একুশের চেতনায় আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান

রবিউল ইসলাম
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67b50b9a5565d.jpg)
ছবি: সংগৃহীত
ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল। কিন্তু বাঙালি সেই ইতিহাস রচনা করেছে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। সেদিন ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের রক্তে যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল, তা শুধু একটি ভাষার মর্যাদার লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটি পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্মদাতা, স্বাধীনতার স্বপ্নের বীজ এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রার প্রেরণা। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তঝরা পথে শুরু হওয়া এই যাত্রাই পরবর্তীকালে ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছে। প্রতিটি সংগ্রামে ছাত্ররা শুধু অংশগ্রহণই করেনি, নেতৃত্ব দিয়েছে-প্রাণ দিয়ে রচনা করেছে বিজয়ের ইতিহাস। এ ধারাবাহিকতাই প্রমাণ করে, বাঙালির জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের চেতনার মূলে রয়েছে ছাত্রদের সেই অদম্য শক্তি, যা আজও প্রজ্বলিত।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দাসত্বের শৃঙ্খল। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা ছিল সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ। কিন্তু ছাত্ররা বুঝতে পেরেছিল, ভাষা হারালে জাতিসত্তাই বিলীন হয়ে যাবে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল বের করেছিল তারা। পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিলেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার। তাদের রক্তে লাল হয়েছিল রাজপথ। তবে তাদের এ আত্মত্যাগ বিদ্রোহের সূচনা করেছিল। ভাষা আন্দোলন বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ছাত্রদের এই আত্মত্যাগই পরবর্তীকালে স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতন্ত্রের সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি করেছিল।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের রাজনীতির মঞ্চে ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক ঘটনা। দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটিয়ে ছাত্ররা আবারও প্রমাণ করে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজও তাদের রক্তে স্পন্দিত। এ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল কোটা সংস্কারের দাবিতে; কিন্তু তা দ্রুত রূপ নেয় স্বৈরাচারবিরোধী গণজাগরণে। ছাত্ররা শহিদ মিনারে জড়ো হয়ে শপথ নিয়েছিলেন এবং শেখ হাসিনার পতনের একদফা দাবি পেশ করে ‘লংমার্চ টু ঢাকা’র ঘোষণা দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা সরকারের নিপীড়নমূলক নীতির বিরুদ্ধে তারা একত্র হয়েছিলেন, ঠিক যেমন ১৯৫২-এ ভাষার অধিকারের দাবিতে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। পুলিশের গুলি, লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস কিংবা ইন্টারনেট সেবায় নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও একদিকে যেমন আন্দোলনকারীরা রাজপথে নিজেদের প্রাণ হাতে নিয়ে নেমেছিল, তেমনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেছিল ডিজিটাল প্রতিরোধ। বিভিন্ন হ্যাশট্যাগে ভর করে বিশ্বজুড়ে শেখ হাসিনার ছাত্র-শিশুসহ আন্দোলনকারীদের হত্যার ভিডিও ফুটেজ ছড়িয়ে দিয়েছিল। ফলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও এ আন্দোলনকে গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে এবং নিন্দা জানাতে থাকে। ৫ আগস্ট, যখন লাখো ছাত্র-জনতা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও করে, তখন শেখ হাসিনার পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। এ বিজয় ছিল কেবল একটি সরকারের পতন নয়-এটি ছিল ১৯৫২-এর সেই ছাত্রদের অঙ্গীকারের পুনরুজ্জীবন, যারা প্রাণ দিয়ে গিয়েছিলেন বাংলা ভাষার মর্যাদার জন্য। ২০২৪-এর ছাত্ররাও প্রমাণ করেছেন, ঐক্যবদ্ধ ছাত্রশক্তি রাষ্ট্রযন্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। কিন্তু আমাদের জন্য এটি কেবল একটি দিন নয়-এটি হৃদয়ে ধারণ করার আদর্শ। ১৯৫২-এ ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল মাতৃভাষার জন্য, ২০২৪-এ তারা লড়েছে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য। এ সময়ে আমাদের কর্তব্য হলো ইতিহাসের সেই শিক্ষাকে জাগ্রত রাখা। বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ই বলে-ছাত্ররা যখন জেগে ওঠে, তখন সব অন্যায়কে ভেঙে চুরমার করে। ১৯৫২ থেকে ২০২৪-প্রতিটি আন্দোলনেই ছাত্ররা রাষ্ট্রের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। তাদের কলম ও মিছিলের শক্তি ভেঙেছে স্বৈরাচারের লৌহ কপাট। ২০২৪-এর অভ্যুত্থান শুধু শেখ হাসিনার পতনই নয়, এটি ছিল ১৯৫২-এর সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোরই প্রতিধ্বনি। তাই আমাদের প্রতিটি বইমেলা, প্রতিটি আলোচনাচক্র, প্রতিটি সামাজিক আন্দোলনে একুশের চেতনা প্রজ্বলিত রাখতে হবে। কারণ, ভাষা যেমন আমাদের পরিচয়, তেমনি সংগ্রাম আমাদের ঐতিহ্য।
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ