Logo
Logo
×

সম্পাদকীয়

হাসিনা-ভারত অন্তরঙ্গতা: যে কায়দায় ‘বাংলাদেশ প্রকল্পের' লভ্যাংশ হাতায় উভয়েই

Icon

খাজা মাঈন উদ্দিন

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০২:৩৫ পিএম

হাসিনা-ভারত অন্তরঙ্গতা: যে কায়দায় ‘বাংলাদেশ প্রকল্পের' লভ্যাংশ হাতায় উভয়েই

ভারতের নরেন্দ্র মোদি এবার কাঁদুনে ছেলের মতো হাজির হলেন মার্কিন মুল্লুকের নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের দরবারে। উদ্দেশ্য ছিল প্রিয় বন্ধুকে জানানো যে তার সরকার কতই না উদ্বিগ্ন বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে।

এই বাংলাদেশ এখন দিল্লির বিশেষ আনুকূল্য পাওয়া শাসকবিহীন 'পর হয়ে যাওয়া' এক প্রতিবেশী দেশ। ছাত্র-গণ-বিস্ফোরণে ক্ষমতাচ্যুত, বাস্তুচ্যুত শেখ হাসিনা-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ।

দুনিয়া দেখল- কী চাঁছাছোলা উচ্চারণে এক ভারতীয় গণমাধ্যম প্রতিনিধি দিল্লির উদ্বেগকে প্রকাশ করলেন ট্রাম্প-মোদির যৌথ ব্রিফিংয়ে। ১৩ ফেব্রুয়ারি হোয়াইট হাউজের ওই অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞাসা করা হলো, বাইডেন প্রশাসনের আমলে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনে আমেরিকার 'ডিপ স্টেট'-এর 'প্রমাণিত' ভূমিকা নিয়ে তার মন্তব্য কী?

'ডিপ স্টেট'-এর বিরুদ্ধবাদী ট্রাম্প কিন্তু মুখের ওপরই অস্বীকার করলেন অমন অভিযোগ। তাতে যে মোদিও নিরুত্তর রইলেন, জনসমক্ষে বলে কথা!

তব মোদির দিকে ইশারা করে ট্রাম্পের জবাব ‘বাংলাদেশ (ইস্যু)-টিকে আমি (ভারতীয়) প্রধানমন্ত্রীর ওপর ছেড়ে দিচ্ছি’, বেশ কিছু বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সফরকারী ভিনদেশপ্রেমিকদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ এনে দিল। এরা প্রায় ১৯০ দিন ধরে বড়ই দুঃখিত ছিল কর্তৃত্ববাদী হাসিনার বিদায়ে।

এই আফসোসকারী গোষ্ঠীর বিশ্লেষণ এমন যে ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির দায়িত্ব দিয়েছেন ভারতকে, যে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের নেত্রী হাসিনা এবং তা-ও আবার ৫ আগস্ট বিপ্লবী জনতার রোষানল থেকে বাঁচতে পালিয়ে গিয়ে।

তাই যখন তারা বিশ্বাস করতে চায় যে আমেরিকার অনুমোদনে ভারতের প্রযোজনায় হাসিনা আবারো ক্ষমতাসীন হচ্ছেন, তাদের অতি উৎসাহী আচরণ বিদেশি শক্তির প্রতি রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দাসত্বই প্রমাণ করে; অন্যদিকে হাসিনাকে হঠানো কোটি বাংলাদেশির অনেকেই ক্রোধ আর বিদ্রুপের প্রতিক্রিয়া দেখায় সামাজিক মাধ্যমে।

৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে ছাত্রদের উদ্দেশে ফেসবুকে প্রচারিত হাসিনার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়াও আমরা দেখলাম। মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হলো ১৯৬০-এর দশকে হাসিনার পিতা শেখ মুজিবর রহমান-নির্মিত ধানমন্ডি ৩২-এর ভবনটিকে।

প্রতিবাদকারীরা ওই ভবনটিকে আখ্যা দেন হাসিনার ফ্যাসিবাদের আইকন হিসেবে; যে হাসিনা তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার বাসনায় শুধু জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ হাজারের অধিক এবং অতীতে আরো অনেক মানুষ হত্যা করেছেন। 

তাই হাসিনাকে তো ইতোমধ্যেই অপরাধীর বহিঃসমর্পণ চুক্তির আওতায় ঢাকায় ফেরত পাঠানো উচিত ছিল, যাতে গণহত্যা ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে এবং শত বিলিয়ন ডলার জনগণের অর্থ চুরি ও পাচারের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করা যায়। এ রকম একজন অপরাধীকে ভারত প্রথমে থাকার জায়গা দিল এবং এরপর উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া ও কথোপকথনের সুযোগ দিল।

হাসিনার ভারতে অবস্থান নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসের সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল ‘হাসিনাকে চুপ করে থাকতে হবে’।

প্রস্থানের ঠিক ছয় মাস পর প্রথম আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে তার কোনো অপরাধ বোধের বিন্দুমাত্র লক্ষণ ছিল না। যেন দেড় দশকের শাসনকালে তিনি খুনের মতো কোনো অপরাধই করেননি।

ভারতও কোনো সংকোচ দেখায়নি যে কেন একজন পলাতক হাসিনাকে বক্তৃতা দেওয়া থেকে নিবৃত করা হলো না- বিশেষ করে তার ভারতে অবস্থানকে যখন আইনগত এবং কূটনৈতিক বিবেচনায় বৈধ বলা দুষ্কর। ভারতীয় কর্মকর্তারা খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে বললেন যে, তিনি ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে মন্তব্য করেছেন। তার কাছে যেমন বাংলাদেশের বৈধ পাসপোর্ট নেই, না ভারত তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। তাহলে?

একসময় বাংলাদেশে কর্মরত বর্তমানে অবসরে থাকা ভারতীয় কূটনীতিকরাও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখাতে পারেননি। তারা হাসিনা আমলের মানবাধিকার লংঘনের নিন্দা করেছেন বলে কখনো শুনিনি; বরং তাদের সরকার প্রকাশ্যে, গোপনে হাসিনা সরকারকে সমর্থন যুগিয়েছে।

সেই হাসিনার শাসনামলে দিল্লির নির্বিঘ্ন অর্জন ছিল অগণিত। ট্রানজিট সুবিধা থেকে একচ্ছত্র বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক লাভ,  উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তা গ্যারান্টি থেকে ভারতীয়দের উচ্চ বেতনের চাকুরির নিশ্চয়তা, এবং রাজনৈতিক আধিপত্য থেকে বাংলাদেশকে তাবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করা- কী না? বিনিময়ে হাসিনা পেয়েছিলেন ক্ষমতায় থাকার আশীর্বাদ এবং যা খুশি তা-ই করার লাইসেন্স।

‘স্বর্গ’ থেকে হাসিনার পতন দিল্লির জন্য সারা বিশ্বে ছিল এক জনসংযোগ বিপর্যয়। ভারতের পররাষ্ট্রনীতির দুর্বলতা এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে ভয়াবহ অদূরদর্শিতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় জুলাই-আগস্ট বিপ্লব।

ভারত-বাংলাদেশে কতটা পছন্দনীয় সাম্রাজ্য সেটা পরীক্ষা করতে আগামী সংসদ নির্বাচনে ভারতপন্থী প্রার্থী বা দল কতগুলো আসন বা ভোট পায় তা দেখলেই বোঝা যাবে।

তার আগ পর্যন্ত দিল্লি এমন কোনো প্রামাণ রাখেনি যাতে বোঝা যায় ভারত বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী। ভারতের মাটিতে সন্দেহজনক কার্য পরিচালনার অনুমতি পাওয়া আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তিন তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ডাকাতি করে জিতেছিলেন।

মনে হয় যেন দহরম মহরম থাকা সত্ত্বেও ভারত সরকার ঘুনাক্ষরেও জানতো না যে হাসিনা নিজে গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকারীদেরকে গুলি করে মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন। অবশ্য ফ্যাসিবাদী শাসনের শেষ দিনগুলোয় নিষ্ঠুরতার ওপর জাতিসংঘের সর্বসাম্প্রতিক রিপোর্ট বলেছে ভিন্ন কথা -- হাসিনা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত।

দিল্লির নীতি ব্যর্থতা কিংবা দেশে বিদেশে সমালোচনা এবং মানুষ হাসিনাকে পুতুল শাসক মনে করলেও, ভারত হাসিনা থেকে এবং হাসিনা ভারত থেকে দূরে সরে যায়নি কোনদিন। ভেবে দেখেছেন, কেন?

১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিবেশীর সহযোগিতা গ্রহণ করে বাংলাদেশ যদি হয়ে থাকে দিল্লির নব্য বিনিয়োগ ক্ষেত্র, তাহলে ভারতের সবচাইতে নির্ভরযোগ্য কৌশলগত মিত্র হিসেবে সেবা করেছেন কে?

এ প্রসঙ্গে একই ব্যক্তির দুটি উক্তি স্মরণ করে দেখি- ‘আমার বাবা এই দেশ স্বাধীন করেছেন...' এবং 'ভারতকে আমি যা দিয়েছি, তা কোনোদিন ভুলতে পারবে না।... আমি দিই বেশি, নিই কম।'

সুতরাং বাংলাদেশি স্বৈরশাসকের কাছ থেকে প্রায় সবকিছু নেবার পরও ভারত যে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি, তাতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কিছুটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। কিন্তু হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত এটাও বুঝিয়ে দিলো দিল্লি হাসিনার 'শেয়ার' পুরোপুরি ছেড়ে দিতে নারাজ। বলা তো যায় না যদি আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে তাকে প্রয়োজন হয়।

সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যক্রমে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে সভ্য বিশ্বের উন্নত জ্ঞান ও আচরণ বিধির আলোকে কিছু কিছু নেতা ও জাতির মনোভাব ব্যাখ্যা করা মুশকিল।

ভারত দাবি করতেই পারে তার পররাষ্ট্রনীতি অতুলনীয়, বিশেষ করে যখন দিল্লি শক্তিশালী দেশের সঙ্গে আঁতাত করতে চায় আর ক্ষুদ্র দেশকে শক্তি প্রদর্শন করে।

এটা কার্যকর হলে তো ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির খাতির কেন ভারতীয়দের আমেরিকা থেকে ফেরত পাঠানো আটকাতে পারল না?

চানক্য কৌটিল্যার কূটনীতি অন্ধভাবে অনুসরণ করে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশেরও বন্ধুত্ব অর্জন করতে পারেনি। কৌটিল্যা জীবিত থাকলে হয়তো বাংলাদেশকে শত্রু রাষ্ট্রই ভাবতেন।

বাংলাদেশের মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ভাবধারা পুরোপুরি জেনেই বোধ হয় দিল্লি হাসিনাকে লালনপালন করতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছিল। ১৯৭৫-এর আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনে তার পিতাসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা নিহত হলে তিনি ভারতেই আশ্রয় পান এবং সেখান থেকেই ১৯৮১ সালে দেশে ফিরেন।

হাসিনা ক্ষমতায় এলে ভারত ব্যাপকভাবে উপকৃত হয় এবং সেটা হাসিনার এমন এক বিনিয়োগ ছিল যার ফলে  ভারত দুর্নাম হজম করেও আবারো তাকে আশ্রয় দেয়, যখন তার দরকার ছিল সবচেয়ে বেশি।

যেহেতু গণতান্ত্রিক দেশ হওয়া সত্ত্বেও ভারত হাসিনার অগণতান্ত্রিক নীতি ও কার্যকলাপের প্রশ্রয় দেয়, সেহেতু হাসিনাও স্বতস্ফূর্তভাবে ভারতের সেবাদাস শাসকে পরিণত হন। তাই, বাংলাদেশের জনগণ  তাকে যতই ঘৃণা করুক, ভারত তাকে খোশ আমদেদ বলতে দ্বিধা করেনি, তার পতনের পরও।

যাহোক পররাষ্ট্রনীতি বিষয়টি দুই ব্যক্তির প্রেম ভালোবাসার সঙ্গে তুলনীয় নয়। তারপরও ভারতীয় নেতৃত্ব হয়তো মনে প্রাণে বিশ্বাস করে হাসিনার মতো ভারতের স্বার্থের প্রতি অনুগত আর কাউকে তারা খুঁজে পাবে না বাংলাদেশে।

লেখক: সাংবাদিক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম