মারুফ কামাল খান
বাংলায় একটা প্রবচন আছে: ‘মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল’। ভারতের বুঝি সেই 'কুত্তা পাগল' হাল হয়েছে বাংলাদেশে মোদিশাহীর 'জানের জান' শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদি রেজিম আচানক ধপাস করে পড়ে যাওয়ায়।
এমনটা যে হতে পারে সেটা ছিল ভারতীয়দের কল্পনারও বাইরে। ইন্ডিয়ার সরকার, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, কূটনৈতিক বহর, নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশে ভীষণ রকম সক্রিয় 'মাইটি' বা বাহাদুর গোয়েন্দা সংস্থাও এ ব্যাপারে আগাম কিছুই জানতে, বুঝতে ও আঁচ করতে পারেনি। আর তাই হাসিনার পতন ও পালানোর সময় থেকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভারতীয় এস্টাব্লিশমেন্ট বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-বলয়ের প্রতিক্রিয়া উৎক্ষিপ্ত, বিক্ষিপ্ত ও খাপছাড়া বলেই মনে হচ্ছে।
শ্রীযুক্ত বাবু রাজনাথ সিংয়ের কথাই ধরা যাক। ভারতের দেশরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশে সংঘটিত ক্যুদেতা এবং এর পরবর্তী ঘটনাবলী, ফলাফল ও পরিণাম পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ ও খতিয়ে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন তাদের দেশের সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি। বাংলাদেশের এই পরিবর্তনকে নয়াদিল্লি যে খুবই গুরুতর বলে বিবেচনা করে তার ওপর জোর দেন সিংজী।
লখনৌতে গত পাঁচ সেপ্টেম্বর সামরিক অধিনায়কদের যৌথ অধিবেশনে দেয়া ভাষণে রাজনাথ বাবু বৈশ্বিক সংঘাতসমূহের ধারণাতীত গতিপ্রকৃতির উদাহরণ দিতে গিয়ে ইউক্রেন ও ইসরাইলের চলমান যুদ্ধের উল্লেখ করেন। তিনি বাংলাদেশের বদলে যাওয়া গতিপ্রকৃতিসহ উদ্ভূত ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর অগ্রসরচিন্তা ও প্রস্তুতির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
আরো অনেক কথাই বলেছেন রাজনাথ বাবু। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল আখ্যা দিয়ে তিনি তার দেশের সামরিক বাহিনীর প্রতি রণপ্রস্তুতির যে আহ্বান জানিয়েছেন তা' উপেক্ষা করার কোনো উপায় আমাদের নেই।
স্বল্পায়তনের প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি উপমহাদেশের শক্তিমান অতিকায় দেশটির সমরসজ্জার প্রকাশ্য এ আহ্বান কেন? বাংলাদেশ তো ভারতের প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতার প্রতি কোনো হুমকি হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং আমরাই আমাদের প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা নিয়ে শংকিত এবং নিজেদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাবলী নিরসনে ব্যস্ত।
হাসিনার ফ্যাসিবাদী রেজিম রাষ্ট্রের সব প্রথা ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে যাবার পর সামাজিক স্থিতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং আইনের শাসন প্রবর্তনে দায়িত্বশীলদের গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। এমন একটি সময়ে বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকে এহেন উচ্চারণ সুপ্রতিবেশীসুলভ নয় বরং চরম শত্রুভাবাপন্ন।
সিংজী কি তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশকে হুমকি দিলেন? ভয় দেখালেন? নাকি এটি বাংলাদেশে আকস্মিক 'প্যারাডাইজ লস্ট'-এর পর তাদের নার্ভাস রিয়্যাকশন বা ঘাবড়ে যাওয়া প্রতিক্রিয়া?
বাংলাদেশে রক্তঢালা ছাত্রগণঅভ্যুত্থানে যে রেজিম-চেঞ্জ হয়েছে, সে পরিবর্তন সম্পর্কে রাজনাথ বাবুর শব্দচয়নটা খেয়াল করার মতো। তিনি এটাকে ক্যুদেতা বলেছেন? আসলে কি তাই? ক্যুদেতা কোনো ইতিবাচক শব্দ নয়। চক্রান্ত ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে কোনো ক্ষুদ্র গোষ্ঠী একটি বৈধ সরকারের কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিলে সেটাকে ক্যুদেতা বলে। হালে ক্যুদেতা শব্দ দিয়ে মূলতঃ সামরিক অভ্যুত্থানকেই বুঝানো হয়ে থাকে। বাংলাদেশে কি সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে? মোটেও তা নয়।
দলীয় গুন্ডা, পুলিস, আনসার, সীমান্ত রক্ষী দিয়ে হাসিনা ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ছাত্র আন্দোলন দমাতে গেলে সারা দেশের ছাত্র-তরুণদের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষ তাদের সন্তানদের বাঁচাতে পথে নেমে এসেছিলেন। জনতার সন্মিলিত রুদ্ররোষে হাসিনার ওই সব ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর অস্ত্রের ভাষা অকেজো হয়ে পড়ে। তখন দেখা মাত্র গুলির হুকুম দিয়ে কার্ফ্যু জারি করে হাসিনা রাজপথে মোতায়েন করেন সশস্ত্রবাহিনী। দেশরক্ষার সৈনিকেরা নিরস্ত্র দেশবাসীর বুকে গুলি চালাতে অস্বীকার করলে ফ্যাসিস্ট ঘাতক হাসিনার ক্ষমতার খেল খতম হয়ে যায়।
গণভবন নামে দুর্গসদৃশ যে রাষ্ট্রীয় প্রাসাদবাসিনী ছিলেন হাসিনা, সেদিকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ছুটে আসতে থাকে। তখন তার জীবন রক্ষায় ক্ষমতা ছেড়ে তাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে সশস্ত্রবাহিনী। রক্তক্ষয় ও শোচনীয় পরিণতি এড়াতে হাসিনাকে নিরাপদ প্রস্থান বা সেফ এক্সিটের যে ব্যবস্থা তারা করে দিয়েছেন, তার জন্য বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতি হাসিনার এবং তার পরম মিত্র মোদিশাহীর চিরকৃতজ্ঞ থাকার কথা। অথচ সিংজী এই বন্দোবস্তকে ক্যুদেতা বলে চরম অসত্য উক্তি করেছেন।
এর মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার এক ঐতিহাসিক মহাজাগৃতিকেই অস্বীকার করেছেন। তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেছেন বাংলাদেশের গণমানুষের সন্মিলিত অভিপ্রায়, অঙ্গীকার, আকাঙ্ক্ষা ও অনুভূতির প্রতি। ভারতের মতো একটি বিশাল রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হয়ে তিনি হাসিনা নামের গণধিকৃত, খুনী, অত্যাচারী এক বিতাড়িত শাসকের প্রতি অন্ধ ভালোবাসার বশে ১৮ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত নিকট পড়শি দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন! মোদি সরকারের রাজনীতির এ এক আবেগসর্বস্ব অদ্ভুত নাবালকত্ব। কূটনীতির এই অপ্রত্যাশিত নালায়েকত্ব যত চটজলদি ঝেড়ে ফেলবে ততো বেশি লাভবান হবে ভারত।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এই কূটনৈতিক দেউলেপনায় মনে পড়ছে ১৯৯৭ সালের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। জ্যোতি বসু সে সময় ঢাকা সফর করছিলেন। তাকে ঘিরে তখনকার সরকার, আব্দুস সামাদ আজাদের নেতৃত্বাধীন ফরেন মিনিস্ট্রি, বামপন্থী দলগুলো ও মিডিয়ার মাতামাতি চলছিল। সে সময় এক বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে এলেন মণিশঙ্কর আয়ার। তিনি তখন কূটনৈতিক চাকরি ছেড়ে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দলে যোগ দিয়ে সক্রিয় রাজনীতি করছিলেন। পাশাপাশি কলামিস্ট হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছিলেন তিনি। ভারতের কেন্দ্রে তখন দেবগৌড়ার সরকার, কংগ্রেস বিরোধীদলে। এ অবস্থায় আমি বিস্মিত কণ্ঠে মি. আয়ারকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মিত্র জ্যোতি বাবুর সঙ্গে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন?
জ্যোতি বসু সম্পর্কে শ্লেষাত্মক কিছু উক্তি সহযোগে নেতিবাচক জবাব দিয়ে মি. আয়ার জানালেন, তিনি নিজের একটা গবেষণা কাজে এসেছেন। এরজন্য তিনি বাছাই করা কিছু বাংলাদেশী রাজনীতিক, কূটনীতিক, সাংবাদিক ও একাডেমিশিয়ানের ইন্টারভ্যু নিচ্ছেন।
যৌবনে মি. আয়ার বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছে। যারা জীবন দিয়েছে তাদের রক্তস্রোত একত্রে মিশে আছে এদেশের মাটিতে। তারপর ভারতের সেরা কূটনীতিকদেরকেই বরাবর বাংলাদেশে নিযুক্ত করা হয়েছে। এতো কিছুর পর দু'দেশের সম্পর্ক এমন 'মেস' হয়ে গেলো কেন? এটাই তার গবেষণার বিষয়বস্তু।
মণিশঙ্কর বাবুর মতে, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত কয়েকটি যুদ্ধ লড়েছে। সে দেশেও জনসাধারণের মধ্যে ভারত-বিরোধী মনোভাব আছে কিন্তু তা' বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি সহনীয়।বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের মনে ভারত-বিরোধিতা নয়, ভারতের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ ও ঘৃণা বিরাজমান।
আমি তার কথায় দ্বিমত না করে বললাম, কিন্তু এর কারণ অনুসন্ধানের জন্য আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন। ভারত সম্পর্কে এদেশের জনগণের বৈরী মনোভাবের কারণ আপনাকে খুঁজতে হবে নয়াদিল্লিতে, ঢাকায় নয়। বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মনোভাব ও আচরণের মধ্যেই এর কারণ নিহিত।
আমার কথায় তার মুখ কালো হয়ে গেলেও বুদ্ধিদীপ্ত সাবেক কূটনীতিক নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে কৃত্রিম হাসির প্রলেপ বুলিয়ে বললেন, আপনার এই মতামতকেও আমি পয়েন্ট হিসেবে নোট করে নিচ্ছি। আমার গবেষণায় এটিও একটি উপাদান হতে পারে।
আমি এখনো বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের মানুষ ভারতের কাছ থেকে ন্যায্য হিস্যা ও প্রাপ্যটুকু চায়। সমমর্যাদা নিয়ে সুপ্রতিবেশী হয়ে বাস করতে চায়। ভারতের সঙ্গে শত্রুতা করার সাধ্য ও ইচ্ছে কোনোটাই বাংলাদেশের নেই। তারা চায়, ভারতও যেন আমাদের সঙ্গে অহেতুক শত্রুতা, দাদাগিরি, আধিপত্য বিস্তার না করে, ঘরোয়া ব্যাপারে নাক না গলায় এবং আমাদের ন্যায্য হকটুকু গায়ের জোরে তারা খেয়ে না ফেলে। অথচ ভারত গোড়া থেকে তাই করে চলেছে।
১৯৭১ সালে আমাদের জনগণের স্বাধীনতার আকাঙ্খা ও পাকিস্তান ভাঙার ব্যাপারে ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থ একবিন্দুতে মিলেছিল। তারা আমাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়েছে এবং পাশাপাশি যুদ্ধ করেছে। এরজন্য বাংলাদেশ কৃতজ্ঞ। কিন্তু স্বাধীনতার ঊষালগ্ন থেকেই ভারতীয় আচরণ সেই কৃতজ্ঞতাকে ফিকে করতে শুরু করে।
মোটাদাগের কয়েকটি উদাহরণ দিই :
১.আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লগ্নে পাকিস্তানি ফৌজের সারেন্ডার অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীকে কারসাজি করে উপস্থিত হতে না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মহিমাকে ম্লান করে দিয়ে এটিকে ভারতীয় যুদ্ধজয় হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
২. আত্মসমর্পণকারী হানাদার বাহিনীর সব অস্ত্র, গোলাবারুদ, সামরিক সরঞ্জাম ও লুন্ঠিত মূল্যবান সামগ্রী ভারতীয় বাহিনী একতরফাভাবে নিয়ে যায়।
৩. পাকিস্তানের সঙ্গে শিমলা চুক্তি করে বাংলাদেশের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ভারত যুদ্ধাপরাধীসহ সব পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দেয়। পরে ত্রিদেশীয় দিল্লীচুক্তি বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়।
৪. পঁচিশ সালা মৈত্রীচুক্তি নামে এক অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে সই করিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব হরণ করা হয়।
৫. বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ভারত প্রবাসী 'মুজিবনগর সরকার'কে এক সপ্তাহ পর ঢাকায় আসতে দেওয়া হয়। এই সময়ে ভারতীয় বাহিনীর তদারকিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের সকল গুরুত্বপূর্ণ পদে পছন্দের লোকদের বসানো হয়। পরেও ভারতীয় 'পরামর্শক' ঢাকায় বসে অনেকদিন পর্যন্ত প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করে।
৬. কমিশনিংয়ের জন্য পরীক্ষামূলক ট্রায়ালের কথা বলে ভারত ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। বাংলাদেশের অনুমোদন ছাড়া এবং পানিবন্টনের কোনো চুক্তি না করেই ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে ৫১টিতেই উজানে বাঁধ দিয়ে ভাটির দেশ বাংলাদেশকে পানিবঞ্চিত করে।
৭. ভারত সরকার স্পষ্ট ভাষায় নির্দেশনা দেয় যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি হবে ভারতের পরিপূরক।
৮. ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক পট বদলের পর ভারত পলাতক আওয়ামী লীগারদের আশ্রয়, ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়ে 'কাদেরিয়া বাহিনী' গঠন করায় এবং এই বাহিনী বিভিন্ন স্থানে নাশকতা চালায় ও সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়।
৯. পার্বত্য অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী উপজাতীয় বিদ্রোহীদের ভারত আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে 'শান্তিবাহিনী' গঠন করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লেলিয়ে দেয়।
১০. বাংলাদেশের রাষ্ট্রদ্রোহী, সমাজবিরোধী ও পলাতক সন্ত্রাসীদের আশ্রয় ও মদত দেয়ার ব্যাপারে ভারত 'নিরাপদ স্বর্গ' হয়ে ওঠে।
১১.বাংলাদেশে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের মূল মদতদাতা হয়ে ওঠে ভারত।
১২. বাংলাদেশে ভারতের অপছন্দের সরকার ও দলের বিরুদ্ধে নাশকতা, উস্কানি ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সীমাহীন অপপ্রচারের হীনকৌশলে তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিকে বারবার হুমকিগ্রস্ত করেছে।
১৩. ভারত সবসময় বাংলাদেশে তাদের বাধ্যানুগত একটি সরকার স্থাপনে চক্রান্ত চালিয়ে গেছে৷ জনপ্রিয় রাষ্ট্রনায়ক জিয়া হত্যা, এরশাদের ক্ষমতা দখল, এক-এগারো সৃষ্টি, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় বসানো, পিলখানা হত্যাযজ্ঞ, প্রহসনের বিচারে ফাঁসি এবং হাসিনার আমলের গুম-খুন ও ভুয়া নির্বাচনে ভারতের মদতের স্পষ্ট আলামত ও বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ রয়েছে।
১৪. বাংলাদেশে 'সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখা'র ঝুঁকিপূর্ণ ভারতীয় নীতি থেকে সরে এসে সজ্জন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ২০১২ সালে হাসিনা সরকারের পাশাপাশি বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও একটি সুসম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেন। কিন্তু কংগ্রেসের দুঁদে নেতারা, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা, সাবেক কিছু প্রভাবশালী কূটনীতিক ও ভারতীয় মিডিয়া এর বিরোধিতায় 'ঝোপের দুই পাখির আশায় হাতের এক পাখি ছেড়ে দেয়া'র তত্ত্ব প্রচার করে। তাদের সর্বব্যাপী অপপ্রচার, চক্রান্ত ও কূটকৌশল ড. সিংয়ের উদ্যোগ ভণ্ডুল করে দেয়।
১৫. মোদি সরকার আরো উলঙ্গ ভাবে বাংলাদেশে ভারতীয় স্বার্থ ও সম্পর্ককে পুরোপুরি হাসিনাকেন্দ্রিক ও হাসিনানির্ভর করে ফেলে এবং বাদবাকি আর সব পক্ষকে খোলাখুলিভাবে শত্রুর কাতারে ঠেলে দেয়। মোদি ব্যক্তিগতভাবে আদানিসহ তাকে অর্থায়নকারী অসৎ ভারতীয় বণিকদের জন্য হাসিনার কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী নানান বাণিজ্যসুবিধা আদায় করে দেন। ক্ষমতায় রাখতে সহায়তা দেয়ার বিনিময়ে হাসিনার কাছ থেকে মোদি বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অসংখ্য চুক্তি আদায় করেছেন। আর হাসিনা চরম নির্লজ্জভাবে ঘোষণা দিয়েছেন, ভারতকে যা দিয়েছে তা তাদের আজীবন মনে রাখতে হবে।
১৬. ভারতে সংখ্যালঘুদের জান-মাল-সম্ভ্রম ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ভয়ঙ্কর ভাবে বিপন্ন, বাবরী মসজিদ সহ মুসলমানদের অগণিত উপসনালয় তারা ধ্বংস ও দখল করেছে, দাঙ্গা বাঁধিয়ে মুসলিম নিধন সেখানে অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। সেই ভারত বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের অতিরঞ্জিত বিবরণ অনবরত প্রচার করে যাচ্ছে। সংখ্যালঘু হিন্দুরা বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার দায়িত্ব বাংলাদেশের। ভারতের কর্তব্য তাদের দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
আধুনিক কূটনীতি হচ্ছে দু'দেশের পারস্পরিক মর্যাদা বজায় রেখে 'উইন উইন সিচুয়েশন' তৈরি করা। কিন্তু মোদির ভারত মধ্যযুগীয় সামন্ত কায়দায় বাংলাদেশে এক স্বার্থান্বেষী, কূটকৌশলী, ব্যক্তিনির্ভর ও জনবৈরী কৌশলে একতরফা ভাবে কেবল নিয়েই গেছে। হাসিনার পতনে তাদের সে কৌশলও মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছে এবং শত্রুতা, চাপ ও হুমকির মাধ্যমে এ বিপর্যয় থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে। এই কৌশল ভারতের জন্য যে হিতে বিপরীত হবে তা' আমি দিব্যি দিয়ে বলতে পারি।
এখন আর আগের দিন নাই। সামন্ত কায়দা ছেড়ে ভারতকে আরো আধুনিক, স্মার্ট ও বাস্তববাদী হতে হবে বাংলাদেশের ব্যাপারে। কোনো রকমের সামরিক অ্যাডভেঞ্চারের দিবাস্বপ্ন তাদের মাথা থেকে দ্রুত ঝেড়ে ফেলতে হবে।
পাকিস্তানের কাছ থেকে বাংলাদেশ যে যৎকিঞ্চিৎ গোলাবারুদ কিনতে যাচ্ছে তা নিয়ে ভারতের মতো বিশাল সমরশক্তির আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। চীন আর পাকিস্তান থেকে এসব কেনার মধ্যে খুব বেশি তফাত নেই। ভারত নিজেও তো রাশিয়ার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইটালি ও বৃটেনের কাছ থেকেও সমরাস্ত্র কিনে থাকে৷
ভারতের মাথায় রাখতে হবে, বাংলাদেশের তুলনায় তাদের ভূখন্ডেই অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি বেশি। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতের সপ্তকন্যা অঞ্চলকে শান্ত ও নিরাপদ রাখতে বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তেজনার বদলে আন্তরিক সৌহার্দ্য স্থাপনই বুদ্ধিমানের কাজ।
বাংলাদেশের বিকাশমান ক্রয়ক্ষমতার উদীয়মান মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী ভারতীয় পণ্যের ক্রেতা। এ বাজার হারাতে না চাইলে ভারতকে গুড সেলসম্যানশিল শিখতে হবে৷ এখন পর্যন্ত তারা খুব বাজে বিক্রেতা। বাংলাদেশকে ক্রেতার মর্যাদা দেওয়াটাও শেখেনি তারা।
শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে তাকে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহারের যে ফন্দি ভারত এঁটেছে সেটাও খুব কাঁচাবুদ্ধির কাজ হয়েছে। তার ব্যাপারে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারপ্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের পরামর্শ শুনলে ভারত ভালো করবে।
ভারত গায়ে-গতরে বিশাল। এ অঞ্চলে তাদের আকৃতি হস্তিতুল্য। পারমাণবিক শক্তিধর ভারতের সামরিক সামর্থও তাৎপর্যপূর্ণ। অর্থনীতিও মস্ত বড়ো তাদের। কিন্তু আধুনিক যুগে কেবল শক্তিমত্তা থাকলেই যা খুশি তা করা যায় না। শক্তিপ্রদর্শনের যে-কোনো ভাবনায় আঞ্চলিক সমীকরণ ও বৈশ্বিক বাস্তবতাবোধকে উপেক্ষা করা যায় না।
ভারত ও মোদির আন্তর্জাতিক প্রভাবের কথা আমরা জানি। ভারতকেও জানতে ও মানতে হবে যে, বাংলাদেশের হাল ধরেছেন যে ক্যাপ্টেন, সেই নোবেল লরিয়েট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও গ্রহনযোগ্যতার পাল্লাও কিন্তু কম ভারী নয়। ১৮ কোটি দেশপ্রেমিক জাগ্রত মানুষের দেশে তিনি যে এখন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার একটি বড় স্তম্ভ ভারতের তা না বুঝার কথা নয়। অতএব, সাধু সাবধান!
লেখক: সাংবাদিক ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেসসচিব