Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

পাকিস্তানে রাজনীতির গন্তব্য কোথায়?

Icon

ফারিহা জেসমিন

প্রকাশ: ১৪ মে ২০২৩, ১০:১৮ পিএম

পাকিস্তানে রাজনীতির গন্তব্য কোথায়?

আমরা দেখতে পাই, গত ৩ নভেম্বর ২০২২, পাঞ্জাবের ওয়াজিরাবাদে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর চেয়ারম্যান ইমরান খানের ওপর সশস্ত্র হামলা চালানো হলে তিনি গুলিবিদ্ধ হন।  

সেই সময় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্থানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে উঠে । এই ঘটনার মাস ছয় পরেই যখন, চলমান রাশিয়া –ইউক্রেন যুদ্ধ এবং করোনা পরবর্তী  কঠিন সময়ে পাকিস্থানের অর্থনীতি ধুঁকছে তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের গ্রেফতার ইস্যুতে আবারো উত্তাল হলো পাকিস্থান।   

বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার এই সময়ে পাকিস্তানে চলছে আর্থিক টানাপোড়েন, রাজনৈতিক মাঠে চরম অস্থিরতা যাকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক দুর্দশার সাথে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার রদবদল এবং সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতাকে প্রকট করে তুলেছে । 

পাকিস্থানে এই রাজনৈতিক সংকট ও উত্তেজনার মধ্যে গত ৯ মে তোশাখানা মামলায় কোর্টে হাজিরা দিতে আসলে বেশ নাটকীয়ভাবেই গ্রেফতার হন ইমরান খান। আল-কাদির ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাকিস্থানের ন্যাশনাল একাউন্টাবিলিটি ব্যুরো তাকে গ্রেফতার করে।  

এই ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ইমরানের রাজনৈতিক নেতাকর্মী এবং সমর্থকেরা।  তারা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। গ্রেফতার হয়েছেন হাজারেরও বেশি মানুষ। সারা দেশে বিক্ষোভ, অগ্নি সংযোগ ছাড়াও পিটিআইয়ের কর্মী-সমর্থকরা সেনা কর্মকর্তার বাসভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালান। পেশোয়ারে রেডিও স্টেশনে হামলা চালানো হয়। 

দলের প্রধানকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সংঘর্ষ-সহিংসতাও থেমে ছিল না দেশজুড়ে। ফলশ্রুতিতে হতাহতের সংখ্যা সহস্র। করাচি, পাঞ্জাব, পেশোয়ার , ইসলামাবাদসহ  বিভিন্ন জায়গায় নিহতও  হয়েছেন অনেকে। সেনা তলব করে ও থামানো যায়নি এই বিক্ষোভ। সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে কোথাও কোথাও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয় । 

ইমরান খানকে গ্রেফতারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে পিটিআইয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে গত শুক্রবার পাকিস্থান সুপ্রিমকোর্ট এই গ্রেফতারকে বেআইনি ঘোষণা করে ইমরান খানকে  জামিন দিলে পিটিআইয়ের নেতা কর্মীরা আনন্দ উল্লাস করেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের অনেকেই আদালতের সিদ্ধান্তকে পক্ষপাতমূলক বলে দাবি করেছেন। 

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে পুনরায় জেলে পাঠানো হবে বলে বিবৃতি ও দিয়েছেন দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাঊল্লাহ। অতীতে পাকিস্থান মুসলিম লীগের নওয়াজ শরীফ কিংবা অন্যদের ক্ষেত্রে এমনটা করা হয়নি বিধায় সুপ্রিমকোর্টের এই রায়ে বিচার বিভাগের মৃত্যু হয়েছে বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ ।  

সংঘাত, সহিংসতা এবং সঙ্কটের রাজনীতি পাকিস্থানে নতুন নয়। পূর্বের ইতিহাসের সূত্র ধরে বলা যায়, বহু বছর ধরেই দেশটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, টানা-পোড়েন চলে আসছে। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্থানের গণতন্ত্রের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। 

২০১৮ সালে তৃতীয়বারের মত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফ স্বীকার করে নিয়ছিলেন যে, পাকিস্থানের রাজনৈতিক ইতিহাস গণতন্ত্রের উপর হামলায় পরিপূর্ণ।  বলা বাহুল্য যে, প্রধানমন্ত্রী পরিচালিত দেশটি আসলে সেনাবাহিনী পরিচালিত তাই সেনাবাহিনীর সঙ্গে সরকারের ভালো সম্পর্ক থাকা আবশ্যক। 

১৯৪৭ সালে জন্মের পর থেকেই পাকিস্থানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী ঢুকে পড়েছিল। বলা হয়ে থাকে, পাকিস্থানে সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ ক্ষমতার মালিক আর প্রধানমন্ত্রী হলেন দ্বিতীয় প্রধান ক্ষমতাধর। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতি আর প্রতিরক্ষানীতি ঠিক হয় সেনা সদর দফতরে, সেখানে বেসামরিক প্রধানমন্ত্রীর কোন এখতিয়ারই নেই। 

সেনা সাহায্যে পাকিস্থানের ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে অনাস্থা ভোটে হেরে গিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হলে দূরত্ব সৃষ্টি হয় ইমরান খান আর সামরিক বাহিনীর মধ্যে। এরপর পাকিস্থান মুসলিম লিগের শেহবাজ শরীফ ক্ষমতায় এলে নতুন নির্বাচনের দাবিতে এবং দেশটিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলনে নামে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ও তার দল । 
যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্থান সামরিক বাহিনীর পরোক্ষ অসহযোগিতায় ক্ষমতায় টিকতে পারেননি বলে ব্যাখ্যা করেছিলেন একসময়কার জনপ্রিয় ক্রিকেট তারকা ইমরান খান। সেনাবাহিনীর ছত্র ছায়ায় থেকে সমালোচিত ইমরান নিজেই সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। 

২০২২ সালের ২১ অক্টোবর দুর্নীতির অভিযোগে ইমরানের ওপর পাকিস্থানের নির্বাচন কমিশন ৫ বছরের জন্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে যার কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না ইমরান। খারিজ করা হয় তার সংসদ সদস্য পদও। এরপর থেকেই পাকিস্তানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দানা বাধতে থাকে, পাশাপাশি শক্তিশালী জনসমর্থন পেতে থাকে ইমরানের দল পিটিআই। 
এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সময়কালে পাকিস্থানের অর্থনীতি চরমাকারে ভুগতে শুরু করে। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির ( বর্তমান ৩৬.৪২%) কারণে দীর্ঘদিন ধরেই দেশটির নিত্যপণ্য জনসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় সরকার বিরোধী মনোভাব তীব্র হয়ে উঠেছে । 

সংবিধান অনুযায়ী ২০২৩ সালের শেষের দিকে পাকিস্থানে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে এবং ১৪ মে পাঞ্জাব প্রাদেশিক পার্লামেন্টের নির্বাচন এর নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে  সুপ্রিমকোর্ট। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকার আর্থিক দুরবস্থা দেখিয়ে তা স্থগিত করে রেখেছেন আর পিটি আই প্রধান ইমরান খান অবিলম্বে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছেন।  

সেনাশাসন দেশটিতে নতুন নয়। জন্ম থেকে অর্ধেকের বেশি সময় পাকিস্থান মিলিটারি দ্বারা শাসিত হয়েছে।  

ইতিহাস বলছে, সামরিক বাহিনী দেশটিতে বরাবরই ক্ষমতার কেন্দ্রেই থেকেছে। অতীতে কোন গণতান্ত্রিক সরকার পূর্ণ মেয়াদে পাকিস্থানের ক্ষমতায় থাকতে পারেননি।  নিরাপত্তা ইস্যুতে সেনাবাহিনীকে প্রাধান্য দেওয়ার কারণে সরকারের খুব কাছাকাছি থেকে সেনাবাহিনী প্রভাব বিস্তার করেছে বলে আমি মনে করি।  

 ইমরান খানের পতনের পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন করে সেনাবাহিনীর ভূমিকার কথা আলোচনায় এসেছে এবং তার বিদায়ের নেপথ্য কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনীকে । 

একদিকে চরম আর্থিক সংকটের কারনে ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর জনগণের অসন্তোষ, অন্যদিকে ইমরান খানকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা। 

পাকিস্থানের এমন নাজুক অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক  পরিস্থিতিতে কে বা কারা গঠন করবে পরবর্তী সরকার?  কোন গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে পাকিস্থানের রাজনীতি তা আসলে একটি জটিল সমীকরণ । 

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম