Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

পরিবেশ সংরক্ষণে একাধিক আইন থাকলেও নেই সঠিক বাস্তবায়ন

Icon

সম্পাদকীয়

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৪, ১২:১৪ পিএম

পরিবেশ সংরক্ষণে একাধিক আইন থাকলেও নেই সঠিক বাস্তবায়ন

একটি শিশুর পুষ্টি ও বিকাশের জন্য মায়ের দুধ যেমন অপরিহার্য, ঠিক একইভবে পরিবেশ রক্ষা ও সৌন্দর্য্যমণ্ডিত করতে বৃক্ষ অপরিহার্য। পরিবেশকে শান্ত, শীতল ও মনোমুগ্ধকর করে রাখে মাটি থেকে বেড়ে উঠা বৃক্ষ, যা আমাদের চারপাশকে জীবন্ত করে তোলে। অথচ এই বৃক্ষগুলোকেই আমরা কারণে অকারণে প্রতিনিয়ত নিধন করছি নানা উপায়ে। 

আমরা এটাও জানি যে বৃক্ষ নিধনের প্রভাব পরিবেশে গভীর ও বহুমুখী। বৃক্ষ নিধনের ফলে সৃষ্ট আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে বৃদ্ধি পেয়েছে বজ্রপাতের মতো দুর্যোগ। সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, সার্ক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে বজ্রপাতজনিত মৃত্যুর হার সর্বাধিক। এ ছাড়াও আমেরিকান গবেষকদের পর্যালোচনা অনুসারে,  বিশ্বব্যাপী বজ্রপাতজনিত প্রাণহানির ঘটনার মধ্যে, বাংলাদেশে এই মৃত্যুর সংখ্যা মোট মৃতের এক-চতুর্থাংশ।

১৯৪৭ সালে, দেশের প্রায় এক চতুর্থাংশ বনে আচ্ছাদিত ছিল যা দেশের আয়তনের ২৪ শতাংশ। ১৯৮০ সালের মধ্যে, এটি প্রায় এক-ষষ্ঠাংশে নেমে আসে যা ১৭.২২ শতাংশ।  এবং এখন এটি বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৫.৫৮ শতাংশ। দেশের প্রায় অর্ধেক এখনও বনে আচ্ছাদিত, কিন্তু এর মধ্যে বন বিভাগ নিয়ন্ত্রিত বনভূমির পরিমাণ ১০.৭৪ শতাংশ।

বাংলাদেশে বায়ু দূষণজনিত কারণে মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক। তথ্য অনুসারে, মোট বায়ু-দূষণজনিত মৃত্যুর ১৮% হলো ৫ বছরের কম বয়সি শিশু এবং ২২% হলো ৭০ বছরের বেশি বৃদ্ধদের। যার ফলে দেশের গড় আয়ু ২.৯ বছর কমে গেছে।

গাছের অভাবে অক্সিজেনের স্বল্পতা এবং বায়ু দূষণ বৃদ্ধির কারণে পরিবেশে একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। একটি ত্রিশ বছরের বৃক্ষ প্রতিদিন গড়ে ৫০০ লিটার অক্সিজেন সরবরাহ করতে সক্ষম হয় যা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্য অনুসারে, একটি গাড়ি ২৫ হাজার কিলোমিটার চলার পর যে দূষণ হয় তা অকপটেই একটি বড় বৃক্ষ শোষণ করতে সক্ষম হয়। প্রচলিত ধারণার বিপরীতে, সৌন্দর্য্য বর্ধনের নামে গাছগুলোকে উন্নয়নের নিচে পিষে ফেলা হচ্ছে। যা কিনা প্রতিনিয়ত  পরিবেশের স্বাস্থ্য ও প্রাণীজীবনের নিখরচারের কারণ হয়ে উঠছে। পরিবেশের সুরক্ষা ও বায়ুগতিকে বান্ধবভাবে ব্যাপক উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি আকারে বৃক্ষ নিধন কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

আমাদের আইন বিভাগ অনেক পদক্ষেপ নিলেও গাছ কাটার জন্য যে শাস্তি বা জরিমানা ধার্য করেছে  তার সঠিক বাস্তবায়ন কতটুকু সেটা আমরা সবাই জানি। আইনের সুস্পষ্ট বিধান থাকা সত্ত্বেও, অনেকেই গাছ কাটাকে যথেষ্ট গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করেন না। এ কারণে আইন প্রয়োগে পর্যাপ্ত কঠোরতা দেখা যায় না। 

বর্তমানে আমাদের দেশে প্রায় ১৮৫টি পরিবেশ সংক্রান্ত আইন বিদ্যমান রয়েছে, যেগুলো প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ উভয়ভাবেই পরিবেশ সংরক্ষণের প্রশাসনিক ও আইনি পদক্ষেপকে সমর্থন করে। এই আইনগুলির মধ্যে অ্যাক্ট, বিধি, নীতি, চুক্তি এবং অধ্যাদেশ রয়েছে। এছাড়াও বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত ২০টি আন্তর্জাতিক কনভেনশন, চুক্তি ও প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছে, যা বাংলাদেশের পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক মান ও স্ট্যান্ডার্ড অনুমোদনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে, ১৯৯৫ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও ১৯৯৭ সালে পরিবেশ দূষণ বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। আরও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে, ২০০০ সালে পরিবেশ আদালত আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিচারিক আদালতে বিশেষায়িত পরিবেশগত ন্যায়বিচার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। দেশের প্রতিটি বিভাগে এক বা একাধিক পরিবেশ আদালত এবং সারা দেশের জন্য এক বা একাধিক পরিবেশ আপিল আদালত প্রতিষ্ঠার বিধান আইন অনুসারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরবর্তীতে ২০১০ সালের পরিবেশ আদালত আইন প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু, দুঃখজনকভাবে উল্লেখ করতে হয় যে, এই আইনে সাধারণ জনগণের সরাসরি মামলা দায়েরের অধিকার প্রদান করা হয়নি।

প্রতি বছরই আমরা দেখতে পাই বৃক্ষরোপণ বৃক্ষচ্ছেদন নিয়ে “একটি গাছ একটি প্রাণ” , “বৃক্ষ লাগাই ভূরি ভূরি তপ্ত বায়ু শীতল করি”, “ফলবৃক্ষ করব চাষ, কাটব না আর একটি গাছ”, “বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, গাছ কাটলে সর্বনাশ”, প্রভৃতি স্লোগানসমূহ পরিবেশ দিবসগুলিতে প্রচুর ব্যবহৃত হলেও, প্রকৃতপক্ষে সমাজে এর প্রভাব বা যথাযথ বাস্তবায়ন মটেও দৃষ্টিগোচর নয়।

২০১২ সালের বৃক্ষ সংরক্ষণ বিল অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি সরকারের অনুমতি  ছাড়া বনে, রাস্তার পাশে বা সর্বজনীন স্থানে বৃক্ষ কর্তন করে, তাহলে তার সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানা প্রদানের বিধান রয়েছে।

বিলের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, সরকার জনজীবনের অঞ্চলের যে কোনো গাছ বনভূমি, সরকারি বনভূমিকে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে বিধি দ্বারা নির্ধারিত সংরক্ষণযোগ্য গাছ হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে।

বিলের ৪ ধারার ২ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, সরকার যদি সংরক্ষণযোগ্য কোনো গাছ কাটার অনুমতি প্রদান করেন। তবে শর্তসাপেক্ষে  প্রতি একটি গাছ কাটার  বিপরীতে তিনটি নতুন গাছ রোপণের নিশ্চয়তা দিতে হবে। 

বনশিল্প উন্নয়ন করপোরেশন আইন, ২০২২ অনুযায়ী,  সরকারি গাছের পাশাপাশি যে কোনো ব্যক্তি মালিকানার বড় গাছ কাটতেও সরকারের অনুমতি অপরিহার্য। তবে বাস্তবে কতজন এই অনুমতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন সেটিই এখন পর্যবেক্ষণের বিষয়। 

এছাড়াও প্রস্তাবিত আইনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বা উপড়ে যাওয়া যে কোনো গাছ স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করে সরানো যেতে পারে।

বিলে উল্লিখিত ৫ ধারায় বলা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তি এই আইন লঙ্ঘন করলে বা সহায়তা প্রদান করলে, সর্বোচ্চ তিন মাস কারাদণ্ড এবং ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার দণ্ডে দণ্ডিত হবে।

এত এত আইন, বিধিমালা থাকা সত্ত্বেও, শুধু কার্যকর প্রয়োগের অভাবে আমরা এইসব থেকে প্রত্যাশিত সুফল পাচ্ছি না। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে সরকার বিভিন্ন আইন প্রণয়নসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে এর বেশিরভাগই কেবল নথিপত্রেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযান পরিচালিত হলেও তাদের ফলাফল প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। কাজেই, শুধু আইন প্রণয়ন করলেই চলবে না; একইসাথে এর সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করাও আবশ্যক।

অপরাজিতা সাহা স্বর্ণা
এল.এল.এম (রাবি)

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম