সুপ্রিয় বন্ধু আমার,
ভালবাসা নিও। আমরা ইট কাঠের ঢাকা শহরেই বাস করি, কিন্তু অজানা কারণে আমরা আছি যোজন যোজন দূরে। আমাদের বন্ধুত্বের তীব্রতা এতোটাই ছিল যে আমাদের এই দুরত্বের বিষয়টি কল্পনাতীত। মাইলের মানদন্ডে আমাদের অবস্থান যে খুব দূরে তা কিন্তু নয়, তুমি বাসা বাঁধলে ধানমন্ডি আর আমি নিকুঞ্জে।
১৯৭৪ সালের একদম শেষে চরম উদ্দীপনা নিয়ে ক্লাস শুরু করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। প্রতিদিনই নতুন নতুন সহপাঠীর সাথে পরিচিত হতে থাকি। একদিন তুমি আমার হাত ধরে বললে, “শেলী তোমাকে খুব ভাল লাগে, আমার বন্ধু হবে?” আমি আমার ববকাট চুল ঝাঁকিয়ে বলেছিলাম, “আমি সবার বন্ধু হতে চাই”। তুমি আমায় মৃদু ধাক্কা দিয়ে জোরে জোরে পা ফেলে লম্বা করিডোর পেরিয়ে চলে গেলে বটতলায়। একা দাঁড়িয়ে থাকলে রাস্তার দিকে মুখ ফিরিয়ে। আমিও পিছু পিছু গেলাম, বললাম, রাগ করেছো। তুমি আবারো একই প্রশ্ন করলে। বললাম তোমাকেও আমার খুব ভাল লাগে। তোমার চোখে মুখে হাসির ঝলকানি, বললে চলো আমাদের বাসায় যাই। আমি অবাক হয়ে জানতে চাই, কোথায়? বললে এইতো কাছেই। তুমি আমার হাত ধরে রাস্তা পার হলে। নিয়ে এলে ফুলার রোড়ের ৪ নম্বর বাংলোতে। তোমার বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রোভিসি। তোমার সাথে দুপুরের খাবার খেলাম। আমাদের দুজনারই খুব কাছের বন্ধু ছিল পারু। প্রায় প্রতিদিনই ক্লাসের ফাঁকে সময় পেলেই তুমি জিদ করতে আমাদের দু’জনকে তোমার বাসায় যেতে। কোনোদিন যেতে না চাইলেই হতো বিপত্তি। তুমি কথা বন্ধ করে দিতে।
এখনো ভেবে পাইনা, তুমি এমন কেনো করতে। ভাবছি কতটা ভালবাসলে এতোটা অধিকার নিয়ে অভিমান করা যায়। তুমি তোমার মনে যা আসতো তাই বলতে, কোনো রাখঢাক নেই। কতবার যে রাগ করে কথা বন্ধ করেছো তার হিসেব নেই। তুমি কেনো এমন আচরণ করো, এই নিয়ে আমি আর পারু প্রায়ই কথা বলতাম। তোমাকে বুঝতে চাইতাম। তুমি ছিলে সবার চেয়ে আলাদা।
সুন্দর পোষাক, মার্জিত সাজ-সজ্জা আর শিশুসুলভ আচরণের জন্য ক্লাসের মূল আকর্ষণ ছিলে তুমি। অনার্স পরীক্ষার পর তোমার মা তোমার বিয়ে দিয়ে দেন। হাউজিং সেটেলমেন্টের ইঞ্জিনিয়ার মুশফিকুর রহমানের সাথে। খুব সুখী হলে তোমরা। তোমার গল্প শুনে জীবন সম্পর্কে একটা সুন্দর অনুভূতির জন্ম নিলো। এম এ পাস করার পর আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম। দীর্ঘ বিরতির পর আবার দেখা। তুমি তখন শান্তনু আর শ্রেয়ার মা। কিন্তু কথাবার্তা ঠিক আগের মতই। তুমি যা বলবে তাতে সাঁই না দিলে পারু আর আমার সাথে কথা বন্ধ। আর তাতে কষ্টও পেতে তুমি। দুদিন পরেই আবার ফোন করতে যেনো কিছুই হয়নি।
আমাদের সাথে ছেলেমানুষি করলেও পেশা জগতে সফল ছিলে। তুমি শিক্ষা ক্যাডারে যোগ দিয়ে ইডেন কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ এবং ঢাকা কলেজে ইতিহাস বিভাগে অত্যন্ত সুনামের সাথে অধ্যাপনা করেছো দীর্ঘদিন। যেখানেই কাজ করেছো সহকর্মী এবং ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তুমি ছিলে খুব প্রিয় এবং অনুকরণীয়। মুশফিক ভাই এখনো খুব গর্ব করে বলেন সব সময় সব কাজেই তুমি খুব সিন্সিয়ার ছিলে।
২০১৫ এর ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা কলেজ থেকে অধ্যাপক হিসেবে পিআরএল -এ গেলে। তোমার আহ্লাদি করে কথা বলা তখনো ছিল। প্রথম দিকে তোমার কথা শুনে অবাক হতাম। পরে বুঝেছি ওটাই তোমার স্বাভাবিক আচরণ।
খুব সুন্দর মনের মেয়ে ছিলে তুমি। সবাইকে সরল মনে বিশ্বাস করতে। তোমার লেখা বই “আমার জীবন একাত্তরের সেই ভয়াবহ দিনগুলি”- এর মুখবন্ধে লিখেছো বন্ধু শেলী আর তাহের তোমাকে লিখতে উৎসাহ যুগিয়েছে। বইয়ের প্রথম পাতায় হাতে লিখেছো, “শেলীকে ভালবাসা, হাস্নু, ৪-৭-১০”। তোমার বইতে কত কথাই না লিখেছো, এখন সব কি করে ভুলে গেলে। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ কাল রাত্রিতে তোমার বাবা শ্রদ্ধেয় ড. মফিজুল্লাহ কবীরকে খুঁজতে এসেছিলো পাক আর্মি। তোমরা দুইরাত সার্ভেন্ট কোয়ার্টারে লুকিয়ে ছিলে। প্রত্যক্ষ করেছিলে ড. জোতির্ময় গুহ ঠাকুতাকে গুলি করার এবং পরিসংখ্যান বিভাগের প্রফেসর মনিরুজ্জামান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার দৃশ্য। তোমরাও ছিলে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। ঐ রাতের ভয়াবহতার প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী ছিলে, বইতে সে বর্নণা পড়লে এখনো গা শিউরে ওঠে। মানতেই হবে তুমি ছিলে খুব সাহসী। তোমার বইয়ের শেষ লাইনটা উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না, লিখেছো, “মৃত্যুর পর যদি কখনো ফিরে আসি তবে যেনো আবার সেই রঙ-বেরঙের ছোটবেলায় ফিরে যেতে পারি-এই প্রার্থনা”।
২০১৬ সালের শেষের দিকে, একদিন মুসফিক ভাই তোমাকে চেক বই হাতে দিয়ে স্বাক্ষর করতে বলেন। তুমি কলমহাতে নিয়ে শিশুর মত হাসতে থাকো, বলো ‘কি করবো’। তোমার মস্তিস্ক স্বাভাবিক কাজ করতে ব্যর্থ হয়।
একদিন আমাকে ফোন করে বললে তুমি আমাকে ভালবাস না। আমি বললাম এ কথা কেনো বলছো। বলেছিলে, “আমি তোমার সব পোষ্টে লাইক দেই কিন্তু তুমি আমার পোষ্টে লাইক দাওনা”। সেদিন তোমাকে আমি ভুল বুঝেছিলাম। বুঝতে পারিনি অসুস্থতা তোমায় ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। তুমি খুব দ্রুত সবকিছু ভুলে যেতে থাকলে, তোমার আচরণ অসংলগ্ন। ২০১৭ সালে মুশফিক ভাই ফোন করে বললেন, “ওকে নিয়ে সব জায়গায় যেতে পারি না। বাড়িতে থেকেও বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে।” মুসফিক ভাই ঠিক করলেন তোমাকে তোমার কাছের বন্ধুদের বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যাবেন। তিনি তোমাকে মিঠু আর পারুর বাড়ি নিয়ে গেলেন। একদিন তোমরা দু’জন এলে আমাদের নিকুঞ্জের নতুন বাড়িতে। বার বার বলছিলে, খালাম্মার সাথে ছবি তুলবো। সবুজ জামদানী, হাতে একগাছি সবুজ কাঁচের চুড়ি, সুন্দর মানানসই গহনা, রং মিলিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগ আর স্লীভলেস ব্লাউজে তোমাকে দারুণ ভাল লেগেছিল সেদিন, সেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মত। ব্যাতিক্রম কেবল আমার নতুন বাসা বা ছেলেদের প্রসঙ্গে একটিও প্রশ্ন করলে না, একবারও বললে না রান্না কেমন হয়েছে। সবসময় যে তুমি আমাদের প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে, আমাদের সেই হাস্নুকে সেদিন আর খুঁজে পেলাম না।
২০১৮ এর এপ্রিল মাস, মুশফিক ভাই একদিন ফোনে বললেন, হাস্নুকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাচ্ছি চেকআপের জন্য। তুমি ফেসবুকে অগনিত ছবি পোষ্ট করলে সিঙ্গাপুর থেকে ঠিক আগের মতই। ক্রমান্বয়ে চোখে ধরা পড়তে লাগলো পোষ্টে ভুল বানান এবং অসংলগ্ন লেখা। বলতাম, হাস্নু দিন দিন আরো ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছে।
তুমি তোমার নিখাদ ভালবাসা সবটুকু আমাদের উজাড় করে দিয়েই বোধকরি আজ নিঃস্ব। ডিমনেশিয়ার (Alzheimer’s) প্রবল আঘাতে তুমি ক্লান্ত, অবসন্ন। নবজাতক শিশুর মত করে মুশফিক ভাই তোমাকে আগলে রেখেছেন। আজ একরাশ অপরাধ বোধে ভুগছি, যত ভালবাসা তুমি আমাদের দিয়েছো, বিনিময়ে আমরা কিছুই দিতে পারিনি। তুমি সহপাঠী বন্ধুদের এক সূতায় বেঁধে রেখেছিলে। কতবার যে তোমার বাড়িতে সহপাঠীরা একসাথে হয়ে আড্ডা দিয়েছি, মজার মজার খাবার খেয়েছি তার হিসেব নেই। ইতিহাস বিভাগের পূনর্মিলনী অনুষ্ঠানে তুমিই আমাদের জড়ো করতে। বহুবার তুমি আমার চাঁদা দিয়ে দিয়েছো, ভুলে যাইনি কিছুই।
আজকাল পারু আর আমার আলোচনায় তুমিই থাকো বেশী সময় জুড়ে। অজান্তেই দু’জনার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ইচ্ছে করে সেই আগের মত তোমাকে জড়িয়ে ধরি, যে কথা শোনার জন্য তুমি প্রতীক্ষায় ছিলে, যা কোনোদিন বলা হয়নি তা বলি। ভালবাসি প্রাণপ্রিয় বন্ধু হাসিনা নিগার কবির হাস্নু, তোমাকে আমরা খুব ভালবাসি।
ভাবছি চিঠিটা তোমার হাতে দেবো। স্বাভাবিক সময়ে এমনটা ঘটলে তুমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতে। আশা করবো বহিঃপ্রকাশ না থাকলেও অন্তর থেকে অনুভব করবে আমরাও ভালবাসতে জানি। দুঃখ শুধু তোমাকে বোঝাতে পারছি না, ভালবাসি বলেই, তোমার অসহায় জীবন-যাপন, অসহনীয় কষ্ট আমাদের কাঁদায়, বুকের মাঝে রক্তক্ষরণ হয়।
মুশফিক ভাইয়ের মত জীবনসঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সব বিপদ, দুঃখ, বিষাদ, কষ্ট থেকে তিনিই তোমাকে আগলে রেখেছিলেন সংসার জীবনে, সে কথা তুমি জানো। কিন্তু যখন সব ভুলে তুমি শিশুর মত হয়ে গেলে, তোমাকে সুস্থ করার জন্য, ভাল রাখার জন্য তিনি তাঁর সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছেন।তিনি নিজের সাধ, আহ্লাদ, অনুভূতি সব বিসর্জন দিয়েছেন শুধু তোমার জন্য, তোমার ভালবাসার প্রতিদান দেবার জন্য। সংসারে এমন মানুষ বিরল। মুশফিক ভাইকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নাই।
শেষ করছি, শুধু বলবো হাস্নু, তুমি বন্ধু নির্বাচনে ভুল করোনি, আমরা সবাই তোমাকে যেমন ভালবাসতাম, এখনো তেমনি ভালবাসি।
ইতি, শেলী
নিকুঞ্জ, ০৭-০৭-২২।
পূণঃ
হাস্নু, তোমাকে লেখা চিঠিটা তোমার হাতে পৌঁছানোর আগেই আজ ১১ এপ্রিল, ২০২৩, ভোর বেলায়, একরাশ অভিমান নিয়ে তুমি পরলোকে যাত্রা করলে। গত ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ আমি আর পারু তোমাকে দেখতে গেলে তুমি শিশুর মত আমাদের হাত ধরে বসে ছিলে। আজ কেমন চুপটি করে ঘুমিয়ে থাকলে। এবারে একটু বেশীই দূরে চলে গেলে। খুব ভাল থেকো বন্ধু আমার।
শেলীনা আফরোজা, পিএইচডি.
প্রাক্তন সচিব।
নিকুঞ্জ, ১১-০৪-২০২৩।