Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

নুরুল ইসলাম ছিলেন শিল্প বিকাশের দার্শনিক

Icon

আজহারুল হক

প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৩, ১০:২৩ পিএম

নুরুল ইসলাম ছিলেন শিল্প বিকাশের দার্শনিক

৭১-এর রণাঙ্গনের সাহসী সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম। সারা বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যবসায়ী জগতের অহংকার ও নক্ষত্র হিসেবে সমাদৃত। তিনি একাধারে ব্যবসায়ী ও জাতির উন্নয়নে চিন্তাশীল একজন মহান দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে সারা দেশে সব মহলে পরিচিত।

সৃষ্টিশীল মেধাবী এই মানুষটির মৃত্যু দিবসে তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। ২০২০ সালের ১৩ জুলাই করোনা আক্রান্ত হয়ে অপরাজেয় এই বীরকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়।

নুরুল ইসলাম ছিলেন শিল্প বিকাশের দার্শনিক। তার চিন্তা চেতনা মেধা মনন ও শ্রমের মাধ্যমে একজীবনে ৪২টির বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। প্রায় লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে দেশের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে আবির্ভূত করেন। প্রায় ৭৪ বছর বেঁচে থাকলেও শত শত বছর তার কর্মের অলংকরণে সাধারণ মানুষের মাঝে অমরত্ব হয়ে থাকবেন এ মহান মানুষটি। যমুনা ফিউচার পার্ক তার অন্যতম উদাহরণ।

ঢাকার অদূরে ঐতিহাসিক আড়িয়ল বিলের পাশে নবাবগঞ্জ উপজেলার চুড়াইন ইউনিয়নের কামারখোলা গ্রামে এই ক্ষণজন্মা ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। মাতা জামিলা খাতুন ও পিতা আমজাদ আলীর ঘর আলোকিত করে অজোপাড়া গাঁয়ের সেই নুরুল ইসলামই দেশের একজন নন্দিত মানুষ হয়ে সাধারণ মানুষের ভরসার আলোকবর্তিকা হতে পেরেছিলেন। তিনি ছিলেন দেশ তথা দোহার নবাবগঞ্জের গর্বিত সন্তান।

বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস থেকে জানা গেছে বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেশ ও জাতির দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুর দেশ উন্নয়নের ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে গড়ে তুলেন বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান। ধীরে ধীরে তার চিন্তা চেতনাকে কাজে লাগিয়ে তার প্রতিষ্ঠিত শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিশেষ করে গণমাধ্যম হাউজ দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টেলিভিশন দক্ষিণ এশিয়ায় সাহসী ও নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যম হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। বিশেষ করে জাতির দুর্দিনে তার সাহসী পদক্ষেপ আজও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

তিনি তার সুদূরপ্রসারি চিন্তার মাধ্যমে জাতির কল্যাণে অসংখ্য অবদান রেখেছেন। তিনি সব সময় আগামীর চিন্তা করতেন। পশ্চাৎপদ চিন্তা চেতনা ও ধ্যান ধারণাকে উপড়ে ফেলে দেশের মানুষের কথা চিন্তা করে গড়ে তুলেছেন অসংখ্য কলকারখানা। আত্মনির্ভরশীল এ মানুষটি কখনো বিলাসবহুল জীবনের চিন্তা করেননি। দেশীয় শিল্প উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিকের আস্থা অর্জন করেছেন। রাষ্ট্রকে সম্মান করে দেশের টাকা কখনো বিদেশে পাচার বা বিনিয়োগ করেননি। প্রগতিশীল দর্শন লালন করে মানবসেবায় নিবেদিত ছিলেন মহান এই কর্মবীর।

অপরদিকে হতদরিদ্র, অসহায় মানুষের কল্যাণে সারাজীবন কাজ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম। বিশেষ করে কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা, অর্থ অভাবে বন্ধ লেখাপড়া করতে না পারা শিক্ষার্থীসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়নে তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। তার ত্যাগ ও দেশপ্রেমের নজির জাতিকে করেছে আলোকিত। তিনি মানুষকে স্বাবলম্বী হতে পথপ্রদর্শক হিসেবেও কাজ করেছেন। তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করার দাবি রাখছি।

সারা দেশসহ ঢাকা জেলার দোহার নবাবগঞ্জ, বৃহত্তম বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর, সিরাজদিখান, মানিকগঞ্জের সিংগাইরসহ বিভিন্ন জেলার অসংখ্য বেকার যুবককে চাকরি দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। এছাড়া দেশবরেণ্য বহু বিখ্যাত রাজনীতিবিদের পাশে থেকে সাহস জুগিয়েছেন তাদের। যারা আজ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের রাজনীতি ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষ।

নানা মানবিক গুণের অধিকারী ঢাকার দোহার নবাবগঞ্জের কৃতীসন্তান নুরুল ইসলাম বিগত সময়ে বাংলাদেশের ভয়াবহ বন্যাগুলোতে অসহায় দরিদ্র মানুষের পাশে থেকে তাদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ভালো কাজের প্রতিযোগিতায় সামনের সারির এই যোদ্ধা শুধু দেশবরেণ্য শিল্পপতি হিসেবেই নয়- একজন মানবিক সাহসী পুরুষ হিসেবে সারা বাংলায় পরিচিত হয়ে উঠেন। দেশের সাংবাদিক সমাজ তাকে সিংহপুরুষ হিসেবে আজও স্মরণ করে থাকেন। তিনি নিরপেক্ষ ছিলেন। তবে স্বাধীনতা ও ন্যায়ের পক্ষে থেকে সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।

এ দেশের বহু সাংবাদিক তার হাত ধরে এগিয়ে গেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জটিল ও কঠিন পথে। যেখান থেকে ছিনিয়ে এনেছেন সত্যে ও ন্যায়ের তথ্য। অপরাধের অন্ধকার গলি থেকে সাহসের স্বমহিমায় তিনি ছিলেন অবিচল ও দণ্ডায়মান পুরুষ। সব সত্যকে পাঠকের কাছে উপস্থাপনে কখনো কার্পণ্য করেননি। নিজের প্রতিষ্ঠানের বাইরেও সাংবাদিকদের তিনি নানাভাবে সাহস জুগিয়েছেন; যা গণমাধ্যমেকে সম্মানিত করেছে সাধারণ মানুষের কাছে।

২০০৩ সাল থেকে আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি ও জানি। যদিও আমার যুগান্তরে প্রবেশকাল ছিল ২০১৪ সালের ডিসেম্বর। অনেক সময় খুব কাছে থেকে দেখেছি এই মহান মানুষটি কতটা মানবিক ও আন্তরিক ছিলেন। তিনি সব সময় চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার এক দার্শনিক। যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা নুরুল ইসলাম অনেকের কাছেই অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব।

২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনা দানবীয় রূপে আঘাত হানলে কিছু দিন পর থেকেই দেশে লকডাউন নামে স্বাস্থ্য বিধিনিষেধ আরোপ হয়। তখন তিনি বলেছিলেন- করোনা দীর্ঘ সময় স্থায়ী হতে পারে। এতে কি এলাকার সাধারণ মানুষের কষ্ট হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম জ্বি স্যার- স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাপনে কষ্ট হতে পারে। তাৎক্ষণিক তিনি বললেন- ওদের পাশে কিভাবে দাঁড়ানো যায়। প্রথমে চিন্তা করলেন দোহার ও নবাবগঞ্জের দুই উপজেলায় লঙ্গরখানা খোলা যায় কিনা। তার নির্দেশে সেই চেষ্টা করলেও স্বাস্থ্যবিধির কারণে তা হয়নি। পরবর্তীতে সাধারণ মানুষের মাঝে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেন তিনি।

আপৎকালীন সাধারণ মানুষকে নিয়ে চিন্তার এক কৌতূহলী এই ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে আজ আমরা অনেকেই শোকাহত ও অশ্রুসিক্ত। তার তৃতীয় প্রয়াণ দিবসে সালাম ও শ্রদ্ধা। ওপারে ভালো থাকুন- হে মহান কর্মবীর প্রেরণা ও সাহসের বাতিঘর নুরুল ইসলাম।

লেখক: সাংবাদিক, যুগান্তর

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম