Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

সংস্কৃতির বা চিন্তার গতিশীলতা

Icon

শারমিন সুলতানা

প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৩, ১১:০৭ পিএম

সংস্কৃতির বা চিন্তার গতিশীলতা

শারমিন সুলতানা।

সংস্কৃতির বা চিন্তার গতিশীলতা কী অর্থ প্রবহমান আর কোন গন্তব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বর্তমান প্রজন্মকে সেটি একটু গুরুত্বপূর্ণ প্রাসঙ্গিক বিষয় আজকের সময়ে।  

সহজ কথায় সংস্কৃতি হলো জাতিগত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ, অর্থাৎ একটি জাতি চিন্তায় যা ধারণ করে এবং সে চিন্তা-চেতনার ফলশ্রুতিতে যা সে জাতি আচার-আচরণ, রীতি-নীতি, বিধি-নিষেধ, পালা-পার্বন, চলন-বলব ও বিশ্বাসে বহন করে তা-ই তার সংস্কৃতি। মোট কথা যে বিমূর্ত বিষয়টি একটি জাতির পরিচয় তুলে ধরে তা-ই সংস্কৃতি। আর চিন্তা-চেতনা হলো সেই মানদণ্ড যা ব্যক্তিকে সার্বিকভাবে পরিচালিত করে। স্বভাবগতভাবেই সংস্কৃতি ও চিন্তা-চেতনা গতিশীল। এখন প্রশ্ন হলো গতিশীলতার প্রকৃত অর্থ কী? গতিশীলতা কি প্রগতিশীলতা নাকি স্থবিরতামুক্ত হওয়া?

সাধারণভাবে গতি বলতে স্থির অবস্থার বিপরীতে চিন্তা চেতনার প্রাগ্রসরতা বোঝায়। সেই অর্থে সংস্কৃতির গতিশীলতা বলতে ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত চিন্তার গোঁড়ামিমুক্ত হয়ে নতুন চিন্তা বা দর্শন দ্বারা ইতিবাচক পরিবর্তনকে আত্মকরণ করাকে বোঝায় বোধ করি। এই পরিবর্তনকে সাদরে স্বাগত জানানোর প্রয়োজনীয়তা পরিবর্তিত সময়ে ব্যক্তির জীবনে আসা নানাবিধ নতুন সমস্যা ও চাহিদার জায়গাটিতে অবস্থিত। কিন্তু এই গতিশীলতা কি কখনো শিল্পের মৃদু সৌন্দর্যের পরিপন্থি হয়ে দাড়াচ্ছে কিংবা পোশাকের শালীনতার ধারনাকে স্বাধীনতা শব্দটির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছে? এই গতিশীলতা কি শিক্ষা আর বাণিজ্যের ধারণাকে এক করে ফেলছে বা প্রতিষ্ঠা ও ধনী হওয়াকে অভিন্ন জ্ঞান করছে? প্রশ্নগুলো মানুষের চিন্তাকে নাড়া দিতে আরম্ভ করেছে বহু আগে। কেউ চিন্তাকে ভাবনা সর্বস্ব রাখছে আর কেউ কথা তুলছে।

বড় বড় ইমারত আর আলো ঝলমলে শহর থাকা উন্নত জাতির বৈশিষ্ট্য যে নয় সেটা আমরা সবাই জানি, কিন্তু উন্নত জাতির বৈশিষ্ট্য ঠিক কী? আমরা কি সমষ্টিগতভাবে এই সিদ্ধান্ত আসতে পেরেছি যে প্রকৃতভাবে আমরা উন্নত সংস্কৃতিতে সম্মৃদ্ধ উন্নত জাতি হতে পেরেছি কিনা? সবাই জানি, যে জাতির চিন্তা-চেতনা যত পরিশীলিত, যত মূল্যবোধসম্পন্ন আর যত উৎকৃষ্ট সে জাতি তত উন্নত সংস্কৃতির ধারক। তাহলে আমাদের গোষ্ঠীগত চিন্তার প্রকৃত চেহারা যাকে সংস্কৃতির স্বরূপ বলা যায় তা আসলে কি আমরা আয়নায় দেখি? হয়ত দেখি না কিংবা দেখেও না দেখার ভান করি। প্রগতিশীল চিন্তার বিস্তারে পূর্ববর্তী প্রজন্মের চেয়ে অনেকেই আবার বর্তমান প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা বেশি রাখে, কারণ কিছু নির্দিষ্ট সূত্রে আমাদের পূর্বপুরুষের চিন্তা আটকে থাকে ক্ষেত্রবিশেষে যেখান থেকে তারা হয় বের হতে চায় না কিংবা চাইলে অস্তিত্ব সংকটের ভয়ে বের হতে চেয়েও পারে না। তাই প্রত্যাশা নতুন প্রজন্মের কাছে কারণ তাদের পক্ষেই গতিকে নিজেদের নিজস্ব শক্তি দ্বারা প্রগতিশীল চেতনায় ঢেলে সাজানো সম্ভব। কিন্তু গতি অর্থাৎ স্থবিরতার বিপরীতে প্রবহমান হওয়া বলতে বর্তমান প্রজন্ম কী বোঝে, সেটি আরেকটি বড় প্রশ্ন। আধুনিক হওয়ার বলতে বর্তমান প্রজন্ম ঠিক কোনটাকে বোঝে সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। খতিয়ে দেখলে দেখা যায় বর্তমান প্রজন্ম নিজেদের সংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহী নয়। এর কারণ নিজেদের সংস্কৃতির আকর্ষণহীনতা নয়, বর্তমান প্রজন্মের সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞতা।  এ নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই। ক্রমশ যে গতিশীলতার নামে ক্ষেত্রবিশেষে  আধুনিকতার বিভ্রান্তমূলক ব্যাখ্যাকে আত্মীয়করণ করে আমরা নিজেদের পায়ের নিচের মাটিকে শক্ত না করে শেকড়হীন হয়ে পড়ছি তা আমাদের বোধের ধারে-কাছেও নেই।

বেশির ভাগ তরুণদের কাছে শিল্পের সৌন্দর্যের চেয়ে বা আবেদনশীলতার চেয়ে চাকচিক্য বেশি জরুরি, আভ্যন্তরীণ অর্থপূর্ণতার চেয়ে বাহ্যিক অর্থহীনতা বেশি আকর্ষণীয়। এর কারণ বর্তমান জীবনে রাজত্ব সৃষ্টিকারী বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং সৌন্দর্যের বোধহীনতা। আমরা দলগতভাবে থাকার চেয়ে একা থাকতে পছন্দ করি, একত্র হওয়ার চেয়ে পৃথক হই সবচেয়ে বেশি। আর সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে এর আপেক্ষিক সত্তা সম্পর্কে আমরা অবগতই নই। 

তাই বয়স পনেরো পার হতেই আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে বোধসম্পন্ন হওয়ার চেয়ে নিজস্ব বিচ্ছিন্ন একটি ফ্যাশনকে আয়ত্ব করা জরুরি হয়ে পড়ে। তারা স্বাধীনতা শব্দটির ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে। এর ফলে শিক্ষার সাথে চাকরির জন্য প্রশিক্ষণ নেওয়ার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা তারা ভুলে যায়, কিংবা পার্থক্য যে রয়েছে তা তাদের জানাই হয়ে উঠে না। এ কারণে প্রত্যেকে  নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দিকে আত্মনিয়োগ করে সার্বিক উন্নয়নে মনোনিবেশ না করে আর্থিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে পা বাড়ায়। যা তাকে পৃথকভাবে ধনী বানাতে ক্ষেত্রবিশেষে পারলেও সার্বিক উন্নয়নে অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ করতে পারে না। এমতাবস্থায় পূর্ববর্তী প্রজন্মকে একেবাকে নির্ভার বলা যায়না। চিন্তাগত  স্থিরতার পেছনে পরোক্ষভাবে তাদের একমুখী প্রতিষ্ঠার ধারণা ও সৌন্দর্য বোধ, মূল্যবোধহীনতা দায়ী। তারা নিজেদের ব্যর্থতার কারণে বা বোধের অভাবজনিত চিন্তা চেতনার জায়গা থেকে কতগুলো নির্দিষ্ট গণ্ডির ভেতর নতুন প্রজন্মকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয়, আর তারা তাদের অস্থির চিত্ত,  দূরদর্শিতার অভাবে সেই সীমাবদ্ধ সূত্রগুলোতেই আকটা পড়ে যায়। তাদের চিন্তার অগভীরতা তাদের গতানুগতিকভাবে এমন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করে যারা নিজেরাই নিজেদের অভ্যাসের দাস। এর কারণ শুদ্ধ চিন্তার অভাব।

চিন্তার বহিঃপ্রকাশের সমন্বিত রূপই সংস্কৃতি। চিন্তার উৎকর্ষতা সংস্কৃতিকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। উন্নত সংস্কৃতি আর অনুন্নত সংস্কৃতি আপেক্ষিক বিষয় কারণ কোনটিকে ঠিক উন্নত বলা যায় সেটিই আমরা অনেকেই পরিষ্কারভাবে জানি না। কিন্তু অনুন্নত যদি বলতে হয় তবে বোধহয় গোষ্ঠির চিন্তা বা বোধ শক্তির অসাড়তাকে বোঝায়। কারণ ব্যক্তির উৎকর্ষপূর্ণ হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি কাজ করে তার চিন্তা বা বোধ শক্তি। যদি একক ব্যক্তির ভেতরে তার মূল্যবোধ ও জীবনবোধ সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয় তবে তার পক্ষে বস্তুর গুরুত্ব বা বিষয়ের মাহাত্ম্য কোনোটিই বোঝা সম্ভব না। অপেক্ষাকৃত হালকা জিনিসগুলোই তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রুচি অভিরুচি পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যক্তিকে স্হিরতা বিবর্জিত করবে। এ থেকে আসে বিচ্ছিন্নবাদ যা প্রজন্মকে কোনো বিষয়েই একটি জায়গায় দাঁড় করায় না যার ফলে গোষ্ঠীগত চিন্তার স্বরূপ অর্থাৎ জাতিগত সংস্কৃতির ছবি আমাদের সামনে অস্পষ্ট থেকে যায়।  

বর্তমান প্রজন্মের এই অস্থিরতা, অসাড় চাকচিক্যকে আধুনিক জ্ঞান করা, সময়ের উন্মাদনার হাতের পুতুল হয়ে পড়া কিংবা চিন্তাগতভাবে শক্তিশালী না হওয়া ইত্যাদি আমাদের সংস্কৃতির গতিশীলতাকে বাঞ্ছনীয় গন্তব্যের দিকে যেতে নানানভাবে বাধাগ্রস্ত করে। তরুণ প্রজন্মের চাওয়া-পাওয়া, রুচি-অভিরুচি, জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, দায়-দায়িত্ববোধ, করণীয় ও কর্তব্যবোধ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে নিরীক্ষণ করলে ক্ষেত্রবিশেষে হতাশ হতে হয়। এর কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলোকে সামনে পাওয়া যেতে পারে সেগুলো হলো তাদের অনেকের সংগ্রামহীন জীবনে বস্তুর গুরুত্ব না বোঝা যা অন্যদের ভয়াবহভাবে প্রভাবিত করে, তাদের সঙ্গে পূর্ববর্তী প্রজন্মের বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা ও ভাবনা আদান-প্রদানের অভাব, তাদের ফলপ্রসূ কাউন্সিলিংয়ের অভাব, অপরাধের বিপরীতে শাস্তির বদলে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে ইতিবাচক সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের উদাসীনতা, সত্যের স্বার্থান্বেষী ব্যাখ্যা প্রদান, প্রয়োজন ও বিলাসিতার পার্থক্য না বোঝানো, বর্জনীয় ও করণীয় বিষয়ের জ্ঞান প্রদানের অভাব, পিতা-মাতার সঙ্গে মানসিক দূরত্ব, শিক্ষাক্ষেত্রে বৈচিত্র্যপূর্ণ সুযোগ ও সম্ভাবনার ক্ষেত্র প্রদর্শনের অভাব, নৈতিকতার প্রতি উদাসীনতা ইত্যাদি।  এ সমস্ত বিষয় নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি বর্তমান প্রজন্মের উদাসীনতার জন্ম দেয় এবং এ থেকেই আধুনিকতার প্রকৃত স্বরূপের সঙ্গে তাদের অনেকেরই পরিচয় ঘটেনা। তাই তাদের অনেকেই সংস্কৃতি বলতে উৎসবের চাকচিক্য বোঝে আর শিক্ষার উদ্দেশ্য বলতে অর্থ উপার্জনকে বোঝে। ফলে তাদের চিন্তায় সাধনার স্থলে জায়গা করে নেয় দ্রুত কার্যোদ্ধারের পন্থা খোঁজা। গতি বলতে তারা অনেকেই বোঝে দ্রুততার সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে চিন্তাগত উৎকর্ষতা তাই থেকে যায় চিন্তার বাইরের বিষয় হিসেবে; যা জাতিগতভাবে আমাদের চিন্তাগত অবস্থানটিকে অস্পষ্ট করে। আর আমাদের সংস্কৃতির গতিশীলতা অনেক ক্ষেত্রে হারায় কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের ঠিকানা। 

প্রয়োজন সচেতনতা, প্রত্যেকের নিজস্ব জায়গা থেকে কথা বলা, ভাবের আদান প্রদান করা, তর্ক নয় যুক্তির ধারে বোধহীনতাকে মোকাবিলা করা। কেননা আমরা প্রত্যেকেই আমাদের সংস্কৃতিগত অবস্থান অঙ্কনের ক্যানভাসে চিত্রকর। দায়টা সবার, এর থেকে মুক্তি নেই বোধসম্পন্ন বা নির্বোধ কারো।

লেখক: শারমিন সুলতানা 
শিক্ষক নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম