Logo
Logo
×

দৃষ্টিপাত

‘মেডিকেল ইমার্জেন্সি’ আর ‘জরুরি অবস্থা’ এক নয়

Icon

কাকন রেজা

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২০, ০৬:৪৭ পিএম

‘মেডিকেল ইমার্জেন্সি’ আর ‘জরুরি অবস্থা’ এক নয়

সিলেটে এক নারী মারা গিয়েছেন হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে। তিনি জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। তারপর ছিলেন যুক্তরাজ্য ফেরত। সুতরাং তিনি যে কোভিড নাইনটিনে (করোনাভাইরাসে) আক্রান্ত তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকার কথা নয়। অথচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না, তিনি কোভিডে আক্রান্ত ছিলেন কিনা। 

কারণ মৃত্যুর আগে তার পরীক্ষা হয়নি। প্রশ্নটা এখানেই। আমাদের এত বাগাড়ম্বরের আসল রহস্যটা ফাঁস করে দিয়েছে এই মৃত্যুই।  

ঢাকার মিরপুরে যে রোগীটি মারা গেলেন একটি বেসরকারি হাসপাতালে, তার টেস্ট করেনি আইইডিসিআর। কারণ বিদেশ ফেরতদের সঙ্গে সেই রোগীর সংস্পর্শের কোনো ইতিহাস আইইডিসিআরের জানা ছিল না। যার ফলে একটি বেসরকারি হাসপাতালে অন্য সবাইকে আক্রান্ত করার আশংকার মধ্যে রেখেই তাকে বিদায় হতে হয়েছে। 

এখন প্রশ্ন হলো, যে হাসপাতালে তার চিকিৎসা হয়েছে সম্পূর্ণ অরক্ষিতভাবে, সেখানে কতজন ডাক্তার, নার্স, রোগী, দর্শনার্থী ছিলেন এটা কি খোঁজ করা সম্ভব হয়েছে? হওয়ার কথা না। কারণ আমাদের প্রযুক্তি এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। সুতরাং এখন যদি এদের মধ্যে কেউ আক্রান্ত হয় তবে তো বিদেশ ফেরতদের সংস্পর্শ না থাকার অজুহাতে আইইডিসিআর পরীক্ষা করবে না। 

চোখ বন্ধ করে এখন ভাবুন তো, সারা দেশে প্রবাসীরা ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের চিহ্নিত করা সর্বক্ষেত্রে সম্ভব হয়নি। যাদের চিহ্নিত করার পর জোর করে ঘরে ঢোকানো হয়েছে, তারাও এর আগে ঘুরে বেড়িয়েছেন, বাজার-হাট করেছেন। তাদের সংস্পর্শে যারা এসেছেন তাদের কেউ কেউ হয়তো জানেনই না তিনি বিদেশ ফেরত। 

সুতরাং এমন কেউ আক্রান্ত হলেও তো আইইডিসিআর তাদের বিদেশ ফেরত সংস্পর্শের কথা জানতে পারবে না এবং তাদের পরীক্ষাও হবে না। খুব বেশি হলে মরার পর হয়তো হবে। কী ভয়াবহ অবস্থা চিন্তা করে দেখুন।
 
একটি হাসপাতালে নোটিশ দিয়ে জানানো হলো সম্পদের স্বল্পতায় মাস্ক দেয়া সম্ভব নয়। সরকারি হাসপাতালের এই একটি নোটিশই কি ‘আমরা প্রস্তুত’ এমন কথাকে এক তুড়িতে উড়িয়ে দেয় না? বেসরকারি একটি গার্মেন্টস ব্র্যান্ড জীবাণু থেকে রক্ষাকারী পোশাক পিপিই বানাচ্ছে দেশের চিকিৎসকদের জন্য। 

‘আমরা প্রস্তুত’ কথাটি প্রশ্নের মুখে পড়ে এমন একটি উদ্যোগেই। অর্থাৎ আমাদের চিকিৎসকদের রক্ষায় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি অসম্পূর্ণ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই প্রস্তুতি অপ্রতুল, অসম্পূর্ণ। চিকিৎসার আগে রোগীকে ভর্তি করাতে হবে। কিন্তু একজন শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশির রোগী ভর্তি করছে না কোনো হাসপাতাল। 

বলা হচ্ছে, বিশেষ কয়েকটি হাসপাতালে নিয়ে যেতে। হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরতেই রোগীর জীবন শেষ। মিরপুরে মৃত মানুষটি বিত্তবান ও প্রভাবশালী হওয়া স্বত্বেও তাকেও অবহেলার শিকার হতে হয়েছে। তারও জীবদ্দশায় পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি তিনি কোভিড নাইনটিনে আক্রান্ত কিনা। বিপরীতে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হতে পারে আরেকবার ভেবে দেখুনতো। 

ব্যর্থতার কথা স্বীকার করতে দোষ নেই। আমাদের মতন বৃহৎ জনগোষ্ঠীর একটি দেশে সমস্যা থাকবেই। থাকবে প্রস্তুতির স্বল্পতা। কিন্তু সেটা ঢেকে রেখে বড়লোকি দেখানো কেন! জানিয়ে দিলেই তো হয় আমাদের স্বল্পতা রয়েছে তবু আমরা চেষ্টা করছি।

আপনারাও আমাদের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিন। এমন আহ্বান সরকারের তরফ থেকে এলে সেই বেসরকারি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের মত অনেক প্রতিষ্ঠান হাত বাড়িয়ে দিতো। তা না করে আমাদের চলছে বাগাড়ম্বর। যে বাগাড়ম্বর পুরোটাই প্রায় সার্কাজমের পর্যায়ে পৌঁছেছে। আমরা ভুলতে বসেছি আমাদের কি বলা উচিত আর কতটুকু করা উচিত।
 
দেখুন, ঢাকা-১০ আসনে উপনির্বাচন হয়ে গেল। সরকারি ভাষ্যেই ভোট পড়েছে শতকরা পাঁচ ভাগ। একজন প্রার্থীর জামানত রক্ষা করতে যে পরিমাণ ভোটের প্রয়োজন সে পরিমাণ ভোটও পড়েনি। গণমাধ্যমের বিশিষ্টজনরাও এমন পরিস্থিতিতে এ ধরণের নির্বাচনকে তামাশা বলে আখ্যা দিয়েছেন। 

এর মধ্যে যদি ‘একটা ভোট পড়লেও নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়েছে’ এমন বক্তব্য আসে তবে মহামারী কবলিত ভয়ার্ত জাতির সঙ্গে এরচেয়ে বড় তামাশা আর কী হতে পারে! তামাশার তো শেষ থাকে কিন্তু এনাদের তামাশার যেন শেষ নেই। ভিড় করে হাতধোয়া অনুষ্ঠানের উদ্বোধনসহ নানা ধরণের তামাশা এখনো এদের ঝুলিতে রয়ে গেছে।
 
একটা ‘তামাশা’ ফাঁস করে দিলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। জরুরি অবস্থা ঘোষণার কথা তারা বলেনি সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে সংস্থাটি। অথচ একজন মেয়র জরুরি অবস্থার কথা বলেছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে উদ্ধৃত করে। জরুরি অবস্থা জারি করার বিপক্ষে আমি বা আমাদের মত অনেকেই নন। সেই জরুরি অবস্থা হলো ‘মেডিকেল ইমার্জেন্সি’। 

‘মেডিকেল ইমার্জেন্সি’ আর সার্বিক জরুরি অবস্থার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে সেটা বোঝার ক্ষমতা অনেকেরই নেই। সম্প্রতি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের আইন প্রয়োগের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, এটা ‘মেডিকেল ইমার্জেন্সি’র একটা অংশ। এই আইন প্রয়োগ হবে রোগীদের চিকিৎসা ও রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে। 

বিপরীতে জরুরি অবস্থায় চিকিৎসার বাইরে সবক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের সুযোগ থাকে। অন্যান্য মৌলিক অধিকারও খর্ব হয়ে যায়। সুতরাং জরুরি অবস্থা আর ‘মেডিকেল ইমার্জেন্সি’র মধ্যে ফারাক অনেক।
 
সে যাইহোক, আমাদের এখন একমাত্র প্রায়োরিটি হলো প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা। প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বিশেষ করে প্রবাসীদের কোয়ারেন্টিনে রাখা। এছাড়াও আক্রান্ত এলাকা শাটডাউনে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া। আর চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথম হলো দ্রুত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা, যাতে আক্রান্তদের চিহ্নিত করে আলাদা করা যায়। 

এখন আলাদা করার চেয়ে ভালো ব্যবস্থা আর কিছু নেই। মহামারী ঠেকাতে হলে ‘সোশ্যাল ডিসটেইন্স’ রাখার কোনো বিকল্প নেই। চীন থেকে দক্ষিণ কোরিয়া, যারা সবচেয়ে ভালো ম্যানেজ করেছে বিষয়টি তারাই মোটামুটি রক্ষা পাওয়ার পথে। 

ইতালি থেকে স্পেন যারা ‘সোশ্যাল ডিসটেইন্স’ এর বিষয়টি প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি, তারা এখন চরম অবস্থায়। আমাদের ঘনবসতির দেশটিতে এই সামাজিক দূরত্ব এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা করতে যে কোনো কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। প্রয়োজনে প্রতিটি এলাকা শাটডাউন করে দিতে হলেও। 

লেখক: কাকন রেজা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম