Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হবে

Icon

ড. আলী রেজা

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হবে

আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা জাতীয়করণের দাবিতে লাগাতার আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। কিছুদিন আগে ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকদের দাবি আদায়ের আন্দোলন কর্মসূচিতে পুলিশি হামলা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন মহল। সরকার অবশ্য পরে ইবতেদায়ি শিক্ষকদের জাতীয়করণের দাবি নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে।

দেশে শিক্ষকের মর্যাদার কথা মুখে যতটা বলা হয়, কাজে তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সর্বস্তরের শিক্ষককে নিজেদের পেশাগত মর্যাদা ও আর্থিক সুবিধা বাড়ানোর জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে একমুখী করার আলোচনা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে বহুমুখিতার চর্চা অব্যাহত আছে। ফলে এক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে অন্য শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য কখনো দূর করা যায়নি। প্রাথমিক শিক্ষার এ বহুমুখী ধারা নতুন প্রজন্মকে মনোজাগতিকভাবে বিভক্ত করেছে। বিভক্তি ও বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষকদের মধ্যেও। ফলে শিক্ষকদের অসন্তোষ দূর হয়নি। বৈষম্য নিরসনের দাবিতে তারা রাজপথে নেমে এসেছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের মধ্যেও বৈষম্যের কমতি নেই। সরকার অনুমোদিত কমিটির মাধ্যমে একই পদ্ধতিতে নিয়োগ পাওয়া এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে জাতীয়করণ করে বৃহৎ অংশটিকে অযৌক্তিকভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। বঞ্চিত বৃহৎ অংশটি এখন যৌক্তিকভাবেই জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে।

এমপিওভুক্ত কলেজ শিক্ষকদের রয়েছে নানা সমস্যা। তাদের ক্ষেত্রে বৈষম্য শুধু আর্থিক নয়, মর্যাদার দিক দিয়েও। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সরকার অনুমোদিত কমিটির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। তারা জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত এবং শতভাগ বেতন ও অন্যান্য ভাতা সরকারি কোষাগার থেকেই পেয়ে থাকেন। অথচ অযৌক্তিকভাবে তাদের ‘বেসরকারি’ শিক্ষক বলা হয়। সরকারি, আধা-সরকারি কিংবা স্বায়ত্তশাসিত নয়; একেবারে বেসরকারি। এ ‘বেসরকারি’ ট্যাগ লাগিয়ে তাদের সামাজিক মর্যাদা খর্ব করে রাখা হয়েছে। শিক্ষা বিভাগীয় সব অফিস যেহেতু সরকারি, তাই এ শিক্ষকরা শিক্ষা অফিসগুলোতে কোনো কাজে গেলে যথাযোগ্য সম্মান পান না। শিক্ষকদের চাকরিবিধিতেও রয়েছে নানা অসংগতি। পুরো চাকরি জীবনে একটিমাত্র পদোন্নতি অযৌক্তিক, বৈষম্যমূলক ও অসম্মানজনক। পদোন্নতির ক্ষেত্রে দক্ষতা, যোগ্যতা ও উচ্চতর শিক্ষা-গবেষণাকে মূল্যায়ন করা হয় না। আনুপাতিক হারে পদোন্নতি শিক্ষাক্ষেত্রে একটি স্থবির অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এক্ষেত্রে বিভাগীয় পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির পদ্ধতি চালু করা খুবই জরুরি। এটি করা হলে শিক্ষকরা শিক্ষা ও গবেষণার দিকে মনোনিবেশ করবেন। আরেকটি বিষয় হলো, বর্তমান নিয়মে শিক্ষা বিভাগীয় সব সরকারি শিক্ষক-কর্মকর্তা পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর তিনটি ইনক্রিমেন্ট পান। অযৌক্তিকভাবে পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এ ইনক্রিমেন্টের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। কেন পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ওই তিনটি ইনক্রিমেন্ট পাবেন না, তার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে নেই।

নন-এমপিও শিক্ষক নামে শিক্ষকদের মধ্যে আরেকটি ক্যাটাগরি আছে। এ নন-এমপিও শিক্ষকরা ক্লাস কার্যক্রমসহ শিক্ষা বিভাগীয় ও সরকার নির্দেশিত সব দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় মফস্বল এলাকায় প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগ অসচ্ছল। এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থী সংকট আছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কোনো বেতন আদায় করতে পারে না। ম্যানেজিং কমিটি, গভর্নিং বডি, এমনকি প্রতিষ্ঠান প্রধান যিনি থাকেন, তিনিও শিক্ষকদের বেতন বা কোনো ধরনের আর্থিক সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে যত্নবান নন। নন-এমপিও এসব শিক্ষক এমপিওভুক্তির আশায় বছরের পর বছর বিনা বেতনে শিক্ষকতা করে থাকেন। সরকার মাঝেমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করে; যা চাহিদার তুলনায় খুবই সামান্য। এমপিওভুক্তির আশায় বিনা বেতনে বছরের পর বছর শিক্ষকতা করা নন-এমপিও শিক্ষকরা বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেছেন। নানা কৌশলে, কখনও বলপ্রয়োগ করে তাদের যৌক্তিক আন্দোলন দমন করা হয়েছে। শিক্ষাকে অগ্রাধিকার ও শিক্ষকতা পেশাকে মর্যাদাশীল করে তোলার কথা সব সময়ই বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশে শিক্ষা খাত কখনও অগ্রাধিকার পায়নি এবং শিক্ষকতা পেশায় মানমর্যাদা দিন দিন কমেই যাচ্ছে।

গত সরকারের আমলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা একটানা প্রায় দেড় মাস জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান করেছিল। শেষ পর্যন্ত অনশন করেছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার কৌশলে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সে আন্দোলন দমন করেছিল। প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরের শিক্ষকদের আন্দোলনের ইতিহাস ও ফলাফল খুব একটা সুখকর নয়। ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয় ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডির দুর্নীতি ও দৌরাত্ম্য আমলে নিয়ে সব কমিটি বাতিল করেছিলেন। এতে শিক্ষকরা আশ্বস্ত হয়েছিলেন; কিন্তু পরবর্তী সময়ে সেই কমিটি প্রথা আবার ফিরে এসেছে। কমিটির বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিছু বিরল ব্যতিক্রম বাদে রাজনৈতিক বিবেচনায় স্থানীয় অনেক রাজনৈতিক কর্মী কিংবা প্রভাবশালী লোকদেরই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে দেখা যায়। তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার দিকে মনোযোগী না হয়ে নিয়োগ বাণিজ্য ও আর্থিক লাভালাভের দিকেই বেশি মনোযোগী হতে দেখা যায়। এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যেহেতু সরকারি কোষাগার থেকে শতভাগ বেতন পেয়ে থাকেন, তাই সরকার সরাসরি তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা না বাড়িয়েও এ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলিব্যবস্থা। বদলির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক আন্দোলন চলমান আছে। বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখা চলে। একই প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন চাকরি করার ফলে কেউ প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন আবার কেউ নানা বৈষম্যের শিকার হয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফলপ্রসূ শিক্ষার জন্য দুটোই নেতিবাচক। বদলি বাস্তবায়ন করা হলে এ সমস্যা অনেকটাই দূর হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। শিক্ষার্থীদের বেতন সরকারি কোষাগারে জমা করা হলে, সেই অর্থ দিয়েই শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করা সম্ভব-এমন একটি হিসাব শিক্ষক সংগঠনগুলো সরকারের কাছে পেশ করেছে বলে জানা যায়। বিষয়টি আরও বিশ্লেষণ করে শিক্ষার মতো একটি মৌলিক-মানবিক অধিকারকে বৈষম্যহীন একটি ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।

সর্বস্তরের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ। এনটিআরসিএ এন্ট্রি লেভেলে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগের একটি পদ্ধতি চালু করেছে। এ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা উচিত। শিক্ষকদের মধ্য থেকে পদায়নের মাধ্যমেও প্রতিষ্ঠানপ্রধান নিয়োগ করা যেতে পারে। এতে দুর্নীতি কমবে এবং যোগ্যদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে। মোট কথা, যে কোনো মূল্যে শিক্ষাক্ষেত্রে বিদ্যমান অসংগতি ও বৈষম্য দূর করতে হবে। একসঙ্গে সম্ভব না হলেও বৈষম্য নিরসন করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তা না হলে শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। জুলাই-আগস্টের গণআন্দোলনের পর দেশের মানুষকে যে সাম্য, ন্যায়-নীতি ও মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়ন ছাড়া সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

ড. আলী রেজা : কলেজ শিক্ষক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম