Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

স্মৃতিচারণ: ‘সেই সবুজ’

Icon

মোহাম্মদ নূরল হক

প্রকাশ: ০৮ মে ২০২৪, ০৬:০৫ পিএম

স্মৃতিচারণ: ‘সেই সবুজ’

এক সময় এলাকার মূল বেচাকেনা, লেনদেন, পণ্যের বিনিময়ে পণ্য, ঋণ-মহাজন, আত্মীয়-স্বজন, জামাই-শ্বশুরের সাক্ষাৎ, জরুরি তথ্য বিনিময় ইত্যাদি হতো হাট বা বন্দরে। নদীর ঘাট ঘিরে আবর্তিত হতো বন্দর আর সেখানে পণ্য আসতো নৌকা, লঞ্চ বা স্টিমারে। গাড়ি-ঘোড়া, গাধার বাহনে বা হেঁটে মালামাল আসতো হাটে। তাই হাট বসতো সমতল ভূমিতে। আবার কোথাও কোথাও এই হাট, গঞ্জ বা বন্দর স্থাপিত হতো রেলওয়ে স্টেশনকে ঘিরে। যেমন বৃহত্তর ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ, খুলনা জেলার বাগেরহাট এবং সর্ব উত্তরে সীমান্তবর্তী ডিমলা থানার অন্তর্গত বুড়িতিস্তা নদীর সন্নিকটে পচারহাট। 


সাধারণত বন্দর খোলা থাকে ২৪ ঘণ্টা। হাট বসে সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে। হাট ও বাজারের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। বাজার হচ্ছে দৈনন্দিন সদাই কেনাকাটার স্থান, আর হাট বসে সপ্তাহে এক-দুই দিন। বাজারে যা পাওয়া যায় না, হাটে তা পাওয়া যায়। জরুরি প্রয়োজনে অন্য দিনগুলোতে আশপাশের হাটে যেতে হতো। আবার কিছু হাট দেখেছি শুধু রাতেই বসে। সারারাত জমজমাট, সূর্য উঠার পর প্রায় জনশূন্য, সুনসান। শুধু পড়ে আছে মহাজনের গদিঘর, সদ্য নির্বাপিত দ্বীপশিখা আর বিক্রীত মালামালের অবশিষ্ট বা অবিক্রীত পণ্যের ক্ষুদ্রাংশ ও পরিত্যক্ত মালামালের সোদা গন্ধ। 

সারারাত হাটে যারা ছিল খুব ব্যস্ত, তাদের অনেকে এখন ঘটি হাতে প্রাকৃতিক কর্ম সারতে ব্যস্ত। কুলি মজুরের এলিয়ে দেওয়া শরীর আর উপার্জন নিয়ে দুশ্চিন্তা। কারো কারো মুখে ক্লান্তির সাথে দুশ্চিন্তার ছাপ। চাল, লবণ, তেল কিনে তবেই যেতে হবে বাড়িতে, তবেই উনুনে বসবে হাঁড়ি। পরিবারের মুখে জুটবে অন্ন, কিন্তু তার জোগাড় হয়নি। তাই মহাজনের দ্বারে হাত পাতা বা ধার নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। বাড়িতে বৃদ্ধ পিতা-মাতা এবং অবুঝ শিশুরা অপেক্ষায় আছে কখন জুটবে দুটো ভাত। হয়তো সারা দিনের মতো একবার। আয় হলে পেট ভরবে দুবেলায়। 

যাই হোক, রাতের হাটের কথা বলতে এই মুহূর্তে মনে পড়ে গেল পাবনার চাটমোহর রেলস্টেশন সংলগ্ন হাটের কথা। সারারাত চলনবিল এলাকার পণ্য সম্ভারে উপচেপড়া প্রাঙ্গণ, তবে অধিকাংশই বিল থেকে আসা মাছ। কিন্তু সকাল হলেই ফাঁকা। শুধুমাত্র রেল কোম্পানির কর্মচারী এবং যাত্রী সাধারণের আনাগোনা। রাতের হাটের কে কোথায় এখন বলা ভার, আসুক সন্ধ্যা তখন দেখবেন। ১৯৮২ সালে নবগঠিত উপজেলা চাটমোহরের প্রথম মুন্সেফ-ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বর্ণিত দৃশ্য উপভোগ ও দর্শন করার সুযোগ আমার হয়েছিল।

এর প্রায় ২০ বছর পর ২০০২ সালে পিরোজপুর জেলার জিয়ানগর থানাধীন কচা নদীর তীরে মৎস্য বন্দর পাড়ের হাটে গিয়েছিলাম। বিকাল থেকে মাছের ট্রলার আসতে শুরু করে। শুরু হয় খালাস, বেচাকেনা। বরফের কল যেন প্রতিদিনের মতো প্রাণ পায়। বরফ ছাড়া বিক্রীত মাছ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাবে কি করে। সে কি হইচই, রৈ রৈ ব্যাপার। ক্রেতা, বিক্রেতা, মহাজন, ট্রলারের মাস্টার-চুকানির ব্যস্ততা। দালাল-ফড়িয়া। হরেক রকম মাছ এবং শুধুই মাছ। সবই সামুদ্রিক। দুই একটা নয়, মাছের পালা টনকে টন ডাক হচ্ছে গোটা লট। 

খুচরা বিক্রি নাই, শুধু পাইকারি। অনেকের মুখে শুনে রাতের এই কর্মযজ্ঞ দেখতে এক ভোরবেলায় গিয়ে হাজির হলাম। আমি তখন পিরোজপুরের জজ। নদীর দক্ষিণপাড়ে গাড়ি রেখে নৌকায় কচা নদী পার হয়ে হাটে। আমার দরকার নমুনা হিসেবে বড়জোর দুই-চার কেজি রূপচান্দা বা কুরাল মাছ। কিন্তু কেনার কোনো উপায় নাই। কিনতে হবে গোটা পালা, একসাথে পাঁচ-দশ মণ। খুচরা ক্রেতার খুবই আফসোস। মহাজন, ব্যাংকার, হাট কমিটির সদস্যরা স্যারকে নিয়ে ব্যস্ত। কি মাছ নিবেন স্যার, স্যারের অবস্থা তখন শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মুজতবা আলীর কাবুলের বাবুচির মতো, যাকে লেখক পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন প্রবাস বন্ধু আব্দুর রহমান হিসেবে। আব্দুর রহমান সম্পর্কে দেশে-বিদেশের লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী এভাবে বর্ণনা করেছেন-

‘কাবুল শহরে আমি দুটি নরদানব দেখেছি। তার একটি আব্দুর রহমান। পরে ফিতে দিয়ে মেপে দেখেছিলুম ছয় ফুট চার ইঞ্চি লম্বা। দুখানা হাত হাঁটু পর্যন্ত নেমে এসেছে, আক্সগুলগুলো দু-কাঁদি মর্তমান কলা হয়ে ঝুলছে। পা দুখানা ডিঙ্গি নৌকার সাইজ।’

প্রথম খাওয়ার পরিবেশন দেখে লেখকের চক্ষু ছানাবড়া। প্রায় ছয়জনের রান্না। মনিবকে বিস্ময় নয়নে তাকাতে দেখে আব্দুর রহমান তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে অভয় বাণী দিল। বললো হুজুর, রান্নাঘরে আরো আছে। 

‘একজনের রান্না না করে কেউ যদি তিনজনের রান্না করে তবে তাকে ধমক দেওয়া যায় কিন্তু যদি ছয়জনের রান্না পরিবেশন করে বলে রান্নাঘরে আরো আছে, তখন আর কি করার থাকে? অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর।’
পাড়ের হাটের ওই শুভ্র সকালে আমার সেই অবস্থা।
 
-২-

যাই হোক, লক্ষ্য করলাম সকল আড়তদারদের অনুরোধ বা মন রক্ষা করার জন্য একটা করে মাছ নিলেও দাঁড়াবে এক মণের ওপর। ফলে মাছ নেওয়ার সুপ্ত ইচ্ছা ত্যাগ করতে হলো। তবে মূল উদ্দেশ্য রাতের বন্দর দর্শন সফল হলো কিন্তু মাছ কেনা হলো না।

এরকম শত সহস্র হাট আছে বঙ্গদেশে। বাংলাদেশে তার একটি পচারহাট। 
হাটের মূল স্থাপনায় আছে মারোয়ারীর বাসা, দোকান-গদিঘর, গুদামঘর, দুধেল গাভীর গোয়ালঘর ইত্যাদি। এনারা মাছ-মাংস ভক্ষণ করেন না, তাই মূল খাবারের অনুষঙ্গ হলো দুধ, দই, মাখন, ঘি এবং এর সবই উৎপাদিত হয় নিজস্ব গাভী থেকে প্রাপ্ত দুধ থেকে। ফলে এদের সবারই দশা-সই চেহারা, তবে দর্শনীয় হলো ভুঁড়ির সাইজ। কী নারী, কী পুরুষ। 

এছাড়া ছোট বড় অন্যান্য কিছু দোকানঘর। চতুর্দিকে বিস্তীর্ণ খোলা প্রাঙ্গণ। হাটবারে জনসমাগমে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। গরু, গাড়ি, ঘোড়া, গাধার অবস্থান এবং বিভিন্ন দ্রব্যাদির ভিন্ন ভিন্ন চত্বর। গরু, ঘোড়া, ছাগল, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠায় সয়লাব প্রাঙ্গণ। পরিষ্কার করার জন্য হাট সংলগ্ন মেথরপট্টি। পাশেই আদিবাসী ঋষি পল্লী, এরা স্থানীয়ভাবে বাদিয়া এবং এই পল্লী বাদিয়াপাড়া নামে পরিচিত। যতদূর জানা যায় এই বাদিয়াপাড়া বয়সে পচার হাটের চেয়ে ঢের বয়োজ্যেষ্ঠ। উত্তরে জলপাইগুড়ি-কোচবিহার, পশ্চিমে বৃহত্তর দিনাজপুর এবং বৃহত্তর রংপুর এলাকায় যত বাদিয়া সম্প্রদায় আছে তাদের আদি নিবাস এই পচারহাট ঋষি পল্লী-বাদিয়াপাড়া। 

নেহায়েৎ নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা যায়- বাংলাদেশের উওরের সীমান্তে ডিমলা থানার ঠাকুরগঞ্জে বাদিয়ার হাট, তার উত্তরে জলপাইগুড়ির হলদিবাড়ী থানার আঙ্গুল দেখায় বাদিয়াপাড়া, দিনাজপুরের খানসামা থানায় রামখোলায় বাদিয়াপাড়া, পঞ্চগড় জেলার বোদা ও দেবীগঞ্জ থানায় বাদিয়া পাড়া, নীলফামারী জেলা সদরে বাদিয়ার মোড় ও বাদিয়া পাড়া ইত্যাদি। এদের কোনো অনুষ্ঠানে বিশেষ করে বিয়ে বাড়িতে গেলে এরকম বিভিন্ন এলাকায় বসবাসরত প্রজন্মের সঙ্গে দেখা হয়। কাজীবাড়ি এই পল্লীর নিকটতম প্রতিবেশী এবং ঘনিষ্ঠ। হাটের সাথে কাজী বাড়ির দূরত্ব দৃষ্টি সীমার ভিতর, হাটবারে জনারণ্যে হাটের পাজরে অর্থাৎ সংলগ্ন এবং অন্যদিন হেঁটে গেলে তিন-চার মিনিটের পথ।

হাটের দিন টাউট, পকেটমার, মহাজন, জোতদার, জ্ঞানী-গুণী অনেক মানুষই আসেন। কেউ আসেন বাজার করতে, আবার কেউ আসেন পরস্পর দেখা-সাক্ষাতের জন্য। সেজন্য ছিল তাদের ভিন্ন ভিন্ন চত্বর বা বসার জায়গা। সবুজ মাঠে বাবু-মিয়া সাহেবদের অনেক রাত পর্যন্ত চলতো আড্ডা, এনারাই বেশিরভাগ আসতেন ঘোড়ায় চড়ে বা বিশেষ গরুর গাড়িতে। প্রতি হাটবারে বিকালে চলতো ঘোড়দৌড়। চলে সরকারি বিজ্ঞপ্তি যেমন সময়মতো খাজনা পরিশোধ করুন ইত্যাদি প্রচারের জন্য ঢেড়া-পেটা, ঢোল শোহরত। অনুপম গান-বাজনাসহ পণ্যের চলমান বিজ্ঞাপন, মনোরঞ্জনের সব উপাদানই ছিল এই হাটকে ঘিরে। বিশেষ করে পূজা-পার্বনে সপ্তাহব্যাপী সাড়ম্বরে চলত যাত্রাপালা, লাটিখেলা এবং ছোট-খাটো মেলা।

যতদূর লোকমুখে জানা যায়, এখানে দেড়-দুইশ বছর আগে এক কামার ছিলেন, নাম পচা কামার। তাকে ঘিরে এখানে লোকের আনাগোনা এবং ছোট্ট হাট বসত। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। জীবদ্দশায় তিনি তার সবটুকু জমি এই হাটে দান করে যান। সেই থেকে তার ঐকান্তিক ইচ্ছায় এর নাম হয় পচারহাট। এভাবে প্রাচীনকাল থেকে ধীরে ধীরে মানবসভ্যতা গড়ে ওঠে হাট ও বন্দরকে ঘিরে। শুরু হয় এর চারদিকে বিভিন্ন কিসিমের মানুষসহ বর্ধিষ্ণু পরিবারের বসবাস।

সাতচল্লিশে ভারত ভাগের সময় অনেকে এখান থেকে ওপারে চলে যান, আবার অনেক পরিবার সম্পত্তি বিনিময় করে এপারে আসেন। ওপার থেকে আসা পরিবার স্থানীয়ভাবে রিফুজি নামে পরিচিত। যেমন ভাটি এলাকা থেকে অনেক মানুষ এসে বসতি স্থাপন করেছেন, এদের মানুষজন ভাটিয়া নামে চেনেন।

তবে যারা এপার থেকে ওপারে গেছেন বা এসেছেন, উভয়ের স্থানীয় পরিবেশ ছিল সুপরিচিত। অনেকের আত্মীয়স্বজন ওপারে ছিল এবং এখনো আছে। যেমন কাজী বাড়ির বড় মেয়ের বিবাহ হয় চল্লিশের দশকে শিলিগুড়ির মালবাজার থানায় ধ্বলাবাড়িতে। হাটসংলগ্ন এই কাজী বাড়ির টগর কাজী মাস্টার সাতচল্লিশ পূর্ববর্তী গোটা সময় শিক্ষকতা করেছেন জলপাইগুড়িতে। ভারত ভাগে দুই অঞ্চলের মাঝে সীমান্ত পিলার বসেছে ঠিকই, কিন্তু মানুষের হৃদয়ের টান তেমনি অটুট আছে। এখনো সীমান্তে এপারের মানুষ ওপারে মসজিদে নামাজ পড়তে যায়। এপারে শিবরাত্রি মেলায় ওনারা আসেন এবং একইভাবে জলপাইগুড়ির হলদিবাড়ী পীরসাহেবের ওরশ শরীফে এপারের লোকজন অবাধে যাতায়াত করে। এই আসা যাওয়া যত না পূজা পার্বণের জন্য, তার চেয়ে বেশি পূর্ব পুরুষের ভিটা দেখতে যাওয়া-আসা, আদিবাড়ির মাটির গন্ধ অনুভব করা এবং শিকড়ের সন্ধানে।

 -৩-
গাছগাছালিতে ভরা ও পত্রপল্লবে ঘেরা মিনি শান্তিনিকেতনসম এই কাজী বাড়ির ছোট ছেলে ছুটিতে বাড়ি এসেছেন। তখন তিনি নওগাঁর জজ। রাস্তা সংলগ্ন বাড়ির বহিরাঙ্গনে হাটবারের সাঁঝ বেলায় পায়চারী করছেন। আধো আলো, আধো আঁধার, এখানে বলে পঁইসাঁঝ। এখনো ঘন অন্ধকার নেমে আসেনি। হাটুরেদের অনেকের সাথে কথাবার্তা হচ্ছে, কবে আসলেন, কবে যাবেন, কেমন আছেন ইত্যাদি কুশল বিনিময়।
এই আলো আধারিতে চার বছরের শিশু এসে বলল, দাদা চার আনা পয়সা দাও। সে এই দাদার সম্পর্কে আত্মীয়। নাম তার সবুজ।
হাটবারে হাটে বাহারি খাবারের দোকান বসে। তবে দই-চিড়া, মোয়া-মুড়ি ইত্যাদি সবসময় পাওয়া যায়। এলাকার মানুষের ঘরে ঘরে হাটের সন্ধ্যায় হাট থেকে আনা সামর্থ্য অনুযায়ী মিষ্টি-মন্ডা প্রায় বাড়িতেই পাওয়া যেত। কারণ প্রায়ই হাটে আগত অনেক আত্মীয় এই গ্রামে মেহমান হতেন। সবাই যেন হাটবারের জন্য অপেক্ষা করতেন, বিশেষ করে শিশুরা।
‘কিরে, চার আনা দিয়ে কি করবি? চকলেট মোয়া-মুড়ি খাবি?’ বললো, ‘না দাদা, চাল কিনব। দুপুরে ভাত খাইনি। মা বলেছে চাল নাই।’ শুনে জজ সাহেব বুকের পাঁজরে একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেলেন। যে বয়সে শিশুরা বাবা-মা, নানা-দাদা, চাচা-মামাদের কাছে পয়সা চায় মোয়া-মুড়ি কেনার জন্য, সেই চার বছরের সবুজ, দাদার কাছে নির্ভয়ে নিঃসংকোচে চার আনা চেয়ে বসলো। সে জানে না, চার আনায় কতটুকু চাল পাওয়া যাবে, তবে এটুকু বোধ হয় জানে, চাল কিনতে পয়সা লাগে। এই বয়সে চার আনাই এক ক্ষুধার্থ শিশুর কাছে ঢের। দাদা আর ভাবতে পারছিলেন না। 
দ্রুত তার হাতে চার আনা দিয়ে বললেন, ‘যা হাট থেকে মোয়া কিনে আন। তোর বাড়িতে চাল পাঠিয়ে দেবো।’ এই হাটে তখন এক আনায় ১৬টা মুড়ির মোয়া পাওয়া যেত। ছোট্ট সবুজ দাদার ডান হাতের আক্সগুলগুলো আনন্দে চেপে ধরে আস্থায় বলীয়ান হয়ে বলে উঠলো- ‘না দাদা মোয়া খাব না, ভাত খাব।’ সে দিনের সেই এক অবুঝ শিশুর করুণ আবদার মনে পড়লে এখনো বুকটা ভারি হয়ে উঠে। সময় কারো জন্য 

অপেক্ষা করে না, দিন যায় কথা থাকে। সেদিনের সেই পচারহাট এখন শুধু নামসর্বস্ব, মৌজার নামে আছে, হাটের পেরিফেরি আছে, স্কুল, পূজার নির্ধারিত স্থান এবং সামান্য দু’একটি দোকানপাট আছে, কিন্তু হাট আর নেই। অনেকটা সেরকম- ‘রাজা নাই শাহী নাই, আছে শুধু আম, রাজশাহী নাম।’

আছে আনন্দ সংবাদ, শুভ বিবাহ। বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে একটা সুন্দর নাম দরকার, তাই সবুজের নাম হলো ফুল মিয়া। তার ঘরে সহধর্মিণী হিসেবে এসেছে ফুলবিবি। এখন তাদের কোলে এক পুত্রসন্তান। সে এখন প্রাণ কোম্পানির লরি চালায়, আজ সিলেট তো কাল চট্টগ্রাম। মোবাইলে খবর নেয়- ‘দাদা আসসালামু আলাইকুম, দাদি কেমন আছেন। আমি এখন সিলেট যাচ্ছি লরি নিয়ে।’ ওরা যখন আমাদের খোঁজ নেয় তখন অদ্ভুত এক অনুভূতি হৃদয়ে কাজ করে, তেমনি ওদের জন্য আমাদেরও হৃদয় টানে। এভাবে জীবনচক্র চলে, থেমে থাকে না, বহমান।

লেখক: মোহাম্মদ নূরল হক
সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ (অব.)
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
আইন বিভাগ, শান্ত-মরিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম