Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ : পর্যালোচনা

Icon

একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার

প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ : পর্যালোচনা

স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স ৫৩ বছর। একটি রাষ্ট্রের গড়ে ওঠার জন্য ৫৩ বছর খুব বেশি সময় নয়, আবার একেবারে কম সময়ও নয়। বিগত ৫৩ বছরে আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করেছি, আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিপজ্জনকভাবে পিছিয়ে গেছি। আমাদের কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটেছে, ঈপ্সিত মানে না হলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষার হার, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনযাত্রার মান ইত্যাদি ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু, নীতি-নৈতিকতায় আমরা অনেক পিছিয়ে গেছি। এখন আমাদের সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও আস্থা নেই। হিংসা, বিদ্বেষ, অযৌক্তিক আচরণ, মিথ্যাচার, অপবাদ ইত্যাদি অনেক বেড়ে গেছে। আমরা অনেকেই লাজ-লজ্জা বিসর্জন দিয়ে দু’হাত ভরে নিচ্ছি। আবার কেউ কেউ অনেক অযৌক্তিক দাবি করছি ও বিদ্বেষ ছড়াচ্ছি। এ অবস্থা চলতে থাকলে আমরা আরও পিছিয়ে পড়ব। সুতরাং, এ অবস্থার অবসান হওয়া অত্যাবশ্যক।

একটি রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রতিষ্ঠান হলো, রাজনৈতিক দল এবং আমলাতন্ত্র। রাজনৈতিক নেতারা সৎ, শুদ্ধাচারী, জনবান্ধব, ন্যায়পরায়ণ ও দায়িত্বশীল হলে এবং আমলাতন্ত্রের সদস্যরা মেধাবী, দক্ষ, সৎ, কর্মযোগী, সাহসী, সেবাবান্ধব ও সিদ্ধান্ত প্রদানে চৌকশ হলে রাষ্ট্র সামনে হাঁটে। রাজনীতিক এবং আমলাদের নিয়ত শুদ্ধ না হলে এবং জবাবদিহিতা না থাকলে রাষ্ট্রের পক্ষে সঠিক পথে হাঁটা সম্ভব হয় না।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের কোনোটাকেই সঠিক পথ দেখাতে পারিনি। তখন আমাদের রাজনীতি হওয়ার কথা ছিল উদার গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আমলাদের হওয়ার কথা ছিল প্রজ্ঞাসম্পন্ন, চৌকশ, সেবাবান্ধব ও জবাবদিহিমূলক। কিন্তু আমরা রাজনীতিকে এক ব্যক্তিবাদী এবং আমলাতন্ত্রকে মেধাবিরোধী ও বিশৃঙ্খল অবস্থায় ফেলে দেই। আমরা সব বেসামরিক চাকরিতে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার আয়োজন না করে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে অফিসার নিয়োগ করি। বিনা প্রশিক্ষণে তাদের সরাসরি কাজে পাঠাই। এতে দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়, দানা বাঁধে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি।

আমাদের দেশে কেউ কেউ আমলাতন্ত্র বলতে শুধু প্রশাসন সার্ভিসের প্রতি আঙুল তোলে। কিন্তু আমলাতন্ত্রের বিশ্বজনীন সংজ্ঞায় সব বেসামরিক কর্মচারী এতে অন্তর্ভুক্ত।

বর্তমানে আমাদের সরকার হলো অরাজনৈতিক সরকার। তাদের পরিচয় হলো, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’। এ সরকারের একটি ব্রত হলো, গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে জনবান্ধব সংস্কার সাধন করা। এজন্য বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়েছে। তন্মধ্যে, একটি কমিশন হলো, ‘জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন’। ১৯৬৭ ব্যাচের সিএসপি আবদুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এ কমিশন গঠিত হয়। কমিশন ৫ ফেব্রুয়ারি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে দুশতাধিক সুপারিশ রয়েছে। এতে অনেক ইতিবাচক সুপারিশও রয়েছে। আবার এমন কিছু সুপারিশও রয়েছে, যেগুলো বাস্তবায়ন হলে রাষ্ট্রের সংকট আরও বাড়বে এবং আমরা পিছিয়ে পড়ব। তাই, সরকারকে বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত, পাকিস্তান, হংকং, শ্রীলংকা ও ভুটান ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের উত্তরসূরি। মালয়েশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও হংকং পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর কাতারভুক্ত। তাদের রাষ্ট্রীয় প্রকাশনায় গর্ব করে উল্লেখ করা হয়, তাদের অর্জিত অগ্রগতির পেছনে আমলাতন্ত্রের অবদান রয়েছে। তারা আমলাতন্ত্রকে সেভাবে গড়েছে ও পরিচালনা করছে। কিন্তু আমরা গড়ার পরিবর্তে বারবার ঔপনিবেশিক অপবাদ তুলে ধ্বংস করেছি এবং পেছনে পড়েছি। ওইসব দেশ মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিসকে শক্তিশালী করায় সেখানে গণতন্ত্র ও সুশাসনের ভিত আরও শক্তিশালী হয়েছে।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সিভিল সার্ভিস/আমলাতন্ত্রবিষয়ক সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে এ দেশে আমলাতন্ত্রের মান তলানিতে পৌঁছবে এবং সুশাসনের স্বপ্ন আরও দূরে চলে যাবে। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হলে এবং গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে আমলাতন্ত্রকে মেধাভিত্তিক ও জবাবদিহিমূলক করতে হবে।

মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিসের আঁতুড়ঘর ছিল চীন। সেখানে ১৩৪ খ্রিষ্টপূর্বে মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিসের গোড়াপত্তন হয়। নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে সেখানে পুরোমাত্রার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হয়। এ পদ্ধতি ১৯০৫ সাল পর্যন্ত বহাল ছিল। ওই সিভিল সার্ভিসের চরিত্র ছিল নিরপেক্ষ ও জনবান্ধব। রাজতন্ত্রের ডুবুডুবু অবস্থায় ১৯০৫ সালে চীনের কুইং সরকার প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি বাতিল করে। সরকারের ধারণা ছিল নিরপেক্ষ বাছাই পদ্ধতির বদলে পৃষ্ঠপোষকতামূলক পদ্ধতির মাধ্যমে চাটুকারদের নিয়োগ দিলে রাজতন্ত্র টিকে যাবে। শাসকদের সে আশা পূরণ হয়নি। ১৯১২ সালে চীনে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে।

মেধাভিত্তিক সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় আঁতুড়ঘর ভারত উপমহাদেশ। এখানে ১৮৫৩ সালে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে আইন পাশ হয় এবং ১৮৫৫ সালে প্রথম প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ হোম সিভিল সার্ভিসে (বিএইচসিএস) আলাদা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা শুরু হয়। ১৮৯৬ সালে একই প্রশ্নে আইসিএস, বিএইচসিএস এবং ইস্টার্ন ক্যাডেট (মালয়েশিয়া, হংকং সিভিল সার্ভিস) পরীক্ষা শুরু হয়। ১৯৪৩ সালে সর্বশেষ আইসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। তখন পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষার নাম হয় সেন্ট্রাল সিভিল সার্ভিস (সিএসএস) পরীক্ষা। আইসিএসের উত্তরসূরি সার্ভিসের নাম হয় প্রথমে পাকিস্তান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (পিএএস) ও পরে হয় সিএসপি। বর্তমান নাম আবার পিএএস। ভারতে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আইএএস।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের মতে, এ আইসিএস পরীক্ষা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম পরীক্ষা। ১৮২৬ সালের পরে আইসিএসদের ৫০ শতাংশ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্ররা, ২৫ শতাংশ ছিল কেমব্রিজ সেরারা। অবশিষ্ট ২৫ শতাংশ ছিল ব্রিটিশ এবং ভারতের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের।

আইসিএস পরীক্ষার মানের কঠোরতা উপলব্ধি করার সুবিধার্থে একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম ব্যাচ গ্র্যাজুয়েশন করে বের হয় ১৯২৩ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১৯২৩ থেকে ১৯৪৩ (শেষ আইসিএস পরীক্ষা) সাল পর্যন্ত একুশটি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থীও আইসিএস হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারেনি।

সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মাধ্যমে সবচেয়ে মেধাবীরা আসার পরেও সরকার তাদের সরাসরি কাজে নিয়োগ করেনি। শিক্ষানবিশদের জন্য ব্রিটেন ও ভারতে Intensive and Rigorous Training-এর ব্যবস্থা করা হয়। ট্রেনিংয়ে পাশ করা বাধ্যতামূলক করা হয়।

নিবিড় ও কষ্টসাধ্য প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পরেও সরকার শিক্ষানবিশদের লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেয়নি। ১৮২৯ থেকে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত আইসিএস শিক্ষানবিশরা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলোর বাসিন্দা হতেন এবং এসডিও হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ডিএম-এর বাংলোতেই বাস করতেন। ডিএম ও তার সহধর্মিণী মিলে শিক্ষানবিশ অফিসারকে দক্ষ ও পেশাদার অফিসার হিসাবে গড়ে ওঠার শিক্ষা ও দীক্ষা দিতেন। শিক্ষানবিশদের ডিএম-এর বাংলোতে বাসিন্দা হওয়ার রীতি পাকিস্তান আমলেও (১৯৫৮ সাল পর্যন্ত) প্রচলিত ছিল।

পাকিস্তান ও ভারতের শিক্ষানবিশ বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও আইসিএস পরীক্ষার কঠোরতা ধরে রাখা হয়। পাকিস্তানে পূর্বের আইসিএস পরীক্ষার আদলের পরীক্ষার নাম দেওয়া হয় সেন্ট্রাল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা (সিএসএস পরীক্ষা)। মোট ১৬টি সার্ভিস/ক্যাডার নিয়ে গঠিত সার্ভিসের প্রশাসনিক অংশের নাম ছিল প্রথমে পাকিস্তান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (পিএএস)। পরে যার নাম হয় সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তান (সিএসপি)। কালক্রমে বর্তমানে এটিই পিএএস।

ভারতে শুরু থেকেই নাম ছিল ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (আইএএস)। এখনো তা বহাল আছে। পাকিস্তানে ১৯৪৮ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম সিএসএস পরীক্ষা। বাঙালিরা শেষ সিএসএস পরীক্ষা দেয় ১৯৭০ সালে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো লিখিত পরীক্ষা ছাড়া শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়। অযৌক্তিকভাবে ৫৫ শতাংশ কোটা পদ্ধতি আরোপ করা হয়, পরে এটা ৫৬ শতাংশ করা হয়। প্রশিক্ষণকে অবহেলা করা হয়। এতে সিভিল সার্ভিসের ক্ষতি হয়।

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সিভিল সার্ভিসকে ঢেলে সাজানোর একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। কোটা প্রথা বাতিল করা হয়েছে। এখনই সিভিল সার্ভিসকে শতভাগ মেধাভিত্তিক করার সুযোগ এসেছে। ফলে উপসচিব পদ থেকে পদোন্নতিতে প্রচলিত কোটা প্রথা বিলুপ্ত করা উচিত। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সময় পরীক্ষার নম্বর ও পছন্দের ভিত্তিতে যিনি যে সার্ভিস পাবেন, তিনি সেখানে স্থিত হবেন ও গড়ে উঠবেন। মাঝপথে কেউ এক সার্ভিস থেকে আরেক সার্ভিসে গেলে তিনি গড়ে ওঠার সুযোগ পাবেন না। ফলে, তিনি নিজেও ভালো থাকবেন না এবং রাষ্ট্রের কাজেও কোনো ইতিবাচক অবদান রাখতে পারবেন না।

আমাদের ভালো সিভিল সার্ভেন্ট, ভালো শিক্ষক, ভালো চিকিৎসক, ভালো কৃষিবিদ সবই দরকার। তাই, সব সেক্টরে দক্ষ ও পেশাদার জনবল দরকার। এজন্য, যার যার কাজের আলোকে তাদের স্বতন্ত্রভাবে নিবিড় প্রশিক্ষণ ও দীক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। আর, গড়ে তোলার সর্বোত্তম সময় হলো শিক্ষানবিশ কাল। এসময় তারা চাকরির জগতে তুলতুলে শিশু ও কাদামাটির মতো থাকে। ফলে, তাদের শিক্ষা ও দীক্ষা দিয়ে গড়ে তোলা যতটা সহজ, কয়েক বছর পরে ততটা সহজ নয়।

যিনি প্রশাসনে আসবেন, তিনি ওই লাইনে প্রশিক্ষণ নিয়ে, হাতে-কলমে শিখে দক্ষতা ও সক্ষমতা অর্জন করবেন। আবার, যিনি অন্য ক্যাডারে যাবেন, তিনিও তার লাইনে প্রশিক্ষণ, হাতে-কলমে শিখন ও দীক্ষা নিয়ে যথাযথ যোগ্যতা অর্জন করে গড়ে উঠবেন। এতে ব্যক্তি নিজেও আত্মমর্যাদার সঙ্গে বাঁচবেন এবং রাষ্ট্রও উপকৃত হবে।

সঠিক মানে ও দক্ষতায় গড়ে ওঠার জন্য সিএসপিদের ধারাবাহিকভাবে একই লাইনে পদায়ন করা হতো না। তারা এসডিও হিসাবে কাজ করে সচিবালয়ে আসতেন। এডিসি হয়ে মাঠে যেতেন এবং আবার সচিবালয়ে এসে উপসচিব হিসাবে কাজ করতেন। অতঃপর ডিসি হয়ে মাঠে যেতেন। এভাবে তারা গড়ে উঠতেন। এখনো সে পদ্ধতিতে না এগোলে সিভিল সার্ভিস ও রাষ্ট্র দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

যে কোনো দেশের সিভিল সার্ভিস পিরামিড আকৃতির। নিচে পদ বেশি, উপরে কম। তাই, পদোন্নতির জন্য প্রত্যেক ক্যাডারে আলাদা পরীক্ষা পদ্ধতি থাকতে পারে। সে পরীক্ষা কঠোরতম হওয়া বাঞ্ছনীয়। আমাদের সশস্ত্র বাহিনীতে প্রায় ৬০ শতাংশ অফিসার মেজর/সম পদে আটকে যান। সিভিল সার্ভিসে সবাই সচিব হতে চায়। এখানে, সশস্ত্র বাহিনীর পিএসসির মতো কোনো কঠিন পদ্ধতির প্রবর্তন করতে হবে। এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে যে, সেখানে পরীক্ষায় পাশ করে নেভির অফিসাররা আর্মি এবং আর্মির অফিসাররাও অন্য বাহিনীতে যেতে পারে না। সিভিলেও পদোন্নতির জন্য কঠোরতম পরীক্ষা পদ্ধতি আরোপ করা যেতে পারে। তবে, পদোন্নতি হবে ক্যাডারভিত্তিক। মাঝপথে এক ক্যাডার থেকে আরেক ক্যাডারে যাওয়ার সুযোগ রহিত করা অপরিহার্য। পৃথিবীর কোথাও এমনটি নেই। তবে, সরকারের হাতে ১০ শতাংশ থাকতে পারে। সরকার কাউকে অসাধারণ ভালো হিসাবে গণ্য করলে ১০ শতাংশের আওতায় নিয়োগ দিতে পারেন।

রাষ্ট্রের কাজ করার জন্য যোগ্য হয়ে ওঠার জন্য এন্ট্রি পয়েন্টে মেধা ও পছন্দের ভিত্তিতে যে সার্ভিসে ঢুকবেন, পুরো কর্মজীবন সেখানেই কাজ করবেন। তাহলেই, মেধাবীরা সিভিল সার্ভিসে আকৃষ্ট হবেন এবং দেশ ভালো চলবে। তবে, যৌক্তিকভাবে সবারই সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। কারোরই উন্নাসিকতা অথবা হীনমন্যতা থাকা উচিত নয়। পাহাড়সমান বৈষম্য অথবা যুক্তিহীন সমতার দাবি, কোনোটাই কাম্য নয়। সবারই দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত। কারোরই লাগামহীন হওয়ার সুযোগ নেই। যেই হোক, লাগামহীন হলে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। পৃথিবীর সর্বত্রই একেকটা সার্ভিসের ধরন ও সুযোগ-সুবিধা স্বতন্ত্র। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, পৃথিবীর শতভাগ উন্নত দেশেই চিকিৎসক ও শিক্ষকদের চাকরি শতভাগই স্বতন্ত্র/স্বশাসিত স্থানীয় সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং তাদের সামাজিক সম্মান আকাশচুম্বী। তারা স্বীয় কর্ম দিয়ে সেটা অর্জন করেন।

পৃথিবীর সর্বত্রই পলিসি লেভেলের পদগুলো প্রশাসনের। সিঙ্গাপুর, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালয়েশিয়ায় অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের, যুক্তরাজ্যে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্লাসের, কানাডায় ও অস্ট্রেলিয়ায় এক্সিকিউটিভ ক্লাসের, যুক্তরাষ্ট্রে ক্লাসিফাইড সিভিল সারভেন্টের। সেখানে এক গ্রুপের কাজ, বেতন ইত্যাদি নিয়ে আরেক গ্রুপের মাথাব্যথা নেই। সেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আছে, যা আমাদের মাঝে নেই। আমরা হয় উন্নাসিক, না হয় হীনমন্য। এসবের কোনোটাই সমর্থনযোগ্য নয়।

বিসিএস পরীক্ষার মান আরও কঠিন হওয়া উচিত। চার-পাঁচ বছর ধরে সস্তা নোট বই মুখস্থ করে ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে সিভিল সার্ভিসে আসাও ভালো লক্ষণ নয়।

একেএম আবদুল আউয়াল মজুমদার : সাবেক সচিব; গবেষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম