Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

কোরিয়ান বিচ্ছিন্ন পরিবার: মানবাধিকার প্রেক্ষিত

Icon

মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারি ২০২৩, ০১:২৬ পিএম

কোরিয়ান বিচ্ছিন্ন পরিবার: মানবাধিকার প্রেক্ষিত

কোরিয়ান যুদ্ধ। ফাইল ছবি

কোরিয়ান যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯৫০-১৯৫৩ সালে উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে। ১৯৫৩ সালে দক্ষিণ এবং উত্তরের মধ্যে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর থেকে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা তাদের প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা/পুনর্মিলনের দাবি জানিয়ে আসছে। 

এটি ভাবা সত্যিই কঠিন— কেন সব বেসামরিক বিনিময়সমূহ উদাহরণস্বরূপ— একজন মা, ভাই, বাবা বা বোনের সঙ্গে দেখা বা সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলো হলো— আন্তর্জাতিক আইনে যারা বিচ্ছেদের শিকার হয়েছেন, তাদের স্বীকৃত অধিকারগুলো কী? 

সেই অধিকার আদায়ের জন্য কোন পন্থা অবলম্বন করা উচিত? এবং এ সমস্যা সমাধানের জন্য প্রাথমিক স্টেকহোল্ডার / পক্ষ কারা?

কোরিয়ান যুদ্ধের সময় অনেক পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ১৯৫৩ সাল থেকে যুদ্ধের পর বিপুলসংখ্যক পরিবার বিচ্ছেদের শিকার হয়েছে। বিচ্ছেদগুলো ছিল অমীমাংসিত এবং সেগুলোকে বিভিন্ন রূপে শ্রেণিবদ্ধ করা যেতে পারে। যেমন— কোরিয়ান যুদ্ধের সময় বাস্তুচ্যুতির মাধ্যমে বিচ্ছেদ যুদ্ধের সময় এবং পরে জোরপূর্বক অন্তর্ধানের মাধ্যমে বিচ্ছেদ এবং যুদ্ধের পর উত্তর থেকে পালানোর মাধ্যমে বিচ্ছেদ।

যুদ্ধের সময় এবং পরে উত্তর কোরিয়া কর্তৃপক্ষ বহুলোককে অপহরণ করেছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এবং এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছেন, যারা উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে এসেছিলেন এবং স্বজনদের অবস্থান ও যোগাযোগ হারানোর মতো বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তারা গিয়েছিলেন।

একজন উত্তর কোরিয়ানের পালিয়ে যাওয়ার বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার বিবরণ আমি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করি। 
ইনসাইডার উত্তর কোরিয়ান পলায়নকারী স্কট কিমের গল্পটি নিম্নোক্ত ভাষায় বর্ণনা করেছে— ‘যখন আমি আমার মায়ের বাড়ির দরজা খুললাম, তখন আমি হিম হয়ে গিয়েছিলাম, এবং কিছু বলতে পারিনি। কারণ আমার মাকে অবিশ্বাস্যভাবে অন্যরকম লাগছিল। তার গায়ে কোনো চর্বি ছিল না এবং তার পুরো শরীরটি একটি ত্রিভুজের মতো দেখাচ্ছিল, আমি শুধু বাইরে গিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম এবং আবার ফিরে এলাম এবং আমি আমার মাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমরা একসঙ্গে বেশ কিছু দিন পর, তার মায়ের এক বন্ধু তার মাকে লাওস এবং কম্বোডিয়া হয়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়। এক দালাল একটা দল নিয়ে যাচ্ছিল তাদের কাছে অতিরিক্ত জায়গা ছিল। হাঁটতে অক্ষম, কিমের মা কিমকে বলেছিলেন যে, কিমকে যেতে হবে এবং শিক্ষিত হতে হবে। যখন কিমের বিষয়টা স্থির হলো, কিমের মা বলেছিলেন— সে তাকে নিয়ে আসতে পারে এবং অন্যদের সাহায্য করতে পারে। কিম যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

কিম এবং দলত্যাগকারীদের দল সীমান্ত পেরিয়ে লাওসে যাওয়ার আগের রাতে, সে একটি কল পেয়েছিল যে তার মা মারা গেছেন। ফোনে থাকা লোকটি বলেছিল যে তাকে শেষকৃত্যের জন্য ফিরে আসতে হবে। হ্যাংআপ করার পর, আমি কিছু বলতে পারিনি, আমি সারা রাত শুধু কেঁদেছিলাম। আমি সত্যিই সত্যিই ফিরে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি ভেবেছিলাম আমি সেখানে ফিরতে পারব কিনা, আমি তার জন্য কিছুই করতে পারিনি, কিম বলেছিল। আমি দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বিশ্বাস করে যে আমার মা আমার সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হবেন। ২০০৭ সালে, প্রথমবার পালিয়ে যাওয়ার ছয় বছর পর, কিম অবশেষে দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে আসে।’

কোরিয়ান যুদ্ধের পর থেকে দুই কোরিয়ার সরকার পুনর্মিলনের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে। যাই হোক সেই প্রচেষ্টাগুলো নিয়মিত, অবিচ্ছিন্ন বা কার্যকর ছিল না এবং শেষটি হয়েছিল ২০১৮ সালে উত্তর কোরিয়ায়। কিন্তু বাস্তবতা হলো— বেশিরভাগ বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলোরই কোনো ধারণা নেই তাদের প্রিয়জন এখনো বেঁচে আছে বা যোগাযোগ করতে সক্ষম কিনা। 

উত্তর কোরিয়ার তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ার সরকারকে সবসময় এই মানবিক সমস্যা সমাধানে অধিক ইচ্ছুক বলে মনে হয়। সম্প্রতি, ১৯৫০-১৯৫৩ সালে কোরিয়ান যুদ্ধে বিচ্ছিন্ন হওয়া হাজার হাজার পরিবারের সমস্যা সমাধানের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছে।

আমি এই বিশেষ ইস্যুতে প্রাসঙ্গিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিধানসমূহের ওপর ফোকাস করতে চাই। আমিস্টিস চুক্তির ৫৭ ও ৫৯ অনুচ্ছেদসমূহ এই বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে।

প্রথাগত আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের কিছু প্রাসঙ্গিক বিধান রয়েছে, যা সংঘাতের পরিস্থিতি এবং এ ইস্যুকে কভার করে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৪৯ সালের চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, 'সংঘাতের প্রতিটি পক্ষ যুদ্ধের কারণে ছড়িয়ে পড়া পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে করা অনুসন্ধানের সুবিধাদী প্রদান করবে। অনুচ্ছেদ ২৫ দ্রুত এবং বিলম্ব না করে ছড়িয়ে পড়া পরিবারের সদস্যদের মধ্যে চিঠিপত্র ফরোয়ার্ড করার অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। অনুচ্ছেদ ৪৯ একই পরিবারের সদস্যদের স্থানান্তর বা সরিয়ে নেওয়ার সময় আলাদা করা নিষিদ্ধ করে। অতিরিক্ত প্রোটোকল ১-এর ৭৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যে সংঘাতের পক্ষগুলো প্রত্যেক সম্ভাব্য উপায়ে বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলোর পুনর্মিলনের সুবিধা প্রদান করব।

আমি এখানে মানবাধিকার বিধানসমূহের কিছু প্রাসঙ্গিক বিধান উল্লেখ করতে চাই, যা উভয় কোরিয়াই অনুমোদন করেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের অধীনে বাড়ি ও জমি থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ নিষিদ্ধ, উদাহরণস্বরূপ, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তির ১১ অনুচ্ছেদ শিশু অধিকার সংক্রান্ত কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ২৭ এবং নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূর করা কনভেনশনের ১৪ অনুচ্ছেদ। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তির (CCPR) অনুচ্ছে ১৭, ১৮, ১৯ বাক্তিদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তার অধিকারকে স্বেচ্ছাচারী বা বেআইনি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে রক্ষা করে এবং এই অধিকারগুলো ব্যবহার করতে চাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন নিষিদ্ধ করে।

পরিশেষে আমি এই বলে উপসংহার টানতে চাই যে, ওপরে উল্লিখিত বিধান থাকা সত্ত্বেও কোরিয়ান যুদ্ধের সময় এবং পরে বাস্তুচ্যুত হওয়া বিচ্ছিন্নতার শিকারদের বেশিরভাগই তাদের আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি এবং এভাবে তারা এই মানবাধিকার বিধানসমূহের ফল পেতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আমি মনে করি উভয় কোরিয়ার সরকারই এ সমস্যা সমধানের জন্য প্রাথমিক ও প্রধান পক্ষ এবং তাদের উচিত এ সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তরিক হওয়া এবং অধিকারভিত্তিক পন্থাকে অগ্রাধিকার দেওয়া।

লেখক : ব্যারিস্টার অ্যাট ল, আইনজীবী সুপ্রিমকোর্ট ও মানবাধিকারকর্মী।
 

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম