প্রতীকী ছবি
শব্দদূষণের কারণে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা অন্য যে কারও থেকে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন মহানগরীতে শব্দদূষণ একটি বড় সমস্যা। ঢাকা শহরের শব্দদূষণ এখন একটি বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছেছে।
জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি (ইউএনইপি) ২০২২ সালের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ঢাকা শব্দদূষণে শীর্ষ শহর। এ তালিকা অনুযায়ী, বাংলাদেশের আরেকটি শহর চতুর্থ স্থানে অবস্থান করছে, আর সেটি হচ্ছে রাজশাহী।
শব্দদূষণের কারণে নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ ও শিশুসহ সবার ক্ষতি হয়। এটি সব গবেষণা ও তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রমাণিত। কিন্তু আমরা হয়তো জানি না যে, শব্দদূষণের কারণে আমাদের সমাজের একশ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বেশি সমস্যা ও ক্ষতির সম্মুখীন হয়, আর তারা হলেন— দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।
শব্দ হচ্ছে— দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চোখের আলো। একজন মানুষ যখন দৃষ্টিশক্তি হারায়, তখন তার পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের মাঝে শ্রবণশক্তি সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ধরনের শব্দ বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা তাদের দৈনন্দিন সব কাজ করে থাকে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য শব্দ বিশ্লেষণের বিষয়টি সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় পথ চলতে গিয়ে।
শব্দ বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি একটি ছবি অঙ্কন করে তার মস্তিষ্কে। যার মাধ্যমে সে বুঝতে পারে যে একটি গাড়ি কোন দিক থেকে আসছে, কতটা দূরে আছে এবং গাড়ির গতি কত। তার পর সেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিটি তার চলার গতিবিধি নির্ধারণ করে থাকে।
কিন্তু ঢাকা শহরে যে মাত্রায় শব্দদূষণ হয়ে তার ফলে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির পক্ষে শব্দ বিশ্লেষণের মাধ্যমে পথচলা অনেক কঠিন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্ভব। যার ফলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা স্বাচ্ছন্দ্যেও নিরাপদে পথ চলতে পারছে না। আর তাদের চলাচল সীমিত হয়ে পড়ছে।
শব্দদূষণ যে শুধু চলাচলে বাঁধার সৃষ্টি করছে তা নয়। চারদিক থেকে অতিউচ্চমাত্রায় শব্দ তীব্র মানসিক চাপ এবং উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য। শব্দদূষণ যে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য কতটা সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, তার বহু বাস্তব অভিজ্ঞতা আমার আছে।
একবার আমি আমার মায়ের সঙ্গে এলাকার একটি সেলুনে যাচ্ছিলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর পেছন থেকে একটি গাড়ি অনবরত হর্ন বাজাতে থাকে যেন আমরা তাকে পথ ছেড়ে দিই। গাড়ির সেই উচ্চ হর্নের শব্দে ছোট্ট সেই আমি আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। মা আমাকে শক্ত করে আগলে ধরে রাখেন। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই সেই গাড়িটি আমাদের অতিক্রম করে যায়। আর যাওয়ার সময়ে উচ্চশব্দে হর্ন বাজিয়ে জানান দিয়ে যায় যে— এ রাস্তা তোমার জন্য নয় হে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি!
ঢাকা মহানগরীতে শব্দদূষণের অন্যতম উৎস হলো যান্ত্রিক যানবাহন। বাস-ট্রাক অতিউচ্চমাত্রার হর্ন ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি শব্দদূষণ করে থাকে ব্যক্তিগত গাড়ি। অধিকাংশ সময়ে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারকারীরা তার সামনে থাকা রিক্শা বা অন্য কোনো বাহন থাকলে অনবরত হর্ন বাঁজাতে থাকেন। আর ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় অনবরত হর্ন বাজানোর দৃশ্য সবার কাছেই পরিচিত। ছোট গলিতে প্রবেশ করলে যেন হর্ন বাজানোর মাত্রা আরও বেড়ে যায়। তারা তখন প্রতিবন্ধী-অপ্রতিবন্ধী ধীরগতির যান কোনো কিছুই যেন মানতে চান না।
এখন প্রশ্ন হলো— ঢাকাসহ আমাদের মহানগরীগুলোতে যে মাত্রায় শব্দদূষণ হচ্ছে, সে অবস্থা থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ সব মানুষের জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা কি সম্ভব? এর উত্তরে বলব হা সম্ভব।
একটা সময়ে ছিল ঢাকা পরিচিত ছিল রিক্শার শহর হিসেবে। কিন্তু এখন ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ি তথা যান্ত্রিক যানবাহনের শহর হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ২০১৯ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতিদিন গরে ৫৫টি ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় নামছে। এর পাশাপাশি মোটরসাইকেল, বাস ও ট্রাক নামছে। এ হিসেবে একটা বর সংখ্যায় যানত্রিক যানবাহন নামছে। আর ওই সব যানবাহন উচ্চ মাত্রার হর্ন ব্যবহার করে থাকে যারা শব্দদূষণের জন্য দাই।
ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরগুলোর শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সর্বপ্রথমেই যান্ত্রিক যান বিশেষ করে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার নিরুৎসাহীত করতে হবে। রিক্শা সাইকেলের মতো অযান্ত্রিক যানবাহন ব্যবহারে বেশি জোর দিতে হবে। ঢাকার অধিকাংশ রাস্তা ২০ ফুট কিম্বা তার চেয়ে কম চওড়া। সেসব এলাকা বা রাস্তায় কোনো প্রকারের যান্ত্রিক যানবাহন চলতে পারবে না। এলাকাভিত্তিক পার্কিংয় ব্যবস্থা করতে হবে। যেন মানুষ পায় হেঁটে তাতের গন্তব্যে যায়। সাইকেল ব্যবহার যেন আরও বৃদ্ধি পায় সে লক্ষ্যে পৃথক সাইকেল লেন তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু সে উদ্যোগটির দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। আমরা যদি শব্দদূষণ হতে মুক্তি পেতে চাই, তা হলে এ রকম পরিকল্পনাগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন করা খুব প্রয়োজন।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কথা চিন্তা করে শব্দদূষণ বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথাটি হয়তো অনেকের কাছেই কিছুটা অযৌক্তিক বা অদ্ভুত সোনাতে পারে। কিন্তু, আমরা যদি শব্দদূষণ মুক্ত শহর গরে তুলতে চাই, তাহলে আমাদের কোনো একটা ভিত্তি ধরে শুরু করতে হবে। আর সেটা হতে পারে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য একটা শব্দদূষণ মুক্ত পরিবেশ তৈরি করার ধারণার মাধ্যমে। উন্নত বিশ্বের নগর পরিকল্পনাবিদ ও নগর পিতাদের মাঝে একটা কথা প্রচলিত আছে— যে শহর নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বান্ধব, সে শহর সবচেয়ে ভাল বা বাস যোগ্য।। উচ্চ মাত্রার শব্দদূষণের কারণে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চলাচল অনেক সীমিত হয়ে পড়ছে। যার ফলে তাদের শিক্ষা কর্মসংস্থান সহ সার্বিক উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের মূল স্রোত ধারায় ধরে রাখতে শব্দদূষণ বন্ধ করার বিকল্প নেই।
লেখক: সহকারী পলিসি কর্মকর্তা,
ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবিং বাংলাদেশ
ইমেইল- rifatir2@gmail.com