দারিদ্র্য দূরীকরণে ইসলামের নীতিমালা
মো: আসিফ হাসান রাজু
প্রকাশ: ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০৮ পিএম
ছবি: সংগৃহীত
দারিদ্র্য হলো একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যা মানুষের জীবনে মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থতার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। এটি কেবল অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান এবং সামাজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নানা ধরনের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
জাতিসংঘের মাল্টিডাইমেনশনাল পভার্টি ইনডেক্স (MPI) ২০২৪ অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১.১ বিলিয়ন মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছে। এমন পরিস্থিতিতে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক, কেননা ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এটি কেবল ধর্মীয় আচারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দেশনা প্রদান করে।
দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি (Holistic Approch) কে তুলে ধরে যা তিনটি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। যথা, ইতিবাচক কৌশল (Positive Measures), প্রতিরোধমূলক কৌশল (Preventive Measures), এবং সংশোধনমূলক কৌশল (Corrective Measures) (সাদেক, ১৯৯৫)। ইতিবাচক কৌশলের মধ্যে আয় বৃদ্ধি, আয়ের কার্যকরী বিতরণ এবং সমান সুযোগের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইসলাম অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সুষম সম্পদ বণ্টনের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করে। ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী, আয়ের উৎস হালাল হতে হবে এবং কর্মে নিয়োজিত হতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনুল কারীমের সূরা আল-মুলক (৬৭:১৫) উল্লেখ করা হয়েছে, মানুষের উচিত তাদের জীবিকার সন্ধান করা এবং আল্লাহ প্রদত্ত সম্পদকে কাজে লাগানো। রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন: ‘তোমাদের কেউ ভোর বেলায় রশি হাতে নিয়ে পাহাড়ে গিয়ে কাঠ কেটে তা বিক্রি করে বিক্রিলব্ধ পয়সা কিছু খাবে আর বাকিটুকু সাদাকা করবে তা তার জন্য অনেক উত্তম মানুষের নিকট হাত পাতার চাইতে’’ (বুখারী ১৪৮০)।
এছাড়া, অপচয় এবং অপব্যয়ের বিরোধিতা করে বলা হয়েছে: সূরা বনী ইসরাইল (আয়াত ২৯) “তোমার হাতকে তোমার গলায় বেধে দিও না এবং এটিকে একেবারে প্রসারিতও করো না’। এখানে গলায় হাত বাধা অর্থ হলো কৃপণতা করা, আবার প্রসারিত বলতে অপচয় করাকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, ইসলামে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সঞ্চয় এবং অপচয় রোধেরও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যা দরিদ্রতা বিমোচনে উল্লেখযোগ্য কৌশল হিসেবে বিবেচিত।
ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে দ্বিতীয় যে কৌশলের কথা বলা হয়েছে তাকে প্রতিরোধমূলক পদ্ধতি বলা হয় (সাদেক, ১৯৯৫)। ইসলাম প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্পদের এককেন্দ্রীকরণ রোধ করে, যেন এটি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে মালিকানার নিয়ন্ত্রণ এবং অসাধু কার্যকলাপ প্রতিরোধের নির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে সব কিছুর প্রকৃত মালিক আল্লাহ এবং মানুষ কেবলমাত্র আমানতদার। এই ধারণা সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করে। প্রবিত্র কোরআনুল কারীমের সূরা বাকারার ২৮৪ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “নভোমন্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই আল্লাহর..”।
এছাড়াও সহিহ বুখারীর ২৯৫৯ নং হাদিসে অনুসারে রাসূল (সা:) বলেছেন, বান্দাগণ বলে, আমার মাল, আমার সম্পদ। অথচ তিনটিই হলো তার মাল, যা সে খেয়ে নিঃশেষ করে দিল। অথবা যা সে পরিধান করে পুরাতন করে দিল। কিংবা যা সে দান করল এবং সঞ্চয় করল (আখিরাতের প্রতিদান হিসাবে)। এসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে ইসলাম সম্পদের এককেন্দ্রীকরণ রোধ করে এবং সমাজের সকল স্তরে সমান সুযোগ নিশ্চিত করে।
ইসলামি অর্থনীতি ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকারকে সম্মান করে তবে সেটি ইসলামি নীতিমালার অধীনে থাকতে হবে। বর্তমানে বিশ্বে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া একটি বড় সমস্যা; যেমন, ২০২৩ সালে অক্সফামের ‘সারভাইভাল অব দ্য রিচেস্ট’ শিরোনামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পৃথিবীর ১% ধনী ব্যক্তির হাতে প্রায় ৬৭% সম্পদ রয়েছে। ইসলামের প্রতিরোধমূলক নীতিগুলি এই ধরনের অসামঞ্জস্য কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই পদক্ষেপগুলো দারিদ্র্যের উৎপত্তি প্রতিরোধে সহায়ক। ইসলামে রিবা, অপচয় এবং অতিরিক্ত সম্পদ সঞ্চয়ের মতো অনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং সঠিক পদ্ধতিতে বাণিজ্য, সততা এবং মিতব্যয়িতার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হতে পারে দ্বিতীয় খলিফা উমর (রা.) এর শাসনকাল, যখন সুদের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা এবং সম্পদের সমতা নিশ্চিতের মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দারিদ্র্যবিমোচনের তৃতীয় কৌশল হলো সংশোধনমূলক কৌশল। যদি ইতিবাচক ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা দারিদ্র্য দূর করতে যথেষ্ট না হয়, তখন ইসলাম সম্পদ পুনর্বণ্টনের ওপর গুরুত্ব দেয়। এখানে প্রথমেই বাধ্যতামূলক স্থানান্তর যার অন্তর্ভুক্ত যাকাত ব্যবস্থা। যাকাত ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি এবং সম্পদশালী মুসলমানদের এটি প্রদান বাধ্যতামূলক। যা ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। যাকাত সামাজিক সাম্যতা তৈরি করে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করতে সহায়তা করে।
পবিত্র কোরআনুল কারীমের সূরা তওবা (আয়াত ৬০) উল্লেখ রয়েছে, সদাক্বাহ হল ফকীর, মিসকিন ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য তাদের জন্য, দাসমুক্তি ও ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে (ব্যয়ের জন্য) আর মুসাফিরের জন্য। এটা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ফরজ। আর আল্লাহ হলেন সর্বজ্ঞ, মহাবিজ্ঞানী। সূরা আত-তওবা (৯:৬০) সাহাবা ও তাবেয়ীগণের ঐক্যমতে এ আয়াতে সেই ওয়াজিব সদকার খাতগুলোর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। যা মুসলিমদের জন্যে সালাতের মতই ফরজ। যাকাতের মাধ্যমে সম্পদ দরিদ্রদের কাছে পুনর্বণ্টন হয় এবং দারিদ্র্য কমাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
এছাড়া সংশোধনমূলক কৌশলের দ্বিতীয় যে বিষয়ের কথা বলা হয়েছে তা হলো প্রস্তাবিত স্থানান্তর (দান)। যাকাত ছাড়াও ইসলাম দান ও কল্যাণমূলক কাজে উৎসাহ দেয়। এ বিষয়ে সূরা মা’আরিজ (আয়াত ২৪-২৫) উল্লেখ করা যায়, যেখানে বলা হয়েছে, যাকাতের অতিরিক্ত সম্পদে দরিদ্রদের অধিকার রয়েছে। কঠোর দারিদ্র্য পরিস্থিতিতে, দান বৈষম্য দূরীকরণের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। ইসলামে স্বেচ্ছায় দানের জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “দান কখনো সম্পদ কমায় না” (সহিহ মুসলিম, ২৫৮৮)। এছাড়া ওয়াকফের মাধ্যমে বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান যেমন স্কুল, হাসপাতাল গড়ে তোলা হয় যা সমাজের দীর্ঘমেয়াদি কল্যাণে সহায়ক। সংশোধনমূলক কৌশলের তৃতীয় যে বিষয়টি নিয়ে বলা হয়েছে তা হলো রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
ইসলামি ব্যবস্থায়, রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে নাগরিকের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি এমন পরিবেশ তৈরি করা যেখানে বৈধ ব্যবসা ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হতে পারে। রাষ্ট্র জনগণকে সকল অসাধু কার্যকলাপ থেকে রক্ষা করবে এবং যাকাত ব্যবস্থার কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। ইসলামের এই নীতিগুলি শুধু দারিদ্র্য কমাতে সহায়ক নয়, বরং এটি একটি ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার মাধ্যমেও কাজ করে।
এভাবে ইসলামী অর্থনীতি ব্যক্তি ও সমাজকে একত্রিত করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামের এই সমন্বিত পদ্ধতি মানবতার কল্যাণে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে।
লেখক: শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগ, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ।
ইমেইল: ahrazu@aub.ac.bd