Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

বৃক্ষ নিধন কিংবা পাহাড় ধ্বংস করে টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব

Icon

মো. শাহ জালাল মিশুক

প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৩৪ পিএম

বৃক্ষ নিধন কিংবা পাহাড় ধ্বংস করে টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব

মো. শাহ জালাল মিশুক

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর প্রাচ্যের রাণী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মানুষ কিছুদিন পর সবুজ (গাছপালা) ও পাহাড়ি সৌন্দর্য্যের অভাবে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং নিত্যনতুন নাগরিক সমস্যার মুখোমুখি হবে। নগরীর টাইগারপাস থেকে কদমতলী সড়কে এলেই নগরবাসী দেখতে পায় প্রাচীন বড় বড় সব মহিরুহের ছায়াবেষ্টিত ‘দ্বিতল’ সড়ক। এই সড়কের একটি অংশ গেছে পাহাড় ঘেঁষে ওপর দিয়ে, আরেকটি অংশ নিচে। মধ্যবর্তী পাহাড়ি ঢালে রয়েছে ছোট-বড় শতাধিক বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। এমন দোতলা সড়কের সৌন্দর্য বাংলাদেশের আর কোথাও দেখা যায় না। এখানে সারা দিন শোনা যায় পাখিদের কূজন। শহরের মাঝখানে এটি একটি স্বপ্নের মতো জায়গা। কিন্তু, সম্প্রতি চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প (গাড়ি ওঠার পথ) নির্মাণ করার জন্য সিআরবি এলাকার ৪৬টি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্মাণকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। 

তাই, শহরের অক্সিজেন (সবুজ এলাকা), প্রাকৃতিক পরিবেশ, শতবর্ষী গাছ, নগরীর সৌন্দর্য্য এবং পাহাড়ি এলাকার ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবি এলাকায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প নির্মাণ এর মতো এমন বিধংসী সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানাই। কারণ দূষণ, জলাবদ্ধতাসহ নাগরিক সমস্যায় জর্জরিত নগরবাসী স্বস্তির জন্য খোঁজে সবুজের সমারোহসমৃদ্ধ স্থান। এমন স্থানকে নষ্ট করে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র‌্যাম্প নামানোকে কখনই টেকসই ও বাসযোগ্য নগরীর কোনো স্ট্যান্ডার্ডই সাপোর্ট করবে নাহ।

চট্টগ্রাম নগরীর সিআরবি এলাকা হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মায়াবী আকর্ষণে হাতছানি দেয়ার মতো একটি এলাকা। পাশাপাশি সিআরবি এলাকাকে সিডিএ তাদের ড্যাপে হেরিটেজ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। পাশাপাশি ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ঘোষিত ড্যাপে সিআরবির কোনো অংশ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা যাবে না এবং সেখানে কোনো উঁচু স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না মর্মে গেজেট প্রকাশ করে সিডিএ। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, এই এলাকাটিকে ধংস কিংবা নষ্ট করাটা মনে হয় সবার এক ধরনের দায়িত্ব হয়ে দাড়িয়েছে! অন্যদিকে চট্টগ্রামে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। পরিবেশের বারোটা বাজিয়েই একের পর এক উন্নয়নের নকশা করা হচ্ছে চট্টগ্রামে। কর্ণফুলীর চরে বর্জ্যে শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনার পর এবার শোনা গেল আরেকটি দুঃসংবাদ।

বেসরকারি সংগঠন ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান অপিনিয়নের (ইকো) উদ্যোগে ২০২১ সালে নগরের সিআরবির প্রাণবৈচিত্র্য নিয়ে জরিপ করা হয়েছিল। ওই জরিপে সিআরবি এলাকায় মোট ২২৩টি প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে বড় বৃক্ষ ৮৮ প্রজাতি, গুল্ম ৪১ প্রজাতি, বীরুৎ ৭২ প্রজাতি এবং লতাজাতীয় ২২টি প্রজাতি রয়েছে। শুধু সিআরবি এলাকায় ঔষধি উদ্ভিদ পাওয়া গেছে ১৮৩ প্রজাতির।

গত ১৯ মার্চ চট্টগ্রাম উত্তর বনবিভাগ গাছের মার্কিং শেষ করে সিডিএকে একটি বনজদ্রব্য আহরণের লাইসেন্স দিয়েছে। ওই লাইসেন্সের বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে, ১১টি রেইনট্রি কড়ই গাছ, চারটি ডিসি গাছ, দুইটি ইপিল, একটি কৃষ্ণচূড়া, তিনটি মেহগনি, একটি পেয়ারা গাছ কাটা হবে। এ ছাড়া ২৪টি অন্যান্য জ্বালানি গাছ কাটতে হবে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ১৫টি র‌্যাম্প (গাড়ি ওঠা-নামার পথ) রয়েছে। এর মধ্যে টাইগারপাসে রয়েছে দুটি। একটি দিয়ে গাড়ি উঠবে এবং আরেকটি দিয়ে নামবে। গাড়ি ওঠার র‌্যাম্পটি নির্মাণ করা হচ্ছে নিউমার্কেট থেকে টাইগারপাসমুখী অংশ দিয়ে। আর এই র‌্যাম্প নির্মাণ করতে গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিডিএ। ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হলেও নির্মাণকাজ শুরু হয়নি। আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে থাকা গাড়ি নামার র‌্যাম্পটির (আমবাগান সড়কমুখী) নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে।

বন বিভাগ সূত্র জানায়, র‌্যাম্প নির্মাণের জন্য গাছ কাটার অনুমতি চেয়ে সিডিএ সম্প্রতি বন বিভাগের কাছে আবেদন করে। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ৪৬টি গাছ কাটার অনুমতি দেয়। গাছগুলোর মধ্যে রয়েছে শিরীষ, মেহগনি, কৃষ্ণচূড়া, পেয়ারা প্রজাতির গাছ।

অন্যদিকে সিডিএ’র বিধিমালায় আছে, কোনো গাছের গোড়া অর্থাৎ মাটির নিচ থেকে ওঠা অংশের ব্যাস যদি এক ফুট বা তার চেয়ে বেশি হয়, সেই গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হবে না। কোনো ধরনের স্থাপনা করার জন্যও এ গাছ কাটা যাবে না। সিডিএ এখন নিজেরাই গাছ কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের বিধিমালা নিজেরাই লঙ্ঘন করছে। এই গাছ যদি অন্য কোনো সংস্থা কাটার উদ্যোগ নিত তাহলে সিডিএ অবশ্যই বাধা দিত। ২০১০-১১ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অথবা সড়ক ও জনপথ বিভাগ একবার গাছগুলো কেটে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছিল। গাছগুলো মরে যাচ্ছে- এ অজুহাতে তারা কাটতে চাইলেও আমরা সিডিএর পক্ষ থেকে আপত্তি জানিয়েছিল। প্রকৃতির কী খেয়াল, তখন আবার গাছগুলোতে ডালপালা, পাতা গজাতে শুরু করে। তখন তারা আর সেগুলো কাটতে পারেনি।

পাশাপাশি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে জিইসি মোড় ও আগ্রাবাদ থেকে ওঠার সুযোগ রয়েছে। তাই এই দুটি স্থানের মধ্যবর্তী জায়গা টাইগারপাসে র‌্যাম্প নির্মাণের দরকার ছিল না। অনেকেই ধারণা করছে, হয়তো বেশি টোল পাওয়ার আশায় এই র্যাম্প নির্মাণ করছে। এর মাধ্যমে নগরের মানুষের স্বপ্নের ও স্বস্তির জায়গাগুলো যেভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। তাই পরিবেশের কথা চিন্তা করে র‌্যাম্পটি এখানে না নামিয়ে অন্য কোথাও করার সুযোগ রয়েছে কি না, তা বিবেচনা করতে হবে।প্রয়োজনে নকশা পরিবর্তন করে হলেও এমন প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করতে হবে।

মোদ্দাকথা হলো, পরিবেশ রক্ষায় চট্টগ্রামের মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়েছে। এটা খুব আশার কথা। সরকারি-বেসরকারিভাবে পরিবেশ রক্ষায় নানা উদ্যোগ আমাদের উৎসাহিত করছে। ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামের পরিবেশ ধ্বংস করারই প্রতিযোগিতা হয়েছে শুধু। ফলশ্রুতিতে কয়েকবছর আগে যেমন সিআরবি রক্ষার আন্দোলনে চট্টগ্রামের সব মানুষ যেভাবে এক হয়েছেন, ঠিক সেভাবেই শতবর্ষী গাছ ও পাহাড়ের উপর দৃষ্টিনন্দন দোতলা সড়ক রক্ষা করাও নগরবাসীর নিজেদের স্বার্থে জরুরি হয়ে পড়েছে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, চুয়েট।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম