ তথা ভারতে সংখ্যালঘু জনগণের অবস্থাটা কী? সে দেশে এখন মুসলমানরা ভারতের সন্তান নয় বলে গণ্য হয়। মুসলমানদের শতাধিক প্রাচীন মসজিদ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মুসলমানদের গো-মাংস রাখার অভিযোগে খুন করা হচ্ছে। মুসলমানদের বাধ্য করা হচ্ছে ‘শ্রীরাম’ বলে জয়ধ্বনি করতে। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মাজার ধ্বংসেরও মহড়া হয়েছে। এ সবকিছু কি তুলসী গ্যাবার্ডের বিবেচনায় এলো না? তুলসী গ্যাবার্ডের মতো গোয়েন্দাপ্রধান কি বুঝতে পারেন না ভারতে যা কিছু হচ্ছে তার একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়া আশপাশের মুসলিম দেশগুলোতেও হতে পারে? ভারতে যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস চলছে, তুলসী গ্যাবার্ড তার প্রতি চোখ বুজে থাকবেন। কারণ, তাদের দৃষ্টিতে ভারত হলো দক্ষিণ এশিয়ার স্বাভাবিক নেতা। অথচ এই ভারত এখন আর দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে ওয়েলকাম নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দল নির্বিশেষে সবার ভারতের প্রতি অন্ধ প্রশ্রয় আখেরে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও সুফল বয়ে আনবে না।
এনডিটিভি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড বলেন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, ক্যাথলিক ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলমান দুর্ভাগ্যজনক নিপীড়ন, হত্যা ও অন্যান্য নির্যাতন যুক্তরাষ্ট্র সরকার, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার প্রশাসনের উদ্বেগের একটি প্রধান ক্ষেত্র। ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন মন্ত্রিসভা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন তুলসী গ্যাবার্ড। বাংলাদেশে ইসলামি চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদী উপাদানের উত্থান নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন মন্ত্রিসভা ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে আলোচনা মাত্র শুরু হচ্ছে; কিন্তু এটি উদ্বেগের মূল জায়গার একটি হয়ে রয়েছে। স্পষ্টত এটা প্রতীয়মান হয় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ কোনো দেশ নয়। তবে তুলসী বিষয়টিকে দীর্ঘদিন ধরে চলমান একটি বিষয় হিসাবে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই নয়, তার পূর্ববর্তী সরকারগুলোর আমলে সংখ্যালঘুরা একইভাবে নিপীড়িত হয়েছে। ৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পর ভারতীয় মিডিয়া শোরগোল তুলেছিল এবং এখনো তা অব্যাহত রেখেছে, তা হলো অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে হিন্দু সম্প্রদায় নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। বিষয়টিকে এভাবে দেখা যায় না। কারণ, ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর শুধু হিন্দুদের ঘরবাড়ি নয়, তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি মুসলমানের ঘরবাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। তার কারণ মূলত রাজনৈতিক। যারা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার সহযোগী ছিল, ধর্ম নির্বিশেষে তাদের অনেকেই গণরোষের শিকার হয়েছেন। এমনটি কাম্য না হলেও অনেক সময় প্রচণ্ড ক্ষোভের কারণে ঘটে থাকে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন এবং ইসলামি খেলাফতকে কেন্দ্র করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড যে মন্তব্য করেছেন, তার প্রতিবাদ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকার সোমবার ১৭ মার্চ এক বিবৃতিতে জানায়, ‘আমরা গভীর উদ্বেগ ও হতাশার সঙ্গে তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্য লক্ষ করেছি, যেখানে তিনি বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ‘নিপীড়ন ও হত্যা’ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে বলেছেন, ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীদের হুমকি এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর বৈশ্বিক তৎপরতা একই আদর্শ ও লক্ষ্য দ্বারা পরিচালিত হয়। সেই আদর্শ ও লক্ষ্য হলো ইসলামপন্থি খেলাফতের মাধ্যমে শাসন করা।’ তুলসী গ্যাবার্ডের এই মন্তব্য বিভ্রান্তিকর এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনামের জন্য ক্ষতিকর উল্লেখ করে অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে, ‘বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইসলাম চর্চার জন্য সুপরিচিত এবং চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।’
আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের এ অবস্থানকে সঠিক ও দ্ব্যর্থহীন বলে মনে করি। বাংলাদেশে ইসলাম চর্চার মৌল রূপটি রেডিক্যাল নয়, বরং এটি লিবারেল ইসলাম। বাংলাদেশের জনগণ ইসলামের সহনশীলতা ও সৌভ্রাতৃত্বের নীতিতেই বিশ্বাসী। এর ব্যতিক্রম যদি কিছু ঘটে, সেটা ব্যতিক্রম রূপেই বিবেচিত হওয়া উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও কু ক্লাক্স ক্লান নামক গোষ্ঠী ছিল, সেখানেও কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিল। তাই বলে কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক নয়?
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ