স্মরণ
স্বাধীনতা যুদ্ধের কমান্ডার ইন চিফ

কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক (অব.)
প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আজ ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বাধীনতা যুদ্ধের কিংবদন্তি, কালজয়ী সিপাহসালার, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক (কমান্ডার ইন চিফ) মহানায়ক বঙ্গবীর জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি প্রায় ভুলতে বসেছি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের এ মহানায়ককে। এ কারণেই হয়তো Rudyard Kipling লিখেছিলেন-
‘God and soldier all men adore,
In times of danger and not before.
When danger is over and things are righted,
God is forgotten and poor soldier is slighted.’
জেনারেল ওসমানীর ৬৬ বছরের (১ সেপ্টেম্বর ১৯১৮-১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৪) জীবনটি ছিল এক মহাসাগরের মতো, যার ওপর দিনের পর দিন আলোচনা বা লেখালেখি করলেও শেষ করা যাবে না।
সামরিক বাহিনীতে অনেকেই জেনারেল হন বটে; কিন্তু মিলিটারি লিডার হতে পারেন না। যে কোনো দেশের সামরিক বাহিনীতে জেনারেলরাই নীতি প্রণয়ন, প্রয়োগ ও যুদ্ধ পরিচালনা করে থাকেন। এমন সফল জেনারেল যুগে যুগে, দেশে দেশে ও বিভিন্ন জাতিতে অনেক ছিলেন বলেই সেসব দেশ ও জাতি বিশ্বে মাথা উঁচু করে টিকে আছে। যেমন-খালিদ-বিন-ওয়ালিদ, মুহাম্মদ বিন কাশেম, ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি, নেপোলিয়ান বোনাপার্ট, মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর, বৈরাম খাঁ, মানসিংহ, জেনারেল আইসেন হাওয়ার, ফিল্ড মার্শাল আরভিন রোমেল, জেনারেল হ্যান্স গুদেরিয়ান, জেনারেল দ্য গল, ফিল্ড মার্শাল উইলিয়াম যোসেফ স্লিম, ইরানি জেনারেল কাশেম সুলায়মানি প্রমুখ। আমরাও গর্ব করে বলতে পারি, আমাদেরও এমন একজন জেনারেল আছেন, যিনি বাংলাদেশ ও বিশ্বের যুদ্ধ ইতিহাসকে আলোকিত করেছেন এবং নিজ দেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলেন। তিনি হলেন জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী।
একটি পরাধীন দেশকে স্বাধীন দেশে পরিণত করতে হলে জনগণকে উদ্বুদ্ধ ও জাগরিত করার জন্য উঁচুমানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন প্রয়োজন হয়, তেমনি দখলদার আগ্রাসী বাহিনীকে পরাজিত করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় সামরিক বাহিনী ও এর নেতৃত্ব প্রদানের জন্য অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান ও দুর্ধর্ষ সামরিক নেতার। যেমন-ভিয়েতনামের স্বাধীনতা যুদ্ধে রাজনৈতিক নেতা ছিলেন হো চি মিন, যিনি ভিয়েতনাম জাতিকে উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন, আর সামরিক নেতা ছিলেন পৃথিবীর ইতিহাসে দুর্ধর্ষ সমরনায়ক জেনারেল ভো নগুয়ান গিয়াপ। এখানে আমরা আলোচনা করব বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীকে নিয়ে, যিনি তার অসাধারণ মেধা, যোগ্যতা, নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শী সমর কৌশল প্রয়োগ করে তুলনামূলকভাবে বহুগুণে শক্তিশালী শত্রু বাহিনীকে পরাস্ত করে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফলকে অনুকূলে নিয়ে আসেন, যা কল্পনাকেও হার মানায়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিক মুক্তিযুদ্ধে সামরিক নেতৃত্বকে খাটো করে ও অবজ্ঞার চোখে দেখেন, যা তাদের সশস্ত্রবাহিনীবিরোধী ও অন্ধ প্রতিবেশী দেশপ্রীতি মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ।
বিশ্বের ইতিহাসে বিরল সম্মান, গৌরব ও ঐতিহ্যের অধিকারী ব্যক্তিত্ব : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কে? প্রথম সেনাপ্রধান ও প্রথম জেনারেল কে? বাংলাদেশের কোন সেনা অফিসার বিশ্বের চার-চারটি বড় যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন এবং তিনটি দেশের সেনাবাহিনীতে চাকরি করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন? কোন সামরিক অফিসার অবসরকালীন দেশের ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতাযুদ্ধে সশস্ত্রবাহিনীর নেতৃত্ব দেন? ইত্যাকার মহাগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর অনেকেরই, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের অজানা। অথচ এসব উত্তর এদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবময় অধ্যায়। দেশ ও পৃথিবীর ইতিহাসে সমৃদ্ধ ও অত্যধিক সম্মানজনক এ অবস্থানের অধিকারী হলেন জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানী, যিনি ছিলেন একাধারে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও সেনাবাহিনীর প্রথম ও প্রধান সেনাপতি (The Commander-in-Chief of Bangladesh Forces and Chief of Army Staff (12 April 1971-7 April 1972) এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ‘জেনারেল’ পদবির অফিসার, যিনি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলেছিলেন। এ বীর সিপাহসালার শুধু মুক্তিযুদ্ধেই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭ ও ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তানের দুটি যুদ্ধেও বীরত্বের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বিশ্বের ইতিহাসে চারটি বড় বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন এমন সামরিক অফিসারের সংখ্যাও খুবই কম। তিনিই একমাত্র অফিসার, যিনি একযোগে তিনটি দেশের সশস্ত্রবাহিনী অর্থাৎ ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনী, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অতি ঘনিষ্ঠভাবে চাকরি করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বা কমান্ডার ইন চিফ হিসাবে নিয়োগ : ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহকারী বাঙালি সামরিক অফিসাররা একত্রিত হয়ে সর্বজ্যেষ্ঠ সেনা অফিসার কর্নেল এমএজি ওসমানীর নেতৃত্বে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করার দীপ্ত শপথ গ্রহণ করেন। এ অনুষ্ঠানে সর্বসম্মতিক্রমে তাকে বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বা কমান্ডার ইন চিফ হিসাবে নিয়োগ করার প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং অস্থায়ী সরকার গঠনপূর্বক তা বাস্তবায়নের জন্য সুপারিশ করা হয়। ১০ এপ্রিল সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠিত হলে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুক্ত এলাকায় মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করে। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সব কার্যক্রমকে সুসংগঠিত ও সমন্বিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য সার্বিক দায়িত্ব অর্পণ করা হয় কর্নেল (অব.) এমএজি ওসমানীর ওপর এবং ১৯৭১ সালের এপ্রিল থেকে তাকে কেবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদাসহ বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক (সিইনসি) নিযুক্ত করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এ সামরিক নেতা ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ এবং সম্পূর্ণভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। ওসমানী অবিলম্বে মুক্তিবাহিনীর সব উপাদানকে এক কমান্ডে আনার সিদ্ধান্ত নেন; এবং অনুপ্রেরণাদায়ক নেতৃত্ব, চেতনা, দক্ষতা ও সংকল্পের সঙ্গে তাদের অপারেশন পরিচালনা করেন। ওসমানী কার্যত বাংলাদেশের ডি গল হয়েছিলেন এবং অত্যন্ত বিশ্বাসের সঙ্গে তার কাজটি শুরু ও সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছিলেন।
আধ্যাত্মিক বিষয় : তিনি ছিলেন Born Military Leader; যাকে আল্লাহ্ তৈরিই করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। ১৩০৩ সালে শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যের অত্যাচারী রাজা গৌড়-গোবিন্দ বুরহান উদ্দীন নামক জনৈক প্রজার ছেলের জন্মোৎসব উপলক্ষ্যে গরু জবাই করার কারণে তার শিশু ছেলেকে হত্যা করে। যার ফলে হজরত শাহজালাল যেমন সিলেটের মানুষকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন, একইভাবে তারই ৩৬০ সঙ্গীর অন্যতম একজন আউলিয়া সিলেটের দয়ামীরের হজরত শাহ্ নিজাম উদ্দিন ওসমানীর (রহ.) বংশধর জেনারেল ওসমানী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, শোষণ, নিপীড়নের হাত থেকে দেশবাসীকে মুক্ত করার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন।
ইতিহাসে বিরল সম্মান ও গৌরবের অধিকারী ব্যক্তিত্ব : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, প্রথম সেনাপ্রধান, প্রথম জেনারেল, বিশ্বের চার-চারটি বড় যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ও তিনটি দেশের সেনাবাহিনীতে চাকরি করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, অবসরকালীন দেশের ক্রান্তিলগ্নে স্বাধীনতা যুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদানকারী। তিনিই একমাত্র সামরিক অফিসার, যিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ১৯৬৭ সালে অবসরগ্রহণ করার ৪ বছর ১ মাস ২৪ দিন পর আবারও সামরিক পোশাক পরিধান করে বাংলাদেশ সশস্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে নেতৃত্ব দেন। তার দুঃসাহসী ও অনবদ্য নেতৃত্বে বিশাল শক্তিশালী হানাদার বাহিনীর শোচনীয় পরাজয় ঘটে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে তাকে জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে সম্মানিত করে। সামরিক পোশাক ছাড়ার প্রায় চার বছর পর জেনারেল ওসমানী মাতৃভূমির এ চরম সংকটময় মুহূর্তে আবারও তা পরিধান করে বাংলাদেশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্ব গ্রহণ করেন; যা বিশ্বে এক বিরল উদাহরণ। একবার চিন্তা করে দেখুন তো, সে সময়ে যদি ওসমানীর মতো তীক্ষ্ণ মেধাবী, প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ, দক্ষ, বিচক্ষণ ও সর্বজনগ্রাহ্য সিনিয়র সামরিক নেতা দৃশ্যপটে না আসতেন, তাহলে স্বাধীনতা যুদ্ধের কী শোচনীয় অবস্থাই না হতো! জেনারেল ওসমানী তার বলিষ্ঠ, সুদক্ষ নেতৃত্ব ও যুদ্ধকৌশল প্রয়োগ করে মুক্তিবাহিনী ও সব সেক্টর কমান্ডারকে সুসংগঠিত করে দিকনির্দেশনা, অনুপ্রেরণা ও পরিচালনার মাধ্যমে দেশকে শত্রুমুক্ত করে বহু প্রত্যাশিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় রেখেছেন অনন্য অবদান।
চিরকুমার জেনারেল ওসমানী তার সারাজীবন কাটিয়েছেন এদেশের মাটি ও মানুষের মুক্তির জন্য, উন্নতির জন্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। উৎসর্গ করেছেন তার জীবন-যৌবন, সহায়-সম্পত্তি ও সবকিছু। অবহেলিত বাঙালি মুসলমানদের ব্রিটিশ-ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রবেশের জন্য তিনি সব প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন এবং এর সফলতাও অর্জন করেছেন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করার পথ উন্মুক্ত করে। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার পর একে একে এ রেজিমেন্ট সমৃদ্ধ হতে থাকে, যা স্বাধীনতাযুদ্ধে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তিনি কখনো পিছু হটেননি। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ, অস্ত্রমুক্ত শিক্ষাঙ্গন, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুখী-সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন। বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে যতদিন টিকে থাকবে, বঙ্গবীর জেনারেল আতাউল গণি ওসমানী বেঁচে থাকবেন, স্মরণীয়, বরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে এদেশের মাটি ও মানুষের মনের মণিকোঠায় মুক্তির সুউজ্জ্বল আলোকবর্তিকা হিসাবে।
কর্নেল মোহাম্মদ আবদুল হক, পিএসসি (অব.) : সামরিক ইতিহাসবিদ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
hoque2515@gmail.com