একটি আন্দোলনের ময়নাতদন্ত: শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গায় এখনো একজন শিক্ষক
দেলোয়ার জাহিদ
প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২২, ১১:৫৪ এএম
এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অনড় অবস্থান থেকে সরিয়ে আনতে শাবিপ্রবিরই সাবেক শিক্ষক ও লেখক ড. জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী সাবেক শিক্ষক ইয়াসমিন হককে সঙ্গে নিয়ে অনশনকারীদের কাছে ছুটে যান। ড. জাফর ইকবালের অনুরোধে অবশেষে নানা জল্পনা-কল্পনা শেষে অনশন ভাঙলেন ক্লান্ত শ্রান্ত শিক্ষার্থীরা,বস্তুতঃ রক্ষা পেল তাদের প্রাণ। স্বীকার করতেই হবে, শিক্ষার্থীদের অনশন ভঙ্গের মাধ্যমে গোটা জাতি এক অজানা আশংকা ও অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেয়েছে।
প্রশ্ন উঠেছে ড. জাফর কী শিক্ষার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতে সেখানে গিয়েছিলেন? নাকি সরকারের প্রতিশ্রুতির কোনো বার্তা বয়ে নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন? যাদের মনে এমনতর প্রশ্ন জাগছে তাদের কাছে সবিনয়ে জানতে চাইবো ড. জাফর ইকবালের স্থলে আপনি বা আপনারা সেখানে গেলে কি হতো? শিক্ষার্থীরা কি আপনার এ অনুরোধ, উপরোধ মেনে নিত? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা কি দেখি- সম্প্রতি দেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও এর উপাচার্যদের দুর্নীতি, অনাচার, অবিচার, অমানবিকতা ও নির্লজ্জতার যতসব ঘটনা শিক্ষাঙ্গনগুলোকে চরমভাবে কলুষিত করেছে। ড. জাফর ও প্রফেসর ইয়াসমিনকে প্রথমেই ধন্যবাদ দিন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। কারণ তারা এখনো শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গায় রয়েছেন, সম্মানের জায়গায় রয়েছেন, অভিবাবকের জায়গায় রয়েছেন।
এ কথা কী অস্বীকার করা যাবে যে, এ আন্দোলনে মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে একটি তথাকথিত শ্রেণীর। যারা এ কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ধাপে ধাপে আন্দোলনের দিকে ঠেলে দিয়েছেন ও তাদের জীবনকে সংকটাপন্নের মুখে এনে দিয়েছেন। এটা মনে করা অসঙ্গত হবে না যে, বিভিন্ন প্রবিধান ও নির্দেশিকা লঙ্ঘন করার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে স্বায়ত্তশাসনের সুবিধা নিচ্ছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলন অবশ্যই সফল হয়েছে আর তা দেশে ছাত্র আন্দোলনকে একটি ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। আন্দোলনকারীদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারেনি তৃতীয় কোনো পক্ষ ! ওরা প্রমাণ করেছে শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গায় এখনো রয়েছেন শিক্ষক যে শিক্ষকেরা এত বড় জুলুমের সময়ও সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াননি, সর্বমহল তাদের চিহ্নিত করে রেখেছে।
আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা এখন এক গভীর সংকটে নিপতিত, আকণ্ঠ নিমজ্জিত দুর্নীতিতে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ বৈষম্যহীন শিক্ষার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা যেন জেঁকে বসেছে। অর্থবহ শিক্ষা লাভের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা ভেদে শিক্ষার্থীরা গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে বিদেশে পড়াশোনার কথা ভাবতে শুরু করেছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল যে পরিবর্তন, পরিমার্জন ও সংস্কার প্রযোজন এর পরিকল্পনা কোথায়? কোথায় সে জনবল? কোথায় সে শিক্ষক? কোথায় সেই রাজনৈতিক সদিচ্ছা?
সম্প্রতি "বাংলাদেশের পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দক্ষ জনশক্তি সরবরাহে ব্যর্থ" শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। এছাড়াও অপর কয়টি নিবন্ধ এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও সংশোধণের কিছু প্রস্তাবনা ও তুলে ধরে ছিলাম । খুবই আশান্বিত হয়েছিলাম সরকারের শিক্ষা আইন চূড়ান্ত করার উদ্যোগ দেখে। এরই মাঝে শুরু হলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের সাদামাটা একটি আন্দোলন। উত্তেজনা সৃষ্টির সুনিপুণ কৌশলে এ আন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেলো একটি শ্রেণি, শিক্ষার্থীদের উপর আক্রমণ, লাঠিপেটা, টিয়ার গ্যাস যা কিছু করা দরকার ! সরকারের ইগো বা প্রেস্টিজ ইস্যু এর ধোয়া তুলে জটিল করা হলো সমস্যা সমাধানের। এক ধরনের ‘গোঁয়ার্তুমির’ আশ্রয় নিয়ে অমানবিক কিছু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেও শেষতক সফল হয়নি প্রশাসন। শুধু সরকার নয় দেশকে স্বস্তি এনে দিলেন একজন শিক্ষক।
বিপর্যয়কর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পর আমরা আশান্বিত যে, সরকার শিক্ষার্থীদের সব দাবির সম্মানজনক সমাধান করবে এবং শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে একজন শিক্ষকের মাধ্যমে তার হুবহু প্রতিফলন বা বাস্তবায়ন ঘটাবে; যা দেখার জন্য অধীর অপেক্ষায় দেশবাসী।