প্রথম ঈদের অভিজ্ঞতা, সেটাও গ্রামেই। আমার নানাবাড়িতে। ভোর সকালে উঠে ঝাঁপ দিয়ে পুকুরে পড়া।পাজামা পাঞ্জাবি পরে ঈদগাহে যাত্রা। তখন এক আনায় রঙ করা কাগজের টুপি পাওয়া যেতো। বেশিদিন না টিকলেও ঈদের দিনটাকে রঙিন করে তুলতো। বিত্তহীন সমাজে এর বেশ কদর ছিল।
ঈদগাহ এক গ্রাম পরে। প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে যাওয়া লাগতো। একটি প্রাচীন পুকুরের পাড়ে উঁচু জায়গায় নামাজের স্থান। তখনও ঈদুল ফিতর প্রচলিত হয়নি। ওটা ছিল রোজার ঈদ। এই উঁচু জায়গা থেকে যতক্ষণ মানুষ দেখা যেতো, জামাত শুরু করতে ততোক্ষণ দেরি করা হতো। জায়নামাজ অল্প কিছু মানুষের থাকলেও বেশির ভাগই ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে যেতো। বৃদ্ধ নিচনপুরের মুনশি ইমামতি করতেন। তার মৃদুস্বরের তিলাওয়াত শেষ মাথায় পৌঁছতো না। তখন মাইক্রোফোন ছিল না। মোকাব্বির ছিলেন বাজখাঁই গলার আজহার আলী মুনশি। গ্রামের ভাষায় আজাইরা মুনশি। তার তাকবিরের আওয়াজে কারো কারো নিয়ত ছুটে যাওয়ার উপক্রম হতো। নামাজের শেষে যার যার মতো ফিরে আসা। এত বেশি কোলাকুলির রেওয়াজ তখন ছিল না। নতুন জামা গায়ে দিয়ে পাশের গ্রামের আত্মীয় বাড়িতে যাওয়া বা দলেবলে পাকা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা, এই তো ঈদ। এর সঙ্গে যোগ হতো দুধ সেমাই, পোলাও আর কোরমা। খাওয়া দাওয়ার মধ্যেও তখন আনন্দ ছিল। আর সালামি বলতে ছিল নানা-নানির আনি, দুআনি। খুব বেশি হলে সিকি, আধুলি। তাও দিনের শেষে গুণলে কয়েক টাকা হয়ে যেতো। নিজেকে একটু বড়লোক বড়লোক মনে হতো।
এই মোকাব্বিরকে নিয়ে কুমিল্লায় একবার ঘটে গেল গোলযোগ। মুক্তিযুদ্ধের পর কেন্দ্রীয় ঈদগাহে ইমামতি করছিলেন দৌলতপুরের হাফেজ সাহেব। এই সেন্ট্রাল ঈদগাহে নামাজ পড়ে সব পলিটিক্যাল অ্যাকটিভিস্টরা। সাধারণ ব্যাপার নিয়ে অনেক সময়ই লেগে যায়। তখন মাইক্রোফোন ছিল না। মোকাবিররা দেরিতে তাকবির দিয়েছেন বলে নামাজ দ্বিতীয় বার পড়ার জন্য চাপ দিল এক পক্ষ। আরেক পক্ষ বিপক্ষে। ডিসি সাহেব কিছু বলতে গেলে জুতা দেখালো তারা। পুনরায় একই নামাজ পড়তে গেলে তাতেও সহযোগিতা করলো না এক পক্ষ।
হঠাৎ গ্রাম থেকে এসে কুমিল্লা শহরে কেমন যেন ঈদ ঈদ লাগতো না। সেই অবারিত প্রকৃতি নেই। যেমন ইচ্ছা হাঁটার স্বাধীনতা নেই। তবে তার স্থান নিল রেডিও। ঈদের চাঁদ দেখা গেলেই ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে’ শুনলেই ঈদের আবহ চলে আসতো। মোটা ঈদ সংখ্যা জোগাড় করতাম ঈদের ছুটিতে পড়ার জন্য। আর ঈদের দুপুরে আমজাদ হোসেনের লেখা জব্বর আলী আর জবা কুসুম রোকন দোলনের মায়ের নাটক তো মাস্ট। নাটক অর্ধেক শুনে বাসা থেকে বের হয়ে অন্য বাসায় গেলেও শুনতাম এ নাটক চলছে। নাটক শেষ হয়ে গেলেও অনেক দিন মুখে মুখে ফিরতো এর সংলাপ-
‘টেকা দ্যান, দুবাই যামু!’
প্রচুর মানুষ আসতো ঈদের দিনে বাসায়। ঈদে কক্সবাজার বা দুবাই যাওয়ার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারতো না। বরং শহরে ঈদের আগের দিন পাড়ার ছেলেরা ঈদ মোবারক, কাইল ঈদ স্লোগান দিয়ে মিছিল করতো। সারা রমজান রাতে সাহরির সময় ডাকতেন অন্ধ হাফেজ, কাসিদা সঙ্গীত শিল্পীরা। ঈদের দিন একটা রিকশা আর মাইক নিয়ে বের হতেন অন্ধ হাফেজ। বাসার সামনে এসে মালিকের নাম মাইকে ঘোষণা দিতেন-
‘ফখরুদ্দিন দ্বীনের ভাই,
মজুমদার সাহেবেরে সালামও জানাই।’
মাঝে মাঝে পুলিশ লাইনে নামাজ পড়া হতো। পুলিশের ইমাম ফখরুদ্দিন সাহেব আব্বার সমসাময়িক। তিনি অবধারিতভাবে বয়ানে বলতেন-
‘এক হি সফ মে খাড়া হ্যায় মাহমুদ আওর আয়াজ।
না কোই বান্দা রাহে গা, না কোই বান্দা নওয়াজ!’
সুলতান মাহমুদ আর তার ভৃত্য আয়াজের একই কাতারে দাঁড়ানোর দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে ‘শের’টিতে।
রোজার উনতিরিশ আর তিরিশ নিয়ে ঝামেলা তখনও ছিল। পাকিস্তানের ‘রুয়্যতে হেলাল’ কমিটি ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ নিজের চোখে দেখার ওপরই আস্থাশীল ছিলেন। ফলে সরকার উনতিরিশে ঘোষণা দিলেও একদল তিরিশটা পুরো করে পরের দিন ঈদ করতো। এখনকার ভিন্নপন্থিরা আবার অন্য রকম। তারা সৌদি আরবের সঙ্গে মিলিয়ে একদিন আগে রোজা ভাঙতে চান।
ক্যাডেট কলেজে একবার কুরবানির ঈদ করতে হয় পরীক্ষা সামনে ছিল বলে। টিচিং ব্লকের সামনে কুরবানি করে সে মাংস আমরাই খেলাম। বেশি দূর যাওয়ার সুযোগ পেলাম না। আশপাশের বন্ধু বান্ধবদের বাসা, গ্রামের বাড়িতে গেলাম। কিন্তু বাসার জন্য অতোটা মন খারাপ হয়নি কারোরই।
ঈদের সময়ও মেডিকেলের হোস্টেলে থাকতে হয় কোনো কোনো সময়। নিজেদের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররমে যাই। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এক জামাতে নামাজ পড়ি। ফিলিংসটাই অন্য রকম।
তখন ঈদের আগের রাত ছিল ঈদের প্রস্তুতি নেওয়া। বেশি হলে বিটিভিতে প্রচারিত আগের বছরের জনপ্রিয় ‘আনন্দ মেলা’ আবার দেখা। তখনকার আনন্দ মেলা ও তার উপস্থাপকের জনপ্রিয়তা এখন কল্পনাও করা যায় না।
ঢাকায় থাকতে থাকতে জানলাম একটা জিনিস ‘চানরাইত’। এইরাতও যে বেশ আচার অনুষ্ঠান, হই চই, শপিং করে পার করতে হয়, তা ঢাকা না আসলে জানতাম না। ঈদের দিনের শান শওকত তো আছেই। কিন্তু কাজির কথা মনে হলে প্রশ্ন জাগে- এসবই কি ঠিক?
‘শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো,
কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো,
বরষের পরে আসিলে ঈদ!’
ঈদ মোবারক!