সংস্কারের ফলাফল যেন অশ্বডিম্ব না হয়

মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এক কথায় বলতে গেলে, রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণমুখী উন্নয়নের উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক, নীতিগত, পদ্ধতিগত ও আইনি পরিবর্তনের দ্বারা বিদ্যমান অব্যবস্থার ইতিবাচক আমূল পরিবর্তনই সংস্কার। রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার হতে পারে। যেমন-জনপ্রশাসন, রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি ও আইন। রাষ্ট্র ও সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক অসংগতি, অস্বচ্ছতা, অদক্ষতা ও অন্যায্যতা দেখা দিলে সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এমনই একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার কারণেই অন্তর্বর্তী সরকার অনেক ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে এবং এ লক্ষ্যে কয়েকটি সংস্কার কমিশনও গঠন করেছে। জনগণ আশা করেছিল, সংস্কার কমিশনগুলো প্রতিটি ক্ষেত্রের মূল সমস্যাগুলো গভীরভাবে পর্যালোচনা করে রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবায়ন সক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো দাখিল করবে। কিন্তু কয়েকটি কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, তাদের অধিকাংশ সুপারিশই রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক সক্ষমতার বাইরে। সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের সঙ্গে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়াও দক্ষ ও সুসংগঠিত জনপ্রশাসনের প্রয়োজন হয়, যা বর্তমানে অনুপস্থিত। স্বপ্নে পাহাড়ে চড়া যতটা সহজ, বাস্তবে ততটাই কঠিন। মনে রাখতে হবে, মই দিয়ে পাহাড়ে চড়া যায় না।
সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। এ কমিশনের প্রতিবেদন সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক। প্রতিবেদনটি অনেকটা দায়সারা গোছের। বেশ কয়েকটি সুপারিশে অসংগতি ও অস্পষ্টতা রয়েছে, রয়েছে বাস্তবায়ন অযোগ্যতাও। উদাহরণ হিসাবে দু-একটি বিষয় তুলে ধরা হলো।
প্রতিবেদনের ৭ অনুচ্ছেদে অনেক অসংগতি রয়েছে। ৭. ১৩ ‘ক’ অনুচ্ছেদে সব সার্ভিসের মধ্য থেকে সচিবালয়ের উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদগুলো নিয়ে ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস’ (এসইএস) গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। ‘খ’ উপ-অনুচ্ছেদে উপসচিবের ৫০ শতাংশ পদ প্রশাসনিক সার্ভিসের জন্য সংরক্ষণের সুপারিশ করা হয়েছে। তাহলে উপসচিব পদের ৫০ শতাংশ কি প্রশাসনিক সার্ভিসের এবং ৫০ শতাংশ এসইএস সার্ভিসের হবে? অন্য সার্ভিস থেকে আসা উপসচিবদের মধ্যে যারা যুগ্মসচিবের পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবেন, তারা উপসচিব হিসাবেই ১৫-২৫ বছর চাকরি করবেন। এভাবে অকৃতকার্যের সংখ্যা বেড়ে ৫০ শতাংশ পদই একসময় পূর্ণ হয়ে যেতে পারে। উল্লেখিত অনুচ্ছেদে প্রশাসনিক সার্ভিস ও এসইএসের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলা হয়েছে।
প্রশাসন সার্ভিসের লাইন পদ হিসাবে অতিরিক্ত জেলা কমিশনার থেকে বিভাগীয় কমিশনার পদগুলোর উল্লেখ করা হলেও এ লাইন পদে এসইএস সার্ভিসের সদস্যদের পদায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে। যদি তাই হয়, তাহলে এসব পদ প্রশাসন সার্ভিসের লাইন পদ হয় কীভাবে? এছাড়া প্রশাসন সার্ভিস থেকে পদোন্নতি পাওয়া জেলা প্রশাসকের মর্যাদার মানের চেয়ে এসইএস সার্ভিসের সদস্যের মধ্য থেকে পদায়িত জেলা প্রশাসকদের মান অধিক হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে কি দুই ধরনের মর্যাদা-মানসম্পন্ন জেলা প্রশাসক থাকবেন? এটা কি আজব প্রস্তাব মনে হয় না!
ভারতে ‘জেলা শাসক’ ও ‘মহকুমা শাসক’ পদবি এখনো বিদ্যমান। আমাদের দেশের পদবি হচ্ছে ‘জেলা প্রশাসক’, ‘জেলা শাসক’ নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘জেলা প্রশাসক’ পদবিটি পছন্দ না হলে পরিবর্তন করা যেতেই পারে। কিন্তু পদবি পরিবর্তনের দ্বারা কি চিন্তা ও মনমানসিকতার পরিবর্তন হবে? এ পদে পদায়িতদের চিন্তা ও মনমানসিকতার পরিবর্তনের কোনো সুপারিশ কি করা হয়েছে? এসব পদবি পরিবর্তনের ফলে পৌর কমিশনার, জেলা কমিশনার ও উপজেলা কমিশনারের পার্থক্য বুঝতে জনগণের হয়তো একটু সময় লাগবে। চমক সৃষ্টি বা কোনো গোষ্ঠীকে খুশি করার জন্য কোনো সুপারিশ সংস্কার কমিশনের কাছ থেকে কাম্য নয়। বর্তমান প্রশাসন এবং মাঠ প্রশাসন অনেকটা দুর্বল অবস্থায় আছে। একে আরও দুর্বল করার পরিণতি কী হতে পারে, আইনশৃঙ্খলাসহ নির্বাচনব্যবস্থায় কী প্রভাব পড়তে পারে, সে বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে।
সুপারিশের ভাষাদৃষ্টে মনে হয়, সব সার্ভিসের পদে লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির সুপারিশ করা হয়েছে। লিখিত পরীক্ষা দ্বারা মেধা যাচাই করা যায়। সংশ্লিষ্ট পদের যোগ্যতা ও দক্ষতা যাচাই করা যায় না। লাখ লাখ উচ্চশিক্ষিতের মধ্য থেকে এক শতাংশেরও কমসংখ্যক ক্যাডারে নিয়োগ পায়। এরা যদি মেধাবী না হয়, তাহলে মেধাবী কারা? এরপর তাদের বিভাগীয় পরীক্ষায়, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। এরপরও কি মেধা যাচাইয়ের প্রয়োজন হয়? এরপর উচ্চতর পদগুলোতে পদায়নের জন্য প্রয়োজন হয় সংশ্লিষ্ট পদে কাজ করার যোগ্যতা ও দক্ষতা যাচাইয়ের, যা লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা প্রায় অসম্ভব। এছাড়া সমগ্র চাকরিজীবনে যদি পদোন্নতি পরীক্ষার পেছনেই ছুটতে হয়, বিভিন্ন গাইডবই পড়ে সময় কাটাতে হয়, তাহলে জনগণকে সেবা দেবে কখন? এছাড়া এভাবে এতসংখ্যক পরীক্ষা নেওয়ার সক্ষমতা অর্জনের জন্য কত বছর সময় প্রয়োজন, সেটা কি বিবেচনা করা হয়েছে?
এছাড়া বিদ্যমান জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ক্যাডারের সঙ্গে নন-ক্যাডার এলজিইডি সার্ভিস, বিসিএস (বন) ক্যাডারের সঙ্গে নন-ক্যাডার পরিবেশ সার্ভিস, তথ্য ক্যাডারের সঙ্গে নন-ক্যাডার আইসিটির কর্মকর্তাদের সংযুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে, পরিসংখ্যান ক্যাডারকে নন-ক্যাডারে রূপান্তরের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ক্যাডার-ননক্যাডার একত্র করার সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা পর্যালোচনা করা হয়েছে বলে মনে হয় না।
প্রাদেশিক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। এছাড়া এ সুপারিশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আর্থিক অবস্থা এবং বাস্তবায়নযোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না।
অধিকাংশ সুপারিশেরই বাস্তবায়নকাল মধ্যমেয়াদি উল্লেখ করা হয়েছে। সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য দক্ষ ও সুসংগঠিত জনপ্রশাসন প্রয়োজন হয়। বর্তমান জনপ্রশাসন ভঙ্গুর ও অগোছালো। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক, সাংগঠনিক ও আইনি সংস্কার করার মতো যথেষ্ট দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে পেনশন, চাকরিতে প্রবেশের বয়স ও সম্পত্তির হিসাব দাখিলের যে তিনটি বিধান জারি করা হয়েছে, তিনটিই অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ। সুতরাং, ব্যক্তিগত পছন্দ ও ব্যক্তিগত বিদ্বেষের দ্বারা সাজানো এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতির ছায়াতলে গড়ে ওঠা জনপ্রশাসন দ্বারা ১-২ বছর সময়সীমার মধ্যে অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
সপ্তম অধ্যায়ের ‘ঙ’ অনুচ্ছেদে উপসচিবের পদের ৫০ শতাংশ প্রশাসন সার্ভিসের জন্য সংরক্ষিত রাখার কথা উল্লেখ করা হলেও ওই অনুচ্ছেদেই উপসচিবের সব পদ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখার উল্লেখ রয়েছে, যা পরস্পরবিরোধী। ৭.১৮ অনুচ্ছেদে বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ ধাপকে পদোন্নতির সর্বোচ্চ ধাপ উল্লেখ করা হয়েছে। ৭.১ অনুচ্ছেদে ১২টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্তির সুপারিশের কথা বলা হলেও দেখানো হয়েছে ১৪টি প্রধান সার্ভিস। কমিশনের প্রতিবেদনে এ ধরনের ভুল কাম্য নয়।
অন্যান্য সংস্কার কমিশনের মধ্যে অনেক কমিশনই সমস্যার যতটা গভীরে গিয়ে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন ছিল, ততটা গভীরে গিয়ে সমস্যার পর্যালোচনা করেছে বলে মনে হয় না। যেমন, দুর্নীতি দমন কমিশন বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি রোধের কি কোনো উপায় খুঁজেছে! বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতিই আর্থিক দুর্নীতির জন্ম দেয়। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি বন্ধ না করা গেলে আর্থিক দুর্নীতি কখনো বন্ধ করা যাবে না। বর্তমানে দুর্নীতি সহায়ক যেসব আইন ও বিধিবিধান রয়েছে এবং পার্শ্ববর্তী দেশের চেয়েও নমনীয় যেসব দণ্ডের বিধান রয়েছে, তা কি পর্যালোচনা করে কোনো সুপারিশ করা হয়েছে? দুদকের বুদ্ধিবৃত্তিক ও আর্থিক নিজস্ব দুর্নীতি রোধে কোনো নজরদারি প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাব রয়েছে কি?
নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার মনস্তাত্ত্বিক সক্ষমতা সৃষ্টি না হলে শ্যাম নির্বাচনের কালচার থেকে বের হওয়া যাবে না। এছাড়া জনপ্রতিনিধিদের হালুয়া-রুটি খাওয়া বন্ধ করতে পারলে নির্বাচনে দুষ্ট লোকের উপস্থিতি কমে যাবে। বিড়ালকে মাছ পাহারায় রেখে সাধু বানানো যাবে না। বিড়ালকে মাছ পাহারা থেকে দূরে রাখতে হবে। সংস্কার কমিশন কি এ বিষয়গুলো পর্যালোচনা করেছে?
প্রভাবমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক পুলিশ বাহিনী গঠনের ব্যাপারে সংস্কার কমিশনের কাছে সুনির্দিষ্ট সুপারিশ জনগণ আশা করেছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে দায়সারা সুপারিশ সবাইকে হতাশ করবে। পুলিশের দুর্নীতি রোধে স্থানীয় পর্যায়ে সর্বদলীয় কমিটির কোনো দায়বদ্ধতা না থাকার কারণে তাদের লাগাম টানবে কে? তারা বর্তমান স্থানীয় দালালদের স্থলাভিষিক্ত হয় কিনা, তা নিয়ে জনমনে শঙ্কা থাকবে। এছাড়া সর্বদলীয় কমিটি অত্যন্ত প্রভাবশালী হলে পুলিশের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ারও আশঙ্কা দেখা দেবে।
সব কমিশনই বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি সম্পর্কে নীরব। বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্নীতি বন্ধ বা হ্রাসের কোনো উপায় ও পদ্ধতি সংস্কার প্রস্তাবে না থাকলে সংস্কার প্রস্তাব চমক সৃষ্টি করতে পারবে; কিন্তু সমাজ, রাষ্ট্র ও জনপ্রশাসনে কোনো ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবে বলে মনে হয় না।
মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ