Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতির দায় শিক্ষকের

Icon

মুহাম্মদ মহিউদ্দীন

প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৮ পিএম

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতির দায় শিক্ষকের

শিক্ষক শব্দটি শুনলে আমাদের মানসপটে নানাভাবে শিক্ষকদের ছবি ভেসে উঠে। কারণ পরিবারের বাইরে একজন শিক্ষার্থীর সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ বা মিথস্ক্রিয়া হয় শিক্ষকের সাথে। একজন শিশুর প্রথম শিক্ষকের সাথে পরিচয় ঘটে প্রাথমিক বা প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর ধীরে ধীরে স্কুল, কলেজ এবং সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়।  শিক্ষকদের দেখতে দেখতে একজন শিশু যৌবনের উত্তাল সময়ে চলে আসে। একটি পূর্ণযৌবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে একজন শিক্ষার্থীর পরিচয় ঘটে। কাজেই, এই সময়টি এবং এই সময়ের সম্পর্ক বা এই সময়ের শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্ক অন্য সময়ের মানে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, বা উচ্চমাধ্যমিকের মত নয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একজন শিশু শিক্ষককে মূল্যায়নের বয়সে থাকে না। স্কুলেও অনেকটা সে রকম। কলেজে উঠার পর শিক্ষার্থীরা সম্পর্কের ব্যাপারে সচেতন হলেও নানা প্রতিযোগিতা, পড়াশোনার চাপ, ও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অবস্থানগত কারণে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তারা খুব বেশি উন্মুক্ত হতে পারে না বা হয় না। 

কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর শিক্ষার্থীরা অনেকটা মুক্ত আকাশে বিচরণ করে। উন্মুক্ত পরিবেশ, নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু-বান্ধব এবং অনেকটা পাঠ্যবই বিহীন শিক্ষাজীবন শিক্ষার্থীদেরকে মুক্তভাবে সব কিছু মূল্যায়ন করার সুযোগ করে দেয়। শিক্ষার্থীরা মূল্যায়ন করতে শুরু করে শিক্ষকদেরকেও। শিক্ষার্থীরা একজন শিক্ষকের সব কিছু মূল্যায়ন করে। যেমন কেমন লেকচার দেন, কিভাবে লেকচার দেন, কতক্ষণ লেকচার দেন অথবা কতটা তথ্যবহুল লেকচার দিচ্ছেন এমনকি শিক্ষকদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও শিক্ষার্থীদের আগ্রহ থাকে। এ সব বাহ্যিক মূল্যায়নের সাথে সাথে সে তার অধিকারের ব্যাপারেও সচেতন হয়ে উঠে। সে অবলোকন করে কোন শিক্ষক ঠিক মত ক্লাসে আসেন, কোন শিক্ষক তাদের সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষা নেন বা কোন শিক্ষক ক্লাস মূল্যায়ন বা ক্লাস টেস্ট নেন ইত্যাদি। আবার অনেক সময় দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা নানা ধরণের একাডেমিক সমস্যায় পড়ে। অনেকে ইন-কোর্স বা ক্লাস টেস্ট দিতে পারে না। অনেকে পারিবারিক সমস্যায় থাকে। এ সব ব্যাপারে অনেক সময় শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের সহায়তা চায়। এখানে অনেক শিক্ষকের আচরণ বা আন্তরিকতা পরিমাপ করে। এ ছাড়া আরও অনেক বিষয় আছে যেগুলো হয়তো আমি শিক্ষক হিসেবে ঠিক ধরতে পারছি না।   

এবার আসা যাক ক্লাসে। প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হল। অরিয়েন্টেশন হল। শিক্ষার্থীরা নতুন উদ্দীপনায় ক্লাসে আসতে শুরু করল। বিভাগের বেশিরভাগ শিক্ষক যথাসময়ে ক্লাস শুরু করলেন। কিন্তু কিছু শিক্ষক দেখা গেল ঠিকমত ক্লাস শুরু করলেন না। কেউ করলেন এক মাস পর। কেউ বা বললেন আমি আরও পরে শুরু করবো। তাহলে যে শিক্ষার্থীরা অধীর অপেক্ষায় থাকে ক্লাস করার জন্য তারা কী করবে? অথবা দেখা গেল বিনা নোটিশে অনেকে ক্লাসে আসছেন না। শিক্ষার্থীরা ক্লাসে এসে বসে আছে শিক্ষক ক্লাস নিতে আসবেন কিন্তু তিনি আসলেন না। অনেক সময় এমন হয়, শিক্ষককে মোবাইলে কল দিলেও তিনি ধরেন না। এভাবে শিক্ষার্থীরা ক্লাসের ব্যাপারে প্রথম বর্ষেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। অনেকের সপ্নভঙ্গ হয়। তারা যে ভালবাসা ও আগ্রহ নিয়ে ক্লাসে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলো তার কিছুই পেলো না। এভাবে একজন শিক্ষার্থী ক্লাসে অনিয়মিত হতে শুরু করে। একবার ক্লাস থেকে মন উঠে গেলে সে মনোযোগ ফিরিয়ে আনা অনেক কঠিন। এই চিত্র কেবল প্রথম বর্ষে নয়, পুরো শিক্ষাজীবনে শিক্ষার্থীরা এ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, শিক্ষকরা ঠিকমত ক্লাস না নিলেও ক্লাসে অনুপস্থিতির জন্য অনেক সময় শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারে না। আবার অনেক বিভাগ মোটা অংকের ফাইন নিয়ে পরীক্ষার অনুমতি দেয়। এ ব্যাপারগুলো শিক্ষার্থীদেরকে নানাভাবে ক্ষুব্ধ করে।   ক্লাস নিয়ে আরো অনেক প্রশ্ন আছে। অনেক শিক্ষার্থী কিছু শিক্ষককের ক্লাসে আগ্রহ পায় না। তারা মনে করে, এই শিক্ষক যথেষ্ট আন্তরিকতা কিংবা প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাস করান না। আবার দেখা যায় অনেক শিক্ষকের ক্লাস করার জন্য সকাল থেকে ক্যাম্পাসে বসে আছে। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, অনেক শিক্ষক ক্লাসে প্রশ্ন করলে বিব্রতবোধ করেন কিংবা তারা ক্লাসে প্রশ্ন করাকে নিরুৎসাহিত করেন। আবার অনেক শিক্ষক প্রশ্ন করলে রাগারাগি করেন। এভাবে শিক্ষার্থীরা নিজ বিভাগের শিক্ষকদেরকে মূল্যায়ন করে। আমি আগেই বলেছি, শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের সব ধরণের খবর রাখে।     

শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে আছেন ক্লাসের নির্ধারিত বিষয়বস্তুর উপর আলোকপাত না করে তার ব্যক্তিগত  অর্জন বা পারিবারিক গল্প করেন। শিক্ষার্থীরা তো শিক্ষকের অর্জন আর পারিবারিক গল্প শোনার জন্য ক্লাসে আসে না। অনেক শিক্ষক আছেন যারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। তারা ক্লাসে রাজনৈতিক আলাপ শুরু করেন। তার নিজের রাজনৈতিক অবস্থান কিংবা ক্ষমতার বর্ণনা দেন। শিক্ষকরা রাজনীতি করেন ঠিক আছে। সবার রাজনৈতিক মতবাদ থাকতে পারে। কিন্তু শিক্ষককে ভাবতে হবে ক্লাসে অনেক মতের শিক্ষার্থী আছে। তাদের কাছে তাঁর আলাপ গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। অনেক শিক্ষক আছেন যারা মুল চাকরির চেয়ে নিজের অর্পিত দায়িত্বকে মুখ্য বিবেচনা করেন। শিক্ষকের অন্যতম কাজ ক্লাস নেয়া, গবেষণা করা এবং ক্লাস সম্পর্কিত কাজ হলেও, অনেক শিক্ষক সহকারী প্রোক্টর, হাউস টিউটর, প্রভোস্ট, বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোন কাজকে বেশি প্রাধান্য দিতে দেখা যায়। অনেকে আছেন এ সব দায়িত্ব পেলে নানা অজুহাতে ক্লাসে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন বা কম যান। আবার অনেক শিক্ষক আছেন যারা হয়তো ছাত্রজীবনে সক্রিয় রাজনীতি করেছেন পরে শিক্ষক হয়েছেন। তারা অনেক সময় তাদের দলের বা মতের শিক্ষার্থীদেরকে নিজের অজান্তে কিংবা সজ্ঞানে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন যা সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভালভাবে নাও নিতে পারে। তাছাড়া অনেক রাজনীতিবিদ শিক্ষক ক্লাস বাদ দিয়ে নিজের দলের বা সংগঠনের কর্মীদের সাথে সময় কাটাচ্ছেন যা শিক্ষার্থীদের নজরে এসেছে। 

ক্লাসে লেকচার দেয়া ছাড়াও আরো অনেক সমস্যা আছে। যেমন যথাসময়ে সিলেবাস শেষ করা। একটি কোর্স বা বিষয়ের সিলেবাস থাকে যা নির্ধারিত সময়ে শেষ করার বাধ্যবাদকতা রয়েছে। কিন্তু দেখা গেল অনেক শিক্ষক সঠিক সময়ে সিলেবাস শেষ করলেন না। আবার অনেকে তিন মাস বা চার মাসে সিলেবাস শেষ করে দিলেন। অনেকেকে দেখা গেল পরীক্ষার আগে বেশি করে ক্লাস নিয়ে সিলেবাস শেষ করছেন। একটি সিলেবাস ডিজাইন করা হয় একটি শিক্ষাবর্ষের জন্য। তিন মাস বা পরীক্ষার আগে শেষ করার জন্য নয়। আবার অনেকে আছেন কয়েকটি ক্লাস নিয়ে সিলেবাস শেষ করে দেন। শিক্ষকদের এ সব আচরণ শিক্ষার্থীদেরকে মানসিকভাবে চাপে ফেলে দেয়। তাছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এখনো অনেকটা রাজা-প্রজার মত। আমাদের দেশে অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দেন না। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যে বন্ধু না হয়েও বন্ধুর মত তা অনেক শিক্ষক মানতে চান না। কিন্তু শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাছ থেকে কিছুটা আকাডেমিক আনুকূল্য আশা করে। তারা চান শিক্ষক তাদের সাথে আরো সহজভাবে মিশুক যা পশ্চিমা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখা যায়।  এ ছাড়া আরো অনেক বিষয় আছে যা শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্তরায়। উপরিউক্ত সমস্যাগুলো প্রকট হলেও শিক্ষার্থীরা এগুলো কাউকে বলতে পারে না বা কারো কাছে সমাধান পায় না। কারণ কেউ একা বা যৌথভাবে বিভাগের   সভাপতিকে জানালে সমাধান পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই বরং শিক্ষার্থীরা নানাভাবে হেনস্থার শিকার হতে পারে। কাজেই, শিক্ষকদের ব্যাপারে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ বা অসন্তোষ অমূলক নয়। কিছু শিক্ষকের ব্যাপারে ক্ষোভ বা অসন্তোষ আগেও ছিল এবং এখনো আছে। তাই, পরিবর্তিত পরিস্থিতে এ সবের কিছু নমুনা আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের নব্বইভাগ শিক্ষক নিয়ে শিক্ষার্থীদের কোন অভিযোগ না থাকলেও দশভাগের ব্যাপারে তাদের অভিযোগ আছে। শিক্ষার্থীরা এখন এর সমাধান চায়। 

সর্বশেষ, কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যখন দেশ উত্তাল তখন শিক্ষার্থীরা নিজ বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের  শিক্ষকদের কাছে তাদের সমর্থন আশা করেছিলো। তারা চেয়েছিল তাদের শিক্ষকেরা তাদের পাশে এসে দাঁড়াক কিংবা সামাজিক মাধ্যম বা পত্রিকায় লিখুক। কিন্তু যে সব শিক্ষক তাদের রাজনৈতিক কারণে কিংবা মানসিক দীনতার কারণে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে পারলেন না বা শিক্ষার্থীদের পক্ষে একটি শব্দ ব্যয় করতে পারলেন না তাদেকে কীভাবে শিক্ষার্থীরা আপন ভাববে! এ আন্দোলনে এক হাজার ছাত্র-জনতা প্রাণ হারিয়েছে। তাদের আন্দোলন ব্যর্থ হলে কী পরিস্থিতি হতো তা কল্পনাও করতে চাই না। আমি চাই, নতুন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক তৈরি হোক। এটা হতে হবে। এর কোন বিকল্প আমাদের হাতে নেই। 

আমাদের মনে রাখতে হবে, শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। হজরত মুহাম্মদ (স.)-কে আল্লাহ পৃথিবীতে মানব জাতির শিক্ষক হসেবে পাঠিয়েছিলেন। সক্রেটিসসহ পৃথিবীর অনেক মহান ব্যক্তি শিক্ষকতাকে মহিমান্বিত করেছেন। কাজেই, শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্পণ করার পর একজন শিক্ষকের উচিত শিক্ষকতার আদর্শকে ধারণ করা। কোন সন্দেহ নেই, বাংলাদেশে অনেকে “ঘটনাক্রমে” শিক্ষক হয়েছেন যারা হয়তো অন্য পেশায় যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যখন এসেই পড়েছেন, তখন আমাদের উচিত দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে শিক্ষার্থীদেরকে বিবেচনা করা এবং শিক্ষকতাকে লালন করা।      

সহযোগী অধ্যাপক, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ও পিএইচডি গবেষক, ফেরারা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতালি 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম