Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

মধ্যপ্রাচ্যে দুই যুবরাজের দ্বন্দ্ব

এমবিএসের পিঠে ছুরি মেরেছেন এমবিজেড

Icon

আলফাজ আনাম 

প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৩, ০১:০৭ পিএম

এমবিএসের পিঠে ছুরি মেরেছেন এমবিজেড

এক সময় এমবিএস ও এমবিজেড-এর সখ্য ছিল এমনই। ছবি: সংগৃহীত

মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনীতিতে এখন নানামুখী মেরুকরণ ঘটছে। চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে কূটনৈতিক সর্ম্পক প্রতিষ্ঠার পর এই মেরুকরণে নানা মাত্রা যোগ হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কিছুটা হলেও কমে আসছে বলে মনে করেন ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কিন্তু এরমধ্যে এ অঞ্চলের দুই প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের  মধ্যে বেশ কিছু ইস্যুতে দেখা দিয়েছে তীব্র মতবিরোধ। এক সময় তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশ দুটিকে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু বন্ধুত্বের বদলে দুদেশের প্রতিযোগিতা এখন দ্বন্দ্বে রূপ নেওয়ার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যা এ অঞ্চলের দেশগুলোর আন্তঃসর্ম্পকের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।   

আঞ্চলিক  রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার, কূটনৈতিক স্বার্থ এবং ওপেক প্লাসের তেল উৎপাদন নীতিমালাসহ কয়েকটি ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে সর্ম্পকের অবনতি ঘটে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদের মধ্যে তিক্ততা কতটা বেড়েছে, তা ফুটে উঠেছে মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়েছে, মোহাম্মদ বিন সালমান গত ডিসেম্বর মাসে স্থানীয় সাংবাদিকদের রিয়াদে অনানুষ্ঠানিক এক ব্রিফিংয়ের জন্য ডেকেছিলেন। সেখানে তিনি সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে বলেছিলেন, আরব আমিরাত ‘সৌদি আরবের পিঠে ছুরিকাঘাত করেছে’। এই ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ব্যক্তিরা  জানিয়েছেন, সাংবাদিকদের বিন সালমান বলেছিলেন, ‘তারা দেখবে আমি কী করতে পারি’। তিনি আরও বলেছেন, আমিরাত সরকার যদি মধ্যপ্রাচ্যে এবং ওপেক প্লাসের মধ্যে সৌদি আরবের নীতির পাল্টা নীতি অনুসরণ অব্যাহত রাখে তাহলে তিনি আমিরাতের উপর কাতারের চেয়েও ভয়াবহ অবরোধ আরোপের পদক্ষেপ নেবেন। 

সৌদি যুবরাজের এমন বক্তব্য বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। গত এক দশকে তরুণ এই দুই নেতা বলতে গেলে মধ্যপ্রাচ্য বদলে দেওয়ার খেলায় মেতে উঠেছিলেন। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একটি জোট গড়ার মাধ্যমে ইয়েমেনে সামরিক হস্তক্ষেপ করেন। মিসরে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেশটিতে প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ সিসিকে ক্ষমতায় বসান। এ ছাড়া গৃহযুদ্ধে বিভক্ত লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতারের যোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ করেন। ইরান ও উগ্রপন্থিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাসহ বেশকিছু অভিযোগ তুলে ২০১৭ সালে কাতারের উপর অবরোধ আরোপে নেতৃত্ব দেন এই দুই যুবরাজ।

 ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য বা আরব বিশ্বে কে প্রধান নেতা হয়ে উঠবেন, দুই দেশের মধ্যে কোন দেশ নেতৃত্ব দেবে তা নিয়ে ঠাণ্ডা লড়াই চলছে এমবিএস ও এমবিজেড এর মধ্যে। এ নিয়ে তাদের সম্পর্কের এতটাই অবনতি ঘটেছে যে, গত ৬ মাসের মধ্যে তারা একবারের জন্যও পরস্পরের সাথে কথা বলেননি। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও প্রভাব যখন ক্রমাগত কমছে ঠিক সেই সময়ে দুই নেতার মধ্যে কে এই অঞ্চলে সবচেয়ে প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবান ব্যক্তি তা নিয়ে তারা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। গত কয়েক বছর ধরে দুই দেশের রাজপরিবারের  প্রভাবশালী এই দুই সদস্য আরব বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষমতাবান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে উঠার চেষ্টা করছেন। এখন প্রকাশ্যে আসছে তাদের এই প্রতিযোগিতার আসল রূপ।

বাইডেন প্রশাসনের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও প্রভাবশালী হওয়ার লড়াইয়ে নামা এই দুই শাসক এখন আর এক নৌকায় থাকতে আগ্রহী নন। কিন্তু তাদের পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থানে থাকাটা এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য মোটেও সহায়ক নয়।

মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করেন, সৌদি-আমিরাত বিরোধ যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, ইরানকে মোকাবিলায় একটি ঐক্যবদ্ধ জোট গঠন করতে। ইয়েমেনে ইরানের প্রভাব কমিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করা। এ ছাড়া মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের উদ্যোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জোরালো সমর্থন আছে। দুদেশের এই বিরোধ এই প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। 

সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতর যৌথভাবে ইয়েমেনে সামরিক হস্তক্ষেপ করলেও দেশটিতে তাদের ভিন্ন স্বার্থ রয়েছে। আমিরাত সরকার ইয়েমেন যুদ্ধে তাদের অংশ গ্রহণকে সৌদি আরবের প্রতি সমর্থন হিসেবে দেখলেও তারা তাদের অর্থনৈতিক-সামরিক স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ইয়েমেনে পৌঁছার মাধ্যমে আমিরাত সরকার দক্ষিণ লোহিত সাগরের বাব আল-মান্দেব রুটসহ নৌবাণিজ্যের একাধিক রুটকে নিজেদের আয়ত্বে রাখার মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করছে।

ইয়েমেনের দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় ৯০ হাজার সৈন্যকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে আমিরাত সরকার। বর্তমানে ইয়েমেনের বেশ কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠনের উপর পরিচালনাগত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আমিরাতের। এই গ্রুপগুলো দক্ষিণ ইয়েমেনের আমিরাত সমর্থিত সাউদার্ন ট্রানজিশনাল কাউন্সিল (এসটিসি) এর সামরিক শক্তির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। ইয়েমেনের সৌদি সমর্থিত সরকারের উপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টিতে সক্ষম এই এসটিসি। এ ছাড়া ইয়েমেনের সোকোত্রা দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি ও বাব আল-মান্দাব এর কাছে বিমান ঘাঁটি নির্মাণ করেছে আমিরাত সরকার। এসব বিষয় নিয়েও জোরালো হয়েছে সৌদি-আমিরাত দ্বন্দ্ব।

ইয়েমেনের কর্মকর্তারা বলছেন, সৌদি আরব যদি এখন ইয়েমেন থেকে সেনা প্রত্যাহার করে তাহলে হুথি নিয়ন্ত্রিত উত্তরাঞ্চল ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলবে। অপরদিকে দক্ষিণাঞ্চল ঘনিষ্ঠ হবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে। তখন ইয়েমেন নিয়ে খুব বেশি কিছু করার সুযোগ থাকবে না সৌদি আরবের। ইয়েমেনি কর্মকর্তাদের এই বক্তব্য সৌদি আরবের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।

তেলের মূল্য বাড়াতে উৎপাদন কমানোর সৌদি চাপে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আরব আমিরাত। দুই দেশের মতবিরোধ ফাটল সৃষ্টি করেছে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেক প্লাসে। এই বিরোধ প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে। ওই সময় সৌদি আরবসহ রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ওপেক সদস্যরা তেলের উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে সমর্থন দেয় আমিরাত। এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ হয় বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু পরে একান্ত আলাপে দেশটির পক্ষ থেকে মার্কিন কর্মকর্তাদের বলা হয়েছে, সৌদি আরব তাদের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করেছে।

আমিরাত নিজেদের তেলের উৎপাদন সক্ষমতা উন্নীত করেছে প্রতিদিন ৪০ লাখ ব্যারেলে। এই সক্ষমতা ৫০ লাখ ব্যারেলে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। কিন্তু ওপেক নীতি মেনে চলায় তারা দিনে ৩০ লাখ ব্যারেলের বেশি তেল উৎপাদন করতে পারছে না। এতে কোটি কোটি ডলার রাজস্ব হারাচ্ছে দেশটি। এ নিয়ে সৌদি আরবের উপর ক্ষুব্ধ আমিরাত সরকার।

উপসাগরীয় অঞ্চলে আরব আমিরাতের প্রভাব কমানোর নানা উদ্যেগ নিয়েছে সৌদি আরব। যা ক্ষুদ্ধ করেছে আরব আমিরাতকে। আরব আমিরাতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে দুবাই। এই নগরী থেকে বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিকে তাদের সদর দফতর রিয়াদে স্থানান্তরের চাপ দিচ্ছে সৌদি আরব। দীর্ঘদিন ধরে দুবাই পশ্চিমাদের কাছ অনেক বেশি আধুনিক মনোভাবাপন্ন বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে আসছে। কিন্তু দুবাইয়ের এই অবস্থান টলাতে চাইছেন সৌদি যুবরাজ। এ জন্য তিনি সৌদি আরবে টেকনোলজি হাব বা টেক সেন্টার স্থাপন, আরও বেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করা এবং লজিস্টিক কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের ব্যবসা ও পরিবহনের মূল কেন্দ্র দুবাইয়ের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এমবিএস সৌদি আরবকে আকাশ ও সমুদ্র পথের প্রধান লজিস্টিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছেন। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি গত মার্চ মাসে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ‘রিয়াদ এয়ার’ নামে নতুন একটি এয়ারলাইন্স কোম্পানি চালুর ঘোষণা দেন। যা আরব আমিরাতের এমিরেটস, গালফ এয়ার ও ইতিহাদ এয়ারওয়েজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে। এ জন্য প্রাথমিকভাবে ৭২টি বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমান কিনেছে সৌদি সরকার।

ইসরাইলের সাথে আরব আমিরাতের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর বেশকিছু পাল্টা ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে সৌদি সরকার। আমিরাতে ইসরাইলি যন্ত্রাংশ ও এক্সেসরিস দিয়ে যেসব সামগ্রি তৈরি হচ্ছে সেগুলো আমদানিতে নতুন করে কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে।  আমিরাতের ফ্রি ইকনমিক জোনে যেসব পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে সেগুলোর ক্ষেত্রে দেওয়া হয়েছে নানা বিধিনিষেধ। এ ধরনের সিদ্ধান্ত আমিরাতের অর্থনীতির জন্য একটি বড় আঘাত হিসেবে দেখছেন পর্যবেক্ষকরা। তাদের মতে, সবকিছু মিলিয়ে সৌদি-আমিরাত দ্বন্দ্ব আগামীতে আরও বাড়তে পারে। 

লেখক : সাংবাদিক 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম