শতফুল ফুটতে দাও
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একশ দিনের এপিঠ-ওপিঠ
ফাইল ছবি
একটি নতুন সরকার রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেওয়ার পর ১০০ দিনের মাথায় এর সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে মিডিয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলোচনা-পর্যালোচনা করা হয়। একটি প্রবাদ আছে ‘Morning shows the day’, অর্থাৎ ভোরবেলাতেই বোঝা যায় দিনটি কেমন যাবে। বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানের পর প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত ৮ আগস্ট একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এখন যারা দেশ চালান, তারা নির্বাচনের মাধ্যমে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেননি। বিশাল জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক এ সরকার। যেহেতু জনগণ সানন্দচিত্তে প্রফেসর ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে গ্রহণ করেছে, তার মধ্যেই নিহিত আছে এ সরকারের বৈধতা। পুঁথি-পুস্তকে রাষ্ট্রতত্ত্ব নিয়ে অনেক কথা আছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, রাষ্ট্রের নাগরিকরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের কিছু অধিকার ও সার্বভৌমত্ব কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে সমর্পণ করে, তাতেই ওইসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী সরকারের দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা অর্জন করে। যেহেতু গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়েছে এবং শেখ হাসিনা তার প্রভুর দেশে আশ্রয় নিয়েছেন, এর ফলে বাংলাদেশে একটি সরকারবিহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে শূন্যতা পূরণের লক্ষ্যে প্রফেসর ইউনূসের মতো একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি সরকার গঠিত হয়। এ সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার যেহেতু রাষ্ট্র এবং এর বিভিন্ন সংস্থাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় রেখে গেছে, সেহেতু রাষ্ট্রকে কার্যকর করা এবং একটি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করা। স্বাভাবিক সময় এ কাজটি অনেক সহজ। কিন্তু একটি বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পর কাজটি অত সহজ নয়। সত্য কথা বলতে হলে বলা যায়, শেখ হাসিনার সরকার বৈধ সরকার ছিল না। কারণ নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে এবং রাষ্ট্রের সমুদয় প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ করে শেখ হাসিনা দীর্ঘদিন রাষ্ট্রের ক্ষমতা আঁকড়ে ছিলেন। বড় ধরনের গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারার ফলে শেখ হাসিনা কার্যত ক্ষমতার মসনদে আসীন ছিলেন। শোনা যায়, ভারতে বসে তিনি এখনো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলে নিজেকে তুলে ধরছেন। কিন্তু সব সত্যের বড় সত্য হলো, তিনি দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন এবং এর মধ্য দিয়ে প্রাণ রক্ষা করতে পেরেছেন।
ডকট্রিন অফ নেসেসিটি থেকে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইনগত বৈধতা অর্জন করেছে। তবে এই বৈধতা কতদিন অব্যাহত থাকবে, তা নির্ধারণ করবে জনগণ। স্বাভাবিক অবস্থায় যে কোনো সরকারের প্রথম ১০০ দিনকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, ঠিক সেভাবে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ১০০ দিনের কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন একই রকমের হতে পারে না। বিশেষ পরিস্থিতিতে সৃষ্ট বিশেষ সরকারের মূল্যায়নও হতে হবে বিশেষ ধরনের।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ; সড়ক পরিবহণ ও সেতু এবং রেলপথ অবকাঠামো খাতের তিন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান তার সরকারের প্রথম ১০০ দিন সম্পর্কে দৈনিক প্রথম আলোকে একটি বিস্তৃত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তার এ সাক্ষাৎকার থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজকর্ম সম্পর্কে অনেকটাই জানা যায়। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ লাইনচ্যুত হয়ে গিয়েছিল এবং অন্য গন্তব্যে চলে গিয়েছিল। তিনি মনে করেন, তাদের দায়িত্ব হলো বাংলাদেশকে লাইনে তোলা। এ কথা সঠিক যে, ডলারের তুলনায় বাংলাদেশি টাকার মূল্য অস্বাভাবিকভাবে কমে গিয়েছিল। গত কিছুদিনে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে টাকার মূল্য স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে। এ স্থিতিশীলতা অর্জন এ সরকারের বড় সাফল্য, সন্দেহ নেই, তবে টাকার মূল্য যাতে বৃদ্ধি পায় সেদিকে নজর দিতে হবে।
মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে ফাওজুল কবির খানের ব্যাখ্যার সঙ্গে আমি একমত পোষণ করি। টেলিভিশনের আলোচনায় এবং সংবাদপত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে বেশ কিছুদিন আগে থেকে আমি এ ব্যাখ্যা তুলে ধরেছি। আমি বলেছি, মূল্যস্ফীতি মানে Too much money chasing too few goods. কীভাবে বাজারে অতিরিক্ত অর্থের জোগান বাড়ল, তার কারণ হিসাবে বলেছিলাম আগের সরকারের টাকা ছাপানো এবং অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য খরচের পরিমাণ দ্বিগুণ বা তিনগুণ করা ইত্যাদির মাধ্যমে বাজারে অতিরিক্ত টাকার প্রচলন হয়েছে। ফলে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি উন্নয়নশীল দেশে যখন বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়, তখন বাজারে বাড়তি টাকা আসে, কিন্তু বাড়তি টাকার সঙ্গে সংগতি রেখে পণ্যের সরবরাহ সেই পরিমাণে বাড়ে না। এর ফলে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়তে থাকে। চরিত্রগতভাবে বড় অবকাঠামোগুলো রিটার্ন দেয় ধীর গতিতে, সেই কারণে মুদ্রা সরবরাহের সঙ্গে পণ্যের সরবরাহ সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না।
বর্তমান সরকার টাকা ছাপানোর বিপজ্জনক পথ থেকে সরে এসেছে এবং বড় বড় প্রকল্পগুলোর খরচ সম্পর্কে যৌক্তিকতা বিধানের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হাসিনার সরকার দেশবাসীর ঘাড়ে বিশাল ঋণের বোঝা রেখে গেছে। জ্বালানি তেল, এলএনজি, দেশ ও বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ কেনার বিশাল দেনা সৃষ্টি হয়েছে। এ দেনাটা ডলার ও টাকায় রয়েছে। বর্তমান সরকার ধীরে ধীরে এ দেনা পরিশোধ করার চেষ্টা করছে। ঋণ সার্ভিসিং করার জন্য বিলম্ব হলে পাওনাদাররা অস্থির হয়ে ওঠেন। এখানে উল্লেখ করা যায়, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যবস্থা করার নামে সরকার ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে অনেক বকেয়া জমে উঠেছে। আসলে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের পছন্দের কিছু মানুষকে রাতারাতি ধনবান করে তোলা। এ কাজে অন্যায় ও অনৈতিকতা থাকার ফলে রেন্টাল বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে আইন করে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। বর্তমান সরকার দায়মুক্তি আইন বাতিল করে দিয়েছে। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে এ সরকারের অন্যতম সাফল্য হলো ডলারের দেনা কমিয়ে আনতে পারা। যখন এ সরকার দায়িত্ব নিয়েছিল, তখন ডলারের দেনার পরিমাণ ছিল আড়াই বিলিয়ন ডলার। এখন সেটা কমিয়ে দেড় বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি নিয়ে আসা হয়েছে, প্রবাসী শ্রমজীবী ও কর্মজীবী মানুষজন আগের তুলনায় বেশি করে বৈদেশিক মুদ্রা আইনি চ্যানেলে পাঠাচ্ছে। প্রবাসীরা বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পর নতুন করে দেশ সম্পর্কে আশবাদী হয়ে ওঠার ফলে আইনি চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো বাড়িয়ে দিয়েছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল বৃদ্ধি পেয়েছে। রিজার্ভ ভেঙে ডলারের জোগান দিতে হচ্ছে না। সরকার অপচয় ও অপব্যয় বন্ধ করে দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে। এর সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন একটি সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অবলম্বন করেছে। এর ফলে এক ধরনের সুফল পাওয়া যাবে, তবে বিলম্বে। সুদের হার বাড়িয়ে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর চেষ্টা চলছে। এ পদক্ষেপ উন্নত দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে সেটা কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সাহেব ১০টি ব্যাংক সম্পর্কে প্রকাশ্যে বলেছেন, এই ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হওয়ার পথে, গভর্নরের কাছ থেকে এমন হতাশাব্যঞ্জক কথা শোনার পর ওই ব্যাংকগুলোর টিকে থাকা আরও কঠিন হয়ে উঠেছে। ব্যাংক চলে জনগণের আস্থায়। জনগণ যদি আস্থা হারিয়ে ফেলে, তাহলে দুর্বল ব্যাংকগুলো অচিরেই লালবাতি জ্বালাতে বাধ্য হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক Lender of the last resort হিসাবে ব্যাংকগুলোকে তারল্য সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়েছে। এর ফলে যদি ব্যাংকগুলো মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে, তাহলে এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না।
আমরা চরম বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করছি, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে চুরি হয়ে যাওয়া ৮১ মিলিয়ন ডলার উদ্ধারে বর্তমান সরকার এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আগের সরকারের আমলে এ অর্থের একটা অংশ উদ্ধার হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের হোমরা-চোমরারা এর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সিআইডি একটি তথ্য দিয়েছিল। লুটতরাজ ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত এ সরকারের একটি বড় দায়িত্ব হলো চুরি হয়ে যাওয়া টাকা উদ্ধার করা এবং এর জন্য দোষীদের যথোপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা। মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান অকপটে স্বীকার করেছেন, তাদের ব্যর্থতার মধ্যে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে না পারা। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন, অভ্যুত্থানের বিজয় দেখে পুলিশের একটি বড় অংশ নৈতিক মনোবল হারিয়েছে। তারা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করতে পারছে না। বেশির ভাগ পুলিশ পালিয়ে যাওয়ার পর কর্মস্থলে ফিরে এসে বিবেকের দংশনের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করে তুলতে উদ্যমী হচ্ছে না।
এ সরকারের দ্বিতীয় প্রধান ব্যর্থতা হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারা। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য একদিকে কৃষি উৎপাদন বাধামুক্ত করা এবং বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করার পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। এর ফলে বাজারে খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ বাড়বে এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে আশা করা যায়।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায় না। এটা বিগত সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা বলতে পারি। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে মহাপরাক্রমশালী সরকারগুলোর পতন ঘটেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ আইয়ুব, ইয়াহিয়া, মুজিব ও এরশাদের সরকারের কথা বলা যায়। শেখ হাসিনার পতনও ঘটেছে রাজনৈতিক কারণে। অর্থনৈতিক কারণগুলো যথেষ্ট জোরদার হওয়া সত্ত্বেও প্রধান কারণ হয়ে ওঠেনি। বর্তমান সরকারের সামনে যে রাজনৈতিক সমস্যাটি দিনে দিনে বড় হয়ে উঠছে তা হলো, নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নটি। কবে নাগাদ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে তা জনগণকে জানিয়ে দিয়ে আশ্বস্ত করা জরুরি বলে মনে করি। সম্ভাব্য দিন-তারিখ জানানোর পর যদি আরও ৬ মাসের অতিরিক্ত সময় প্রয়োজন হয় এবং তার যৌক্তিকতা তুলে ধরা হয়, তাহলে জনগণ তা মেনে নেবে বলে আমার মনে হয়। সরকারের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে এ প্রশ্নটির একটি সঠিক সমাধানে পৌঁছানো। বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে দি ইকোনমিস্ট পরিস্থিতি স্থিতিশীল বললেও অনিশ্চয়তার আশঙ্কা রয়ে গেছে বলেছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যে একটি বড় অনিশ্চয়তা-এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ