স্বাস্থ্যসেবা কর্মীদের নিরাপত্তা আইন জরুরি
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ
প্রকাশ: ১৯ এপ্রিল ২০২৩, ০১:০২ পিএম
সমাজের বিভিন্ন স্তরে অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, মূল্যবোধের অবক্ষয় আমাদের ধীরে ধীরে গ্রাস করছে, যুক্তি আর বিবেচনাবোধ লোপ পেয়ে আবেগতাড়িত আগ্রাসী আচরণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তুচ্ছ অপরাধে বিচার হাতে তুলে নিয়ে মানব হচ্ছে দানব। ছেলেধরা সন্দেহে নির্দয়ভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা আর চুরি-ছিনতাই-পকেটমারার অভিযোগে গণপিটুনি হচ্ছে অহরহ।
কেউ মারছে, কেউ পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ দিচ্ছে, প্রহারকারী বা উৎসুক জনতার হৃদয়ে দয়ার উদ্রেক হয় না। কেউ মোবাইলে ছবি তোলায় ব্যস্ত, কেউবা করছে ভিডিও। এক্ষেত্রে সত্য-মিথ্যা যাচাই তো পরের কথা, আইন নিজের হাতে তুলে কাউকে প্রহার করা যায় কিনা তা ভাবার অবকাশ কারও নেই। আজকাল আবার ‘সোশ্যাল মিডিয়ায়’ সত্য বা কাল্পনিক ‘স্ট্যাটাসের’ জেরে ভাঙচুর আর মারধরের ঘটনা ঘটছে। মনমতো কাজ না হলেই অফিস ভবন আর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর চলছে। নির্মম এ আচরণের অন্যতম লক্ষ্য আমাদের স্বাস্থ্যখাত।
স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও স্বাস্থ্যকর্মীর ওপর হামলাজনিত ঘটনা নানা কারণে হয়ে থাকে। অনেক সময় হাসপাতালে লোকবল, অর্থবল আর অন্যান্য সুবিধার অভাবের দায়ভার ডাক্তারের ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে হেনস্তা করা হয়। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা বোধকরি, ভুল চিকিৎসা বা অবহেলার অভিযোগ তুলে তাদের লাঞ্ছনা।
তথাকথিত ‘ভুল চিকিৎসা’ আর ‘চিকিৎসায় অবহেলার’ অভিযোগ এখন নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগীর মৃত্যু হলেই স্বজনরা আবেগাপ্লুত আর উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, ভুল চিকিৎসার অভিযোগ তোলেন, চিকিৎসককে ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। সবাই নয়, কিন্তু অনেকেই। ডাক্তারদের সীমাবদ্ধতা, রোগীকে বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা আর সদিচ্ছা তাদের চোখে পড়ে না।
অভিযোগ একটাই- ভুল চিকিৎসা, না হলে রোগী মরবে কেন? ফলে শুরু হয় ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ। আরও ভয়ংকর হচ্ছে, মারা গেলেই অবহেলার অভিযোগে হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরি ভাঙচুর, কর্মরত ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর আক্রমণ, এমনকি মামলা দিয়ে হয়রানি করা। অনেক সময় তদন্ত ছাড়াই চিকিৎসককে গ্রেফতার করা হচ্ছে।
আবার অনেক ক্ষেত্রে কিছু গণমাধ্যমে যথাযথ অনুসন্ধান না করেই ‘ভুল চিকিৎসা’ বা ‘ভুল ওষুধ দেওয়ার’ অভিযোগ এনে বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রকাশ করা হচ্ছে। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ‘সোশ্যাল মিডিয়ায়’ চিকিৎসক বা চিকিৎসাকেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রচারণা চলছে কোনো প্রমাণ ছাড়াই। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগেই যুক্তিহীন এসব কর্মকাণ্ড কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।
আস্থাহীন উত্তেজিত জনতা, কিছু গণমাধ্যমের দায়িত্বহীনতা ও ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতারের ভয়ে ত্রিমুখী চাপে চিকিৎসকরা অনেকটাই বিপর্যস্ত। অধিকাংশ চিকিৎসকদের মাঝেই চাপা ক্ষোভ ও নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্ক বিরাজ করছে। বড় বড় শহরসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে জুনিয়র চিকিৎসকদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। এ অবস্থা উদ্বেগজনক, শুধু চিকিৎসকদের জন্যই নয়, রোগীদের জন্যও। এতে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে আস্থার অভাব দেখা দিচ্ছে। রোগী চিকিৎসা নিয়ে সন্দিহান হচ্ছেন; যে চিকিৎসা দেশে সুলভে সম্ভব, তার জন্য বিপুল খরচ করে বিদেশমুখী হচ্ছেন।
বর্তমানে এ অবস্থা ভয়াবহ, সুষ্ঠু চিকিৎসার পরিবেশের অন্তরায়। সামান্য ঘটনার জের ধরে অযথা ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের গায়ে হাত তোলার মতো ঘটনা ঘটেই চলছে। ফলে যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা চিকিৎসা দেওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে জটিল ও মুমূর্ষু রোগীদের জরুরি চিকিৎসাসেবা প্রদান করতে গিয়ে ডাক্তাররা ভয়ভীতির মধ্যে কাজ করছেন।
একটু সমস্যা মনে হলেই ভয়াবহ পরিণতির মধ্যে পড়তে হবে ভেবে চিকিৎসা না দিয়ে এবং নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্য হাসপাতালে রেফার্ড করে দায়িত্ব এড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। ফলে জরুরি চিকিৎসাসেবাও অনেকাংশে হুমকির সম্মুখীন। এটি গল্পসাহিত্য বা সিনেমার কোনো অনুষঙ্গ নয়, হরহামেশাই ঘটে যাওয়া চিত্র। এসব ঘটনা আমাদের স্বাস্থ্য খাতকে যে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে, তা আমরা খোলা চোখে দেখি না। কিন্তু এ রকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের স্বাস্থ্য খাতে যে বিপুল সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তা শিগগির মুখ থুবড়ে পড়বে।
আবেগবর্জিত দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আমরা সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর দিকে চোখ রাখি, তাহলে অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এবং রোগের ধরন বিবেচনা করলে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীদের মৃত্যু অস্বাভাবিক ছিল না, রোগটির কারণেই মৃত্যু অবধারিত ছিল। অনেক জটিল রোগেই রোগীকে বাঁচানো যায় না। যেমন ম্যাসিভ স্ট্রোক, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক, ছড়িয়ে যাওয়া ক্যানসার, সেপসিস, সেপটিক শক, কিডনি বা লিভার বিকল হয়ে যাওয়া ইত্যাদি অনেক রোগ সবসময় নিরাময়যোগ্য নয়।
মুমূর্ষু রোগীদের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়, সেখানেও মৃত্যুর হার বেশি। শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে চিকিৎসা কখনই সম্ভব নয়। মৃত্যু অমোঘ, চিরন্তন। চিকিৎসকরা রোগের উপশম ও রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারেন মাত্র, জীবন-মৃত্যুর ফয়সালা তাদের হাতে নেই। কোনো রোগী মারা যাক, তা কোনো চিকিৎসকেরই কাম্য নয়। তবু শোকার্ত হƒদয়ে তাকে অনেকের মৃত্যুই মেনে নিতে হয়। এটাই নির্মম বাস্তবতা। চিকিৎসক হিসাবে এ আমাদের করুণ সীমাবদ্ধতা।
কেবল বাংলাদেশেই নয়, অনেক দেশেই এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। ২০০৯ সালে দেওয়া ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের এক যুগান্তকারী রায় অনুযায়ী কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলা হলে তার প্রাথমিক সত্যতা ছাড়া ওই চিকিৎসককে গ্রেফতার করা যাবে না। এক্ষেত্রে প্রথমে কোনো যোগ্য বিশেষজ্ঞ বা বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতামত নিতে হবে। এরপরই শুধু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করা যাবে।
আদালত মনে করেন, চিকিৎসা পেশাকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করায় অত্যন্ত তুচ্ছ ঘটনায়ও চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ বাড়ছে। তাই তদন্ত প্রক্রিয়ায় যারা শেষ পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হবেন না, তারা যেন অযথা হয়রানির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করা দরকার বলে আদালত মত প্রকাশ করে।
এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক করে বলা হয়, আনীত অভিযোগ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত চিকিৎসকদের যেন গ্রেফতার বা হয়রানি না করা হয়, অন্যথায় তাদেরও আইনগত ব্যবস্থা মোকাবিলা করতে হবে। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের ওই রায়ে আরও উল্লেখ করা হয়, প্রকৃত অর্থে যেসব চিকিৎসক চিকিৎসায় অবহেলার সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রতি আদালতের কোনো সহানুভূতি নেই।
২০১০ সালে ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্য সরকার চিকিৎসকদের ওপর হামলা বন্ধে আইন পাশ করে। এ আইনে কেউ চিকিৎসকদের ওপর হামলা করলে তাকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাসেবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও হাসপাতালে হামলা ফেলোনি বা গুরুতর অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হয়। স্টেট ভেদে সর্বোচ্চ শাস্তি বিভিন্ন মাত্রায় হয়ে থাকে।
২০১৮ সালে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে সেফ নাইট আউট স্ট্র্যাটেজির আওতায় চিকিৎসক ও হাসপাতালে হামলার ঘটনায় দোষীদের ১৪ বছরের জেল দেওয়ার বিধান করা হয়। চীনে চিকিৎসক ও হাসপাতালে হামলা এতটাই প্রচলিত যে, অভিধানে নতুন একটি চীনা শব্দ ‘ইয়েনাও’, যার অর্থ চিকিৎসায় অরাজকতা, যুক্ত হয়েছে। ২০০৭ সালে ‘নিরাপদ হাসপাতাল ক্যাম্পেন’ শুরু হয়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে চীনের ১১টি মন্ত্রণালয় এবং বিভাগ হাসপাতালের প্রতি ২০ বেডের বিপরীতে একজন নিরাপত্তারক্ষী, স্বাস্থ্যকর্মীর অন্তত ৩ শতাংশের বেশি সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ, সিকিউরিটি অ্যালার্ম এবং সিসিটিভি স্থাপনসহ বিভিন্ন সুপারিশ করে।
২০১৪ সালে সুপ্রিমকোর্ট, বিচার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কমিশন নতুন গাইডলাইন প্রণয়ন করে, যেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ১৯৯৯ সালে স্বাস্থ্য খাতে হামলা রোধে জিরো টলারেন্স জোন ক্যাম্পেন চালু করে। স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিশ্চিতে এনএইচএস সিকিউরিটি ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস নামে পৃথক বিভাগ খোলে।
এর আওতায় যে কোনো সহিংসতা কর্তৃপক্ষকে জানানো, তদন্ত, পুলিশ এবং বিচারিক কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন, স্বাস্থ্যকর্মীদের সব ধরনের সহায়তা এবং সহিংসতা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা জোরদার ও নিশ্চিত করা হয়। প্রয়োজনে রোগীকে লিখিত সতর্কতা বা ইয়েলো কার্ড, গুরুতর ব্যবস্থা হিসাবে রেড কার্ড এবং সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা প্রদানে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
ক্রিমিনাল জাস্টিস অ্যান্ড ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট, ২০০৮-এর আওতায় স্বাস্থ্যকর্মীদের কাজে বাধা প্রদানে ১০০০ পাউন্ড জরিমানার পাশাপাশি রোগীর আত্মীয়স্বজন, যারা চিকিৎসা প্রদানে বিঘ্ন ঘটায়, তাদের হাসপাতাল ত্যাগ করতে বাধ্য করার ক্ষমতা এনএইচএসকে দেওয়া হয়।
এ ছাড়াও বেশকিছু আইন হেলথ অ্যান্ড সেফটি অ্যাট ওয়ার্ক ইটিসি অ্যাক্ট ১৯৭৪, হেলথ অ্যাক্ট ১৯৯৯ ম্যানেজমেন্ট অফ হেলথ অ্যান্ড সেফটি অ্যাট ওয়ার্ক রেগুলেশন, ১৯৯৯ কার্যকর আছে। স্কটল্যান্ডে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য দি ইমার্জেন্সি ওয়ার্কার অ্যাক্ট ২০০৫ অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি ৯ মাসের জেল এবং ৫ হাজার পাউন্ড জরিমানার বিধান আছে। নেপাল স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সুরক্ষার জন্য ২০১০ সালে আইন পাশ করে এবং স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা সমন্বয় কমিটি প্রবর্তন করে। আইন ভঙ্গকারীর সর্বোচ্চ ১ বছরের জেল এবং ৩ লাখ রুপি জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল রিভিউ অফ রেড ক্রসের ২০১৩ সালে প্রকাশিত ভায়োলেন্স এগেইন্সট হেলথ কেয়ার: পার্ট ওয়ানে যে পদক্ষেপ আবশ্যক বলা হয়েছে তা হলো, যে কোনো পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা চালিয়ে যাওয়ার পূর্বশর্ত একটি পরিপূর্ণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ আইনগত কাঠামো। যদি চিকিৎসকদের জন্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করা না যায়, তবে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ ও জটিল হয়ে উঠবে।
তাই জনস্বার্থেই চিকিৎসক ও চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা বন্ধে স্থায়ী সমাধান এখন সময়ের দাবি। চিকিৎসকের পেশাগত দক্ষতা, আন্তরিক প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব হলো নাগরিকের অন্যতম মৌলিক অধিকার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা সুরক্ষায় নির্দিষ্ট আইনের এখনো ঘাটতি আছে। সরকারের উচিত অন্যান্য দেশে নেওয়া প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে এ দেশেও চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী এবং চিকিৎসাসেবা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মী ও হাসপাতালের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে যথাযথ আইন প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
ভয়াবহ এ সমস্যার মূলে রয়েছে বিদ্যমান স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর রোগীদের আস্থার অভাব। এর স্থায়ী সমাধান করতে হলে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। শুধু আইন দিয়ে আস্থা অর্জন সম্ভব নয়। এর জন্য চাই সব পক্ষের সদিচ্ছা আর প্রয়াস। নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই চিকিৎসাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে।
দক্ষ চিকিৎসক তৈরির সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে, হাসপাতালগুলোকে সক্ষম করে তুলতে হবে, জরুরি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ সহজ এবং দ্রুত করতে হবে, স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন স্তর বা কোথায় কেমন সেবা পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে জনগণকে অবহিত করতে হবে। ডাক্তারদেরও মনে রাখতে হবে, রোগীর আস্থা অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। দক্ষতা ও পেশাগত আচরণের মাধ্যমে রোগীর চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হলে অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
সংবাদমাধ্যমের দায় আছে ডাক্তারকে দায়ী করে একতরফা ভিত্তিহীন রিপোর্ট না করার। রোগী ও তার আত্মীয়স্বজনদেরও দায়িত্ব রয়েছে চিকিৎসকের ওপর আস্থা রাখা, সেবাসংক্রান্ত প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞাসা করা এবং সব ধরনের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ আর ভাঙচুর পরিহার করা। তাদের বোঝা উচিত, যেহেতু ডাক্তারের কাছে কোনো না কোনো সময় চিকিৎসার জন্য যেতেই হবে, তাই তাদের সঙ্গেও ভদ্র, মার্জিত, সহনশীল আচরণ করা উচিত। একতরফা শুধু ডাক্তারকে দোষ দেওয়াটাও অন্যায়।
ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তা অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে করা উচিত। শুধু আবেগের বশে ভাঙচুর বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ যেন না হয়। সবচেয়ে উন্নত দেশের ডাক্তারেরও ভুল হয়। প্রয়োজনে মামলা হতেই পারে। কিন্তু অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কোনোভাবেই যেন গ্রেফতার ও হয়রানি না করা হয় এবং তাদের সঙ্গে খুনের মামলার আসামির মতো আচরণ কোনোক্রমেই কাম্য নয়।
কারও বিরুদ্ধে চিকিৎসাসংক্রান্ত মামলা হলে গ্রেফতারের আগে বিএমডিসির অনুমতি নেওয়া উচিত। ডাক্তারদের ওপর হামলায় দায়ী ব্যক্তিদের যেন আইনের আওতায় আনা হয়। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হবে- এ বিষয়টি সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে।
রোগী, তার আত্মীয়স্বজন, ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মী সবার মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ফিরিয়ে আনার বিকল্প নেই। প্রশাসনের উচিত ডাক্তার ও চিকিৎসাসেবাসংশ্লিষ্ট অন্যদের নিরাপত্তায় যথাযথ আইন প্রণয়ন এবং তার প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
স্বাস্থ্যকর্মী, সন্ত্রাসী, ভাঙচুরকারী যিনিই দোষী সাব্যস্ত হবেন, তার যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা না হলে ডাক্তাররা স্বাধীনভাবে চিকিৎসা দিতে ভয় পাবে, জনগণের আস্থা আরও হারাবে, জনগণ আরও বিদেশমুখী হবে, স্বাস্থ্য খাতে যে বিপুল সাফল্য অর্জিত হয়েছে তা মুখ থুবড়ে পড়বে।
ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ: ইমেরিটাস অধ্যাপক, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক