রাজনীতির এক কলঙ্কিত নাম ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’
মাকসুদুর রহমান
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩২ পিএম
খুন, হত্যা, ধর্ষণ, চুরি,ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, টেন্ডার বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, অগ্নিসংযোগ, হল দখল, বাকী খাওয়াসহ নানাবিদ সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কারনে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত একটি সন্ত্রসী সংগঠনের নাম বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারী শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হাজারো অভিযোগে অভিযুক্ত এই নিষিদ্ধ সংগঠনটি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার ও আতঙ্ক ছড়ানোর লক্ষ্যে নির্যাতন, চাঁদাবাজি, সহিংসতা, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি এবং নিজস্ব মতাদর্শ অন্যের উপর চাপাতে গিয়ে হত্যার মতো নৃশংসতাও চালাচ্ছে বারংবার।
আজ একথা দিবালকের মতো স্পষ্ট এবং সর্বজনবিদিত যে ছাত্রলীগ মানেই সন্ত্রাস ও সহিংসতার অভয়ারণ্য। কেউ কেউ বলেন এককালে ছাত্রলীগের সোনালী অতীত ছিল। তাহলে তাদের কী সেই সোনালী অতীত? তার কিছু খন্ডাংশ নিচে চিত্রায়ন করা হলো
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে মুজিববাদী ছাত্রলীগের আসল চেহারা উন্মোচিত হতে থাকে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাহিরে থাকা ছাত্রলীগের আচরণ ক্ষুধার্ত হায়েনার রূপ ধারণ করে। তারা কেবল প্রতিপক্ষকে নির্যাতন ও হত্যা করেই ক্ষ্যান্ত হয় নি। নির্যাতনের ষ্টীমরোলার চালিয়েছে নিজ দলের কর্মীদের উপরও। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী হত্যার পাশাপাশি ছাত্রলীগের প্রায় পাঁচ শতাধিক নেতা কর্মী হত্যার শিকার হয়, যার সিংহভাগ নিজ দলের আন্ত:কোন্দলে মারা যায়।
৪ এপ্রিল ১৯৭৪, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজি মুহাম্মদ মুহসীন হলের মাঠে ৭ জন দলীয় কর্মীকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে মুজিববাদী ছাত্রলীগের নোংরা রাজনীতির বিভৎস চেহারা ফুটে ওঠে। এরপর ১৯৭৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত কেবল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ৮১ জন, রাবিতে ৩০ জন, চবিতে ১০ জন, জাবিতে ৫ জন, ইবিতে ৪ জন সারা দেশে প্রায় পাঁচ শতাধিক হত্যার শিকার হয় ছাত্রলীগের সোনা বাবুদের হাতে। (এপ্রিল ২০২১, ইনকিলাব)
দ্বিতীয় দফায় আওয়ামীলীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার আগেই ২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তান্ডবেও ছিল ছাত্রলীগের স্বদর্প উপস্থিতি। ঢাকার পীচঢালাপথসহ সারা দেশের রাজপথ রক্তাক্ত করতে আওয়ামীলীগ, যুবলীগের সাথে সন্ত্রাসে নামে মুজিববাদী ছাত্রলীগ। ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হলে ছাত্রলীগের পুরোনো চরিত্র আবার দৃশ্যমান হতে থাকে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের হতে খুন হয়েছে ৩৩ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের হাতে চলে গিয়েছে ১২৯ জনের জীবন। ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যা ছাড়াই প্রায় ৫ শতাধিক জীবন কেড়ে নিয়েছে দানবীয় ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগের হাত একটি রক্তাক্ত হাত, তাদের রাজনীতি আদতে গুম ও খুনের রাজনীতি। তাদের নোংরা লালসার শিকার হয়ে খুনের তালিকা এত বেশি লম্বা যা উল্লেখ্য করা সম্ভব নয়। নারকীয় এই তান্ডবের এবং বিভৎস হিংশ্রতার শিকার হয়ে জীবন বিলিয়ে দেয় খুলনা বিএল কলেজের আবুল কাশেম পাঠান, আব্দুল হালিম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আসলাম, শরিফুজ্জামান নোমানী। বুয়েটের আবরার ফাহাদ, ঢাবির আবু বকর প্রমুখ। ছাত্রলীগের বর্বরতার হাত থেকে রেহাই পায় নি বিশ্বজিত নামক হিন্দু শ্রমিকও।
নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগের আরেক পরিচয় ধর্ষকলীগ হিসেবেও। সাল ১৯৯৮। দুর্ধর্ষ ছাত্রলীগ ক্যাডার জসিম উদ্দীন মানিক। হঠাৎ একদিন বন্ধুদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ করে। কৌতুহলি বন্ধুরা জানতে চায় কী ব্যাপার সেঞ্চুরিটা পূর্ণ করলা নাকি? লালসার জিহবা বের করে দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো তোরা বন্ধুরা সব কিছু অল্পতেই বুঝতে পারোছ। বিশ^বিদ্যালয়ের ১০০ তম ছাত্রীকে ধর্ষণ করে সেঞ্চুরি উৎসব করছি!! রাস্তার কুকুরকেও হার মানিয়েছে ধর্ষক মানিক।(আগস্ট’৯৮,ইত্তেফাক)
বরিশালের গৌরনদীর ৭ম শ্রেণির ছাত্রী ডালিয়াকে ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা লঞ্চ থেকে অপহরণ করে রাতভর পালাক্রমে পাশবিক নির্যাতন চালায়। পবিত্র রমজান মাসে এই বর্বরতা চালাতে একটুও হৃদয় কাঁপেনি হায়েনাদের। (১৮’জানুয়ারি,৯৭ ইনকিলাব)
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন উপভোগ করতে আসে মডেল কন্যা বাঁধন। ছাত্রলীগের সোনার ছেলেদের লোলুপ দৃষ্টি এড়াতে পারে নি বাঁধন। সেই রাতে তাকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণের চেষ্টায় নিন্দার ঝড় ওঠে সারা দেশ ব্যাপী। (৩১ ডিসে.৯৯ ইনকিলাব)
একই বিশ^বিদ্যালয়ের মল চত্ত¡র থেকে এক তরুণীকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে ধর্ষণ করে সূর্যসেন হলের ৪ ছাত্রলীগ ক্যাডার। (৩০ জুন, ২০০০ প্রথম আলো।)
চুরি-ডাকাতি ও ছিনতাইতেও পারদর্শী ছাত্রলীগ
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের গুদাম থেকে সরকারী মালামাল ট্রাক ভর্তি করে চুরি করতে গিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা আনোয়ার হোসেন পুলিশের হাতে আটক হয়। (১৮ জুলাই, ৯৭ বাংলার বানী)
চট্রগ্রামের আনোয়ারা থানায় একটি হিন্দু বাড়িতে ডাকাতি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে আটক হয় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ৫ ক্যাডার। (৯ জানুয়ারি, ৯৭ ইনকিলাব।)
সিলেট এমসি কলেজে স্বামীর সাথে বেড়াতে আসা গৃহবধুকে গণধর্ষণ করে ছাত্রলীগ। নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় ৮ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন। (২৬ সেপ্টে,২০২০ যুগান্তর)
অগ্নিনংযোগেও ছাত্রলীগ সিদ্ধহস্ত
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী এমসি কলেজের হোস্টেলে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। পুড়িয়ে ছাই করে ফেলে ঐতিহ্যের ধারক এই ছাত্রাবাসকে। ছাত্রলীগের সন্ত্রসীরা প্রথমে তা অস্বীকার করে। পরবর্তীতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করা হলে বেড়িয়ে আসে থলের বিড়াল। ২৯ জনকে চিহ্নিত করে কমিটি, যারা সবাই ছাত্রলীগ নেতা ও কর্মী। (১৮ নভে,২০১৭ প্রথম আলো)
মাগুরা শহরের পারনান্দুয়ালি বাস টার্মিনালে দাড়ানো বাসে আগুন লাগাতে হাতেনাতে ধরা পওে ছাত্রলীগের তিন নেতা। (১ জানুয়ারি,২০১৪ প্রথম আলো)
ছাত্রলীগের অপরাধ জগত এত বেশি বিস্তৃত যা লিখে শেষ করা দুরুহ। মানবতার বিরুদ্ধে এমন কোন অপরাধ নেই যার সাথে ছাত্রলীগের সম্পর্ক নেই। তাই এই মানবতা বিরোধী, সন্ত্রাসী ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা ছিল সময়ের অনিবার্য দাবী।
লেখক: মাকসুদুর রহমান
এমফিল গবেষক।