Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

কওমি সনদ কার্যকর হচ্ছে না কেন?

Icon

বেলায়েত হুসাইন

প্রকাশ: ২৯ আগস্ট ২০২৪, ০৯:৫৮ পিএম

কওমি সনদ কার্যকর হচ্ছে না কেন?

দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকে প্রতি শিক্ষাবর্ষে অসংখ্য শিক্ষার্থী দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। গত বছর এর সংখ্যা ছিল ৩১ হাজার ৯৯৯ জন। যাদের মধ্যে পাস করেন অন্তত ৮৮.৩৭ শতাংশ। 

আগে-পরে মিলিয়ে দেশে বর্তমানে কওমি মাদ্রাসা থেকে আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা সম্পন্নকারীদের সংখ্যা অনেক। এই বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী একসময় সরকারি মতে- শিক্ষিত ছিলেন না। পরে সদ্যপতিত সরকারের শাসনামলে ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট দাওরায়ে হাদিসের (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স ডিগ্রির (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) সমমান দেওয়া হয়। ওই দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভার বৈঠক এ অনুমোদন দেয়। 

কওমি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ দিনের দাবি সনদের স্বীকৃতির কার্যকারিতা এখনও বাস্তবে দেখা যায় না। অর্থাৎ এই সনদধারী কেউ এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো সরকারি চাকরিতে সুযোগ পাননি।

কওমি মাদ্রাসা থেকে পড়াশোনা সম্পন্নকারীরা রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে চাকরির আশা করেন না; বরং তাদের দাবি এতটুকুই যে, যে বিষয়ের (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি) ওপর তাদের মাস্টার্সের সমমান স্বীকৃতি দেওয়া হলো, সরকারি সেসব সেক্টরে অন্তত তাদের চাকরির সুযোগ দেওয়া হোক। 

তারা মনে করেন- এতে যেমন কওমি শিক্ষাসমাপনকারীদের বড় একটি অংশের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, তেমনি রাষ্ট্রও সৎ, আমানতদার ও আন্তরিক একঝাঁক কর্মী পাবে। কিন্তু স্বীকৃতির পর বিগত সরকারের আমলে এ বিষয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনার কিংবা ব্যক্তি পর্যায় থেকে বিষয়টি নিয়ে দাবি জানালেও কওমি স্বীকৃতির কার্যকারিতা আলোর মুখ দেখেনি। 

এটি আলোর মুখ না দেখার ক্ষেত্রে যে বোর্ডের (আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামি‘আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ) অধীনে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, সেটির কর্মকর্তাদেরও দায় দেখেন তরুণ আলেমরা। আলেমদের সমন্বয়হীনতার কারণে কওমি সনদকে কার্যকর করার বিষয়ে সরকারেরও তৎপরতা দেখা যায়নি। 

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি অঙ্গনে। এবার সেই ধারাবাহিকতায় কওমি স্বীকৃতির বর্তমান অবস্থারও ‘পরিবর্তন’ চাইছেন দেশের কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও। তাদের দাবি- খুব শিগগিরই কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে বাস্তব ক্ষেত্রগুলোতে কার্যকর করা হোক। 

এ প্রসঙ্গে দেশের অন্যতম শীর্ষ ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম ঢাকার (মসজিদুল আকবার কমপ্লেক্স) সিনিয়র শিক্ষক মুফতি মাসুম বিল্লাহ বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার করতে এবং সমাজের মন-মগজে যথাযোগ্য স্থান পেতে প্রতিভা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়। আর এজন্য দরকার স্বীকৃতি ও তার কার্যকারিতা। সময় যেহেতু কাউকে আগ বাড়িয়ে স্বীকৃতি দেয় না। তাই আমি মনে করি- যত দ্রুত সম্ভব কওমিয়ানদেরও সেটা আদায় করে নিতে হবে। আর আমি বর্তমান সময়টিকে কওমি সনদের স্বীকৃতির কার্যকারিতা অর্জনের মোক্ষম সুযোগ মনে করছি। কারণ, দেশে এখন বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিপ্লব চলছে।’

এ বিষয়ে রাজধানীর বৃহৎ আরেকটি কওমি মাদ্রাসা জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষাসচিব মুফতি মামুন আব্দুল্লাহ কাসেমী বলেছেন, স্বীকৃতির পর কর্মক্ষেত্রে কওমি সনদের কার্যকারিতা না থাকা স্বীকৃতি না থাকারই নামান্তর। আসলে এ প্রসঙ্গে অনেক কথা বলা যায় কিন্তু একটি মৌলিক কথা হলো- কর্মক্ষেত্রে কওমি সনদের বহুমুখী কার্যকারিতায় দেশেরই বরং বেশি লাভ হবে। কওমিয়ানদের উপযোগী ক্ষেত্রগুলোতে যদি সরকার তাদের কাজের সুযোগ দেয়, তাহলে সততায় তারা দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে আশা করি। এজন্য আমি চাই- এবার বৈষম্য দূর হোক এবং কওমির সন্তানরা তাদের অধিকার লাভ করুক।’

মুফতী মাসুম বিল্লাহও চান যে, কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা বজায় রেখে রাষ্ট্র এটার স্বীকৃতি কার্যকর করুক। তার মতে- ‘এটিও একটি শিক্ষাব্যবস্থা। এই বিশেষায়িত শিক্ষার সঙ্গে অনুকূল ও যথাযোগ্য ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগ পাওয়াটা কওমিয়ানদের নাগরিক অধিকার।’

রাজধানীর সর্ববৃহৎ কওমি মাদ্রাসা জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলূম ফরিদাবাদের শিক্ষক মাওলানা মানযুর হাসান যুবায়ের বলেছেন, ‘ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র নতুন সময়ে প্রবেশ করেছে। সবাই দেশকে এগিয়ে নিতে ও ঢেলে সাজানোর স্বপ্ন দেখছে। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের উচিৎ দুর্নীতি, অনাচার, জুলুম-নিপীড়নের শিকার উপড়ে ফেলতে কওমি উলামায়ে কেরামকে দেশের কাজে লাগানো এবং এখনই তার উপযুক্ত সময়।’

তার মতে- ‘কওমি উলামায়ে কেরামের মধ্যে যেমন সততা, বিশ্বস্ততা, ন্যায়নীতি ও খোদাভীতি আছে, তেমনি তাদের মধ্যে দেশপ্রেম, দায়িত্ববোধ ও কর্মদক্ষতা আছে। সুতরাং স্বীকৃতি কার্যকর করা হলে কওমি উলামায়ে কেরাম যতটুকু উপকৃত হবেন, রাষ্ট্র ও জনসাধারণ তারচেয়ে অনেক গুণ বেশ উপকৃত হবে ইনশাআল্লাহ।’

২০১৮ সালে সরকার তাকমীলের সনদকে ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবির ওপরে মাস্টার্সের সমমান দিলেও স্বীকৃতির সময় এই সনদধারীদের সরকারি চাকরির ক্ষেত্র নির্দিষ্ট করা হয়নি। এজন্য কওমি শিক্ষাসমাপনকারীরা নিজেরাও হয়ত জানেন না যে, আসলে সরকারের কোন বিভাগগুলোতে তাদের চাকরির সুযোগ রয়েছে?

কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ সংস্থা ‘আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’র সিনিয়র সদস্য মুফতি নুরুল আমিন এর আগে গণমাধ্যমকে কওমি মাদ্রাসার মুরব্বিদের সূত্রে জানিয়েছিলেন, ‘কোন কোন ক্ষেত্রে কওমি সনদধারীরা সরকারি চাকরি গ্রহণ করবেন, সেটা নিয়ে তারা ভাবছেন। এ ব্যাপারে সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা পেশ করা হবে বোর্ডের পক্ষ থেকে। সেই অনুযায়ীই নির্ধারিত হবে কওমি সনদধারীদের সরকারি চাকরির ক্ষেত্র।’ 

এই উদ্যোগ কতটুকু বাস্তবায়ন করে গেছেন, তার কাছ থেকে সেটি এখন আর জানার সুযোগ নেই। 

তবে আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’র প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য মাওলানা মুসলেহুদ্দীন রাজু জানিয়েছেন, ‘ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি ভাষায় মাস্টার্স সম্পন্নকারীরা যেসব জায়গায় কাজ করতে পারেন, আমাদের ছেলেদেরও সেসব জায়গায় সুযোগ পাওয়ার কথা।’

তিনি বলেন, ‘আসলে আমাদের স্বীকৃতিটাই তো এখনও কমপ্লিট হয়নি। বাকি কাজগুলো তো পরে (চাকরির ক্ষেত্র নির্ধারণ ইত্যাদি)। ওটা (স্বীকৃতি) কমপ্লিট হলে আমাদের বিভিন্ন কথাবার্তা ও দাবি-দাওয়া আছে। আমাদের একটা সাব কমিটি আছে। তারা বিগত সরকারের বিভিন্ন বিভাগে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু ভালো কোনো ফলাফল হয়নি। রাষ্ট্র স্থিতিশীল হলে আমাদের দায়িত্বশীলরা মিটিংয়ে এ ব্যাপারে আলোচনা করবেন।’ 

একই কথা বলেছেন সংস্থাটির আরেক সদস্য মুফতি মোহাম্মদ আলীও। তিনি বলেছেন, ‘আমরা এখনও বৈঠকে বসতে পারিনি। বৈঠক হলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা যাবে।’

পরিবর্তনের চলমান এই সময়ের মধ্যে কওমি শিক্ষাসমাপনকারীদের চাকরি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সরকারের কাছে কোনও দাবি জানাবেন কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে মাওলানা মুসলেহুদ্দীন রাজু বলেন, ‘এখন দাবিদাওয়া পেশ করার একটা সুযোগ এসেছে। আগে এ দাবিগুলো অনেকে করতে পারেননি। সুতরাং সুযোগ পেলেই সরকারের কাছে দাবিদাওয়া পেশ করা হবে।’ 

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম