
বাংলাদেশকে বলা হয়ে থাকে মানব বাণিজ্যের ট্রানজিট দেশ; এছাড়া এই দেশ থেকেও প্রচুর পরিমাণ মানুষ পাচারের শিকার হয়। ট্রাফিকিং ইন পারসন্স বা মানবপাচার হলো অর্থের লোভে বা নিজের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য কোন ব্যক্তিকে জবরদস্তি, প্রতারণা এবং বানোয়াট তথ্য দিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া। মানবপাচার একটি অধিরাষ্ট্রিক অপরাধ এবং একটি সর্বজনীন মানবাধিকার সমস্যা। জাতিসংঘে বহুজাতীয় সংঘবদ্ধ অপরাধসমূহের বিরুদ্ধে গঠন করা ২০০৩ সালের কনভেনশনের প্রটোকল অনুযায়ী- মানবপাচার হলো শোষণ করার উদ্দেশ্যে ভয় দেখিয়ে বা বল প্রয়োগ করে বা অন্য কোনো জোরপূর্বক উপায়ে অপহরণ, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্বল অবস্থা কাজে লাগিয়ে অর্থ প্রদান/গ্রহণ করে বা অন্যভাবে লাভ করে কোনো মানুষের সম্মতি নিয়ে মানুষ সংগ্রহ, পরিবহণ, হস্তান্তর, আশ্রয় প্রদান বা গ্রহণ করা।
প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ২৫ মিলিয়ন বা আড়াই কোটি নারী, পুরুষ ও শিশু পাচারের শিকার হয়; যাদের বাণিজ্যিকভাবে যৌনকাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, বলপূর্বক শ্রম ও ঋণ-দাসত্ব হিসেবে কেনা-বেচা করা হয়। পাচারকারীরা বিশ্বের প্রতিটি দেশে মানুষকে তাদের শিকারে পরিণত করার মাধ্যমে শত-হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে থাকে। কোভিড-১৯ বা করোনা মহামারি চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়গুলোতে সারা বিশ্বে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে মানবপাচার।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ও অতীতের তুলনায় মানবপাচার বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে অপরাধীরা অনেক বেশি পরিমাণ মানবপাচার করলেও অপরাধের পরিসংখ্যান থেকে সঠিক তথ্য জানা বিভিন্ন কারণে বেশ মুশকিল; তবে নারী এবং শিশুরাই পাচারের শিকার হয় বেশি। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ অন্যান্য অনেক দেশে বাংলাদেশ থেকে কি পরিমাণ নারী এবং শিশু পাচার হয় তার নির্ভরযোগ্য কোনো হিসাব নেই; তবে একটি রিপোর্ট বলছে আনুমানিক ২০,০০০ এর মতো নারী এবং শিশু প্রতি বছরে ভারত, পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়। আমাদের সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে মানবপাচারের ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশে ৫৮০টি যৌন পাচারের এবং ৬,৩৭৮টি শ্রম পাচারের ঘটনা ঘটেছে। পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে নারী, পুরুষ, এমনকি শিশুও রয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের যুগে মানবপাচারের প্রসার ঘটছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে। গ্লোবালাইজেশনের অনেকগুলো অন্ধকার দিকের একটি দিক হলো এটি সহজতর যোগাযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে মানবপাচারের মতো আরও বিভিন্ন অপরাধকে উস্কে দেওয়া। বিশ্বায়নের যুগে প্রযুক্তির যথেচ্ছা ব্যবহার, সামাজিক যোগাযোগের অসংখ্য মাধ্যম মানবপাচারের মতো গর্হিত অপরাধ সংগঠনে ভূমিকা রাখছে। উন্নত প্রযুক্তি পাচারকারী চক্রের যোগাযোগ অধিকতর সহজ করে দিয়েছে, ফলে তারা দ্রুতই নিজেদের পরিকল্পনামতো সংঘবদ্ধ হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে মানবপাচারকারিদের আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন সাধারণ মানুষকে প্রলুব্ধ করছে। ব্যাপক বিশ্বায়নের এই যুগে বিশ্বজুড়ে শ্রমবাজার উন্মুক্ত থাকায় নানান কাজের জন্য নিয়মিত এবং অনিয়মিত উপায়ে বাংলাদেশের মানুষ বিদেশে (সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ, মালয়েশিয়া, জার্মানি, ইউকে, আমেরিকা ইত্যাদি) পাড়ি জমায়। নিয়মিত বা বৈধ উপায়ে বায়রা অনুমোদিত সাড়ে সাতশর মতো এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশিরা কাজের উদ্দ্যেশ্যে বিভিন্ন দেশে যান। এক্ষেত্রে প্রকৃত খরচের কয়েকগুণ তাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় বলে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার জরিপে উঠে এসেছে। জরিপগুলো আরো বলছে অধিকাংশ বাংলাদেশী অভিবাসী শ্রমিক কাজে নিয়োগের ক্ষেত্রে ভুয়া নিয়োগের শিকার হন। তাদের কাজের বেতনের ক্ষেত্রে প্রতারণা, অন্যায্য সুযোগ- সুবিধা, নিম্ন কর্ম-পরিবেশ সর্বোপুরি তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় চরমভাবে।
সাধারণত বন্ধু-বান্ধব (ইদানীংকালে সামজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণেও বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে) বিদেশে থাকা আত্মীয়স্বজন, বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ অন্য দেশে কাজের সন্ধানে এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যায়। এদের মধ্যে পড়াশোনা না জানা অসহায় নারী ও শিশু, বেকার যুবক-পুরুষ, জলবায়ু পীড়িত বাস্তুহীন মানুষ মানবপাচারকারিদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এ সমস্ত মানুষ নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করে উন্নত জীবনের আশায় উন্নত দেশগুলোতে পাড়ি দেয়, কেউ কেউ সর্বস্ব বিক্রি করে পাচারকারী চক্রকে টাকা দেয়।
বিভিন্ন রুটে বাংলাদেশে মানবপাচার হয়ে থাকে- জল, স্থল বা আকাশ পথে। গবেষণা বলছে- বিগত ৮ বছরে ২.৫ লাখ মানুষ সমুদ্রপথে পাচারের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা টেকনাফ হতে সমুদ্রপথে দালালের হাত ধরে চড়া দামে (জনপ্রতি আড়াই লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা) দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে পাচার হয় বাংলাদেশি নাগরিক এবং রোহিঙ্গারা। টাকা দিতে না পারলে অনেকের জন্য সেখানে অপেক্ষা করে মৃত্যু, ডেড-বডি ছুড়ে ফেলা হয় সমুদ্রে। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল পাচার হয়ে যাওয়া বাংলাদেশিদের গণকবর। এমন ২০১৫, ২০১৯ এর ঘটনার মতো ঘটনার নজির এখনো রয়েছে। তারপরও থামছে না মানবপাচার। মানবপাচারের মতো সংঘবদ্ধ অপরাধের পেছনে থাকে শক্তিশালী চক্র; যারা পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে আছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতির কারণে সংঘবদ্ধভাবে তাদের এ গর্হিত কাজ চালাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। অফুরন্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিশ্বায়ন আমাদের জীবনকে নানানভাবে সহজ করে দিলেও অপরাধ সংঘটনেও অনেক সহজ করে দিয়েছে।
বাংলাদেশ মানবপাচার রোধে ২০১২ সালে আইন প্রণয়ন করলেও এ সমস্যার তেমন কোনো সমাধান এখনো আসেনি। মানবপাচারের বিশ্ব তালিকায় উপরের দিকেই বাংলাদেশের অবস্থান (টিয়ার-২)। এর কারণ হিসেবে বলা যায়- ব্যাপক বেকারত্ব, দারিদ্র্য। দেশে কাজ না পেয়ে অনেক তরুণ, যুবক উন্নত জীবনের আশায় দালালের মাধ্যমে বিদেশে পাড়ি জমায় এবং দালাল চক্র তাদের পাচার করে দেয়। নারী এবং শিশুদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদের পাচার করা হয় যৌন কাজে ব্যবহারের জন্য। স্থল এবং সমুদ্র সীমানায় কড়া নিরাপত্তার অভাবেও পাচারকারীরা সহজেই সফল হয়। সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু সংক্রান্ত বিপর্যয় মানুষের দেশের ভেতরে এবং বাইরে স্থানান্তর প্রবণতা বাড়িয়ে দিয়েছে এবং মানবপাচারকারী চক্র সেই সমস্ত অসহায় মানুষকেও তাদের টার্গেট করে থাকে, এ কারণটিও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
মানবপাচারের মতো এ জঘন্য অপরাধ ব্যক্তি, সম্প্রদায় ও দেশের যে ক্ষতিসাধন করে তা ব্যাপক, আর সে কারণে পাচার প্রতিরোধে আমাদের কার্যক্রমও সেই রকম শক্তিশালী হওয়া দরকার। মানবপাচার প্রতিরোধে সরকারের আরও বেশি সচেতন হওয়া এবং সুনজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
বাংলাদেশের যে সমস্ত পয়েন্ট দিয়ে মানবপাচার হয় জলে এবং স্থলে, সেইসব পয়েন্টে আইনি পাহারা জোরদার করতে হবে। ২০১২ সালের মানবপাচার বিরোধী আইনের ব্যাপক প্রয়োগ এবং দ্রুততম সময়ে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। মানবপাচার রোধে মানুষকে সচেতন করার কোনো বিকল্প নেই। শুধুমাত্র ৩০ জুলাই মানবপাচার বিরোধী দিবসে নয়, প্রতিটি দিনই জনগণকে মানবপাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত করতে হবে। মানবপাচারের অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে জনগণকে অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়ার বিভিন্ন মাধ্যম এবং পাচারকারী দালাল চক্রকে অবগত করতে হবে। যেসব গন্তব্যে পাচারকারী দল মানুষ পাঠায় সেসব দেশকেও মানবপাচার রোধে এগিয়ে আসতে হবে।
মানবপাচারের কারণে দায়েরকৃত মামলাগুলোর অবিলম্বে বিচার এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দেশে নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে; যাতে তারা সর্বস্ব খুইয়ে বিদেশ যেতে অনাগ্রহী হয়।
মানবপাচারের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া সারভাইভারদের সমাজে পুনরায় কাজের ব্যবস্থাসহ পুনর্বাসন করে দিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তারা যেন ট্রমা থেকে বেরিয়ে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে; সেদিকে সবার নজর দিতে হবে। সঠিক বিচার, স্থায়ী সুরক্ষা এবং প্রতিরোধ- এই তিনের সমন্বয়ে মানবপাচার নিয়ন্ত্রণে আনা যায় এবং সময়ের সাথে সাথে তা নির্মূল করা সম্ভব।
লেখক: ফারিহা জেসমিন
সহকারী অধ্যাপক
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।