Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শতফুল ফুটতে দাও

এই চাপ কীভাবে সামলাবে ভারত

ড. মাহবুব উল্লাহ্

ড. মাহবুব উল্লাহ্

প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এই চাপ কীভাবে সামলাবে ভারত

ছবি: ইন্টারনেট

৫ আগস্ট ২০২৪ শেখ হাসিনা ভারতে দেশান্তরী হলেন। এছাড়া তার আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। প্রথমে মনে হয়েছিল তিনি ভারত ছাড়া অন্য কোনো দেশে থাকার চেষ্টা করবেন। পাশ্চাত্যের কোনো উন্নত দেশ তাকে আশ্রয় দানে অস্বীকার করে। এমনকি রাশিয়ার স্যাটেলাইট নামে পরিচিত বেলারুশেও তার আশ্রয় হয়নি।

শোনা যায়, বেলারুশে শেখ হাসিনার বেনামে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা আছে। সেখানে তিনি নাকি একটি ফাইভ স্টার হোটেলের মালিক। বাংলাদেশিরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রাশিয়াতে তো বটেই। বেলারুশেও অনেক বাংলাদেশি ব্যবসা ও কাজের জন্য ঠাঁই নিয়েছেন। শেখ হাসিনার কথিত মালিকানার হোটেলটিতে কিছু বাংলাদেশিও কর্মরত রয়েছেন বলে জানা গেছে।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বেলারুশ সফর করেছেন। তার সেই সফরের সময়ই আড়ালে-আবডালে কথা উঠেছিল দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ-সম্পদ নিরাপদে রাখার জন্যই বেলারুশকে তিনি বেছে নিয়েছেন। বেলারুশ দেশ হিসাবে বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবুও বেলারুশের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক স্থাপনের পেছনে রয়েছে বিশেষ কারণ। মনে করা হয়, এ বিশেষ কারণটি হলো অসৎ উপায়ে অর্জিত ধন-সম্পদ নিরাপদে রাখা। আজ পর্যন্ত ৫ আগস্টের ঘটনাবলি সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে, তার মধ্যে রয়েছে শেখ হাসিনার জন্য একটি সেফ এক্সিটের ব্যবস্থা করা। বিষয়টি সামরিক কর্তৃপক্ষের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।

শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন নিরাপত্তা বাহিনীগুলো আরও দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। এ সময় তিনি পুলিশ বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। পুলিশ বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি চালাতে সামান্যতম দ্বিধাবোধ করেনি। এ কারণেই শেখ হাসিনা পুলিশ বাহিনীর প্রশংসা করে অন্য বাহিনীগুলোকেও একই পন্থা অবলম্বনের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন।

কিন্তু ততক্ষণে অতিরিক্ত দমনপীড়ন চালানো অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। লাখ লাখ মানুষের মিছিল ধেয়ে আসছিল গণভবনের দিকে। পুলিশের তাজা বুলেট ও টিয়ার শেল উপেক্ষা করে। শেখ হাসিনাকে জানানো হয়েছিল ৪৫ মিনিটের মধ্যে তাকে দেশ ত্যাগ করতে হবে এবং প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে। প্রথমে শেখ হাসিনা কোনোটিতেই রাজি ছিলেন না। তারপর তার ছেলে সজীব ওয়াজেদের মধ্যস্থতায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তবে তার ছেলে জয়ও আলোচনার শুরুতে চরম ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছিলেন। তিনি বলেছেন, তার মা সামরিক কর্মকর্তাদের ওপরের দিকে টেনে উঠিয়েছেন। তাদের কৃতকর্মের জন্য তাদেরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। তবে যখন বুঝতে পারলেন তার মায়ের জন্য দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া ব্যতীত আর কোনো বিকল্প নেই, তখন তিনি তার মাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে সম্মত করান।

সেদিন সামরিক কর্মকর্তারা এক ভয়াবহ ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। শেখ হাসিনা গণভবনে থাকা অবস্থাতেই যদি অপ্রতিরোধ্য জনতা গণভবনে ঢুকে পড়ে, তাহলে শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। সামরিক কর্মকর্তারা বোধহয় একটি খুনের দায় নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এ কারণেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাকে ভারতে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। শেখ হাসিনাকে গ্রহণ করতে ভারত সরকারকে রাজি করানো হয়।

ভারত সরকারও দেখল ভারতের এ অকৃত্রিম বন্ধুর পাশে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সমঝোতার ভিত্তিতে শেখ হাসিনা দিল্লির নিকটবর্তী সামরিক বিমানক্ষেত্র হিন্দানে একটি বাংলাদেশি মালবাহী বিমানে করে পৌঁছে যান। জনান্তিকে কথা উঠেছিল, তিনি ১৪টি সুটকেস ভর্তি করে মূল্যবান ধন-সম্পদ সঙ্গে করে নিয়ে যান। ভারত সরকার তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ভারতে বসে শেখ হাসিনা বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় নিমগ্ন রয়েছেন। একের পর এক তিনি বিবৃতি দিয়ে চলেছেন যে, তাকে অন্যায়ভাবে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে। তিনি ভারতে বসে বসে দেশের ভেতরে তার অনুসারীদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে অনুপ্রাণিত করছেন।

এমনকি বাংলাদেশের ভেতরে নানারকম আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছেন। শত-সহস্র মানুষ হত্যা করে এবং কয়েক হাজার মানুষকে আহত করার পরও শেখ হাসিনার মধ্যে ন্যূনতম অনুশোচনা নেই। তার অনুসারীরা সামাজিক মাধ্যমে চরম বিভ্রান্তিকর গল্প কাহিনি প্রচার করে চলেছে। তারা বলতে চাইছে নেশার ওষুধমিশ্রিত পানি পান করিয়ে আন্দোলনকারীদের দ্বিধাহীনভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার নেশায় ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। লাখ লাখ মানুষকে এভাবে নেশার পানি কি পান করানো সম্ভব? অথচ এ ধরনের আজগুবি ও বিভ্রান্তিকর প্রচারণা অব্যাহত আছে। শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গাতদের অর্থের কোনো অভাব নেই। ব্যাংক থেকে লুট করা টাকা, মেগা উন্নয়ন প্রকল্প থেকে হাতিয়ে নেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা তাদের নিয়ন্ত্রণ ও দখলে রয়েছে। এই টাকা একদিকে ব্যবহৃত হচ্ছে আওয়ামী কুশীলবদের ভারতে বিলাসপূর্ণ জীবনযাপনের জন্য এবং অন্যদিকে বাংলাদেশকে অস্থির করে তুলতে, যাতে বাংলাদেশ শেখ হাসিনার নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ট্রমা থেকে উঠে দাঁড়াতে না পারে। লোকে বলে শেখ হাসিনার মুখটিই নাকি তার প্রধান শত্রু। অথচ তিনি কোনোমতেই মুখ সামলাবেন না। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস তাকে চুপ থাকতে বলেছেন। অথচ তিনি আদৌ চুপ থাকছেন না।

এমন কোনো দিন নেই, যখন শেখ হাসিনার মুখনিঃসৃত বিষাক্ত তীর বাংলাদেশকে বিদ্ধ করছে না। ভারত সরকারের মুখপাত্র বলছে, শেখ হাসিনার কথাবার্তার দায় ভারত সরকারের নয়। তারপরও শেখ হাসিনা কথা বলেই চলেছেন। ভারত সরকারের যদি সায় না থাকে, তাহলে শেখ হাসিনা কী করে নির্বিবাদে তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন! শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ড ভারত ও বাংলাদেশের পারস্পরিক সম্পর্ককে বিষিয়ে তুলছে। যতদিন শেখ হাসিনা ভারতের আশ্রয়ে থেকে বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা অব্যাহত রাখবে, ততদিন দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার অবনতিশীল সম্পর্ক উন্নতির পথ দেখবে না।

জুলাই গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে ভারতের ওপর নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে। আগামী দিনে ভারতের ওপর এ চাপ অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকবে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা। জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর হাসিনা সমর্থকদের হাসিনাকে সমর্থন দেওয়ার সুযোগ অনেকটাই সংকীর্ণ হয়ে গেছে। শেখ হাসিনা সম্পর্কে এ রায় যদি বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে আসত, তাহলে বলার সুযোগ থাকত এই রায় বিদ্বেষ ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপ্রসূত।

এখন জাতিসংঘের প্রতিবেদনের পর অন্য কিছু বলার সুযোগ নেই। শেখ হাসিনাকে বিশ্বস্বীকৃত সংস্থা জাতিসংঘ অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে এবং নিশ্চিতভাবেই কাজটি করেছে। শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘ কর্তৃক খুনি হিসাবে চিহ্নিত করার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ‘আমরা শেখ হাসিনা এবং তার সহযোগীদের ফিরিয়ে এনে গণহত্যার দায়ে বিচার করব’। অর্থাৎ ভারতকে এখন বিচারের জন্য হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে হবে।

জাতিসংঘের রিপোর্ট প্রকাশের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে বিচারের জন্য শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠান, গণহত্যার দায়ে তার বিচার হতে হবে। জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও জুলাই গণহত্যার দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা যেন কোনোক্রমেই দায়মুক্তি না পায়।

জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জাতিসংঘ কর্তৃক গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট গত ১২ ফেব্রুয়ারি জেনেভায় জাতিসংঘ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে জুলাই হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা হিসাবে ভারতের আশ্রয়ে থাকা বিতাড়িত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দায়ী করে বলা হয়েছে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনা, নির্দেশনা এবং সমন্বয়ের মাধ্যমে জুলাই গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের বিক্ষোভ দমনে হত্যার নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, বিক্ষোভকারী ছাত্রদের গুলি করে হত্যার পর তাদের লাশগুলো গুম করে ফেল। জুলাই অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে। জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুযায়ী, কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১৩ ভাগ শিশু। আহতের সংখ্যা হাজার হাজার। জাতিসংঘের এ রিপোর্টের পর হাসিনাকে ফেরত না দিলে জুলাই গণহত্যার নৈতিক দায় ভারতকে নিতে হবে, বলেছেন রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক জুলাই গণহত্যার তদন্তের জন্য গঠিত ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে জুলাই বিক্ষোভ দমনে যে ধরনের হত্যাকাণ্ড এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে বিবেচিত। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। কেউ যেন দায়মুক্তি না পায়। পরিশেষে বলতে হয়, বাংলাদেশে জুলাই গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের রিপোর্ট প্রকাশের পর দেশের ভেতরে শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের গণহত্যার দায়ে বিচারের মুখোমুখি করা নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার পথ অনেকটা নিশ্চিত হয়েছে। একইসঙ্গে বলা যায়, ভারত শেষ পর্যন্ত বাধ্য হবে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে। বাংলাদেশের মাটিতে তার বিচার অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম