
ছবি: যুগান্তর গ্রাফিক্স টিম
ফিলিপাইন করোনার জেরে লকডাউন। এতেই ক্ষান্ত হয়নি তারা। জারি করেছে রাত্রিকালীন কারফিউ। অথচ ফিলিপাইনে এখনো ব্যাপকহারে কোভিড নাইনটিনে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়নি। এ লেখা যখন লিখছি তখন সরকারিভাবে সেখানে মাত্র আটানব্বই জন রোগীর কথা বলা হয়েছে।
তারপরেও তারা সব লকডাউন করেছে বাড়তি নিরাপত্তার জন্য। রাত্রিকালীন কারফিউ সেজন্যেই। তারা জানে, আক্রান্ত হলে তাদের ওখানে ম্যাসাকার হয়ে যাবে। আমরাও রয়েছি সে অবস্থায়। আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা হবে আরও ভয়াবহ।
সেই ভয়াবহতা মোকাবেলায় আমাদের দেশের প্রস্তুতি কী? এক কথায় কিছুই না। সারাদেশে কয়টা আইসিইউ রয়েছে? ভেন্টিলাইজেশনের ব্যবস্থা কী? কতজন রোগীকে একবারে ভেন্টিলাইজেশন দেয়া যাবে? দেশের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে ভেন্টিলাইজেশন ব্যবস্থা নেই।
এমনকি কোনটাতে জরুরি সময় অক্সিজেনও পাওয়া যায় না। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও রয়েছে অক্সিজেন সংকট। এমন অবস্থায় আমরা এখনো কী করছি? মূলত কিছুই করছি না, বাগাড়ম্বর ছাড়া। এখানে-ওখানে একটু-আধটু মাইকের প্রচারণা, তাও আমার তথ্য অধিদপ্তরের প্রচারক দিয়ে।
যারা একবার বলে একঘণ্টা জিরিয়ে নেয়। যতটুকু করেছে তার সবটা কৃতিত্বই গণমাধ্যমের। বেসরকারি টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টালগুলো যদি না থাকতো তবে সর্বনাশের বারোটা বাজতো। এসব মাধ্যমের কারণেই কিছুটা হলেও জনসচেতনতা তৈরি হয়েছে।
আমাদের উচিত ছিল আরও আগেই ফ্লাইটগুলো বন্ধ করে দেয়া। বাংলাদেশি যারা দেশে ফিরতে চান, তাদের বিমানবন্দর থেকেই কোয়ারান্টিনের ব্যবস্থা করা। তাদের জন্য সঠিক জায়গায় আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা। কিন্তু তা করা হয়নি। যখন করা হলো, ততক্ষণে কোভিড নাইনটিনে আক্রান্তরা দেশে ঢুকে গেছে।
যে কয়জনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে, তারা কাদের সঙ্গে মিশেছে তা সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করা হয়েছে কিনা তারও সম্পূর্ণ তথ্য আমাদের হাতে নেই। কেন নেই, সে প্রশ্ন করারও উপায় নেই। আমাদের প্রশ্ন করার ক্ষমতাকে অনেক আগেই কোয়ারান্টাইনে পাঠানো হয়েছে।
কেমন করে তা জানতে হলে কুড়িগ্রামের ডিসি সুলতানার মধ্যরাতে এক গণমাধ্যমকর্মীকে উঠিয়ে নেয়ার কাহিনী পড়ুন। ধরুন ঢাকা শহরে কোন একটা বস্তিতে একজন আক্রান্ত হয়েছে কোভিড নাইনটিনে। চিত্রটা একবার কল্পনা করুন তো। চেইনটা ধরার চেষ্টা করুন।
একজন আক্রান্ত মানে আপনি যে রিকশা, সিএনজিতে যাবেন সেই চালকও আক্রান্ত হতে পারেন। সংক্রমিত হতে পারেন আপনি। বাসার কাজের বুয়া আক্রান্ত হলে, গিন্নিও বাদ পড়বেন না। আর গিন্নি পড়লো তো পুরো পরিবার। সকালে পত্রিকাটা যে দিয়ে যাচ্ছে, তার হাত বেয়ে আপনার কাছে পৌঁছতে পারে কোভিড নাইনটিন।
এভাবে হাজার রকমভাবে বস্তি থেকে আপনার ফ্ল্যাটে নিশ্চিন্তে পৌঁছতে পারে এই ভাইরাস। এবার আপনার বোধে এসেছে কি যে বস্তির মানুষগুলোর থেকে আপনার দূরত্ব বেশি নয়। ওরা ভালো না থাকলে আপনারও ভালো থাকার উপায় নেই। বস্তির মানুষগুলো ছাড়া আপনার জীবনচক্র অসম্পূর্ণ। বেঁচে থাকাটাও।
এতদিন রাজনৈতিক এলিটরা ভাবতেন, অসুখ হলে তো সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক রয়েছেই। পেছনের সারির এলিটদের জন্য ইন্ডিয়া। এখন কোভিড যদি তাদের হিট করে তখন তারা কোথায় যাবেন? ইন্ডিয়াও তো তাদের নেবে না। এতদিন যাদের বলেছেন, ‘মেরেছো কলসির কানা, তাই বলে কী প্রেম দেবো না’, এমন কথা, সেই প্রেমিকরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
আমাদের বড়মাপের রাজনৈতিক এলিটরা বেশিরভাগই সিনিয়র সিটিজেন। আর করোনার করুণা তাদের উপরই বেশি। তাদেরকেই কোভিড নাইনটিন বেশি প্রচণ্ড করে। সুতরাং এবার অন্তত বোধোদয় ঘটুক তাদের। তারা বুঝুক, নিজের দেশের হাসপাতালটাও উন্নত করা উচিত।
বালিশ, পর্দা, থার্মোমিটারকান্ড না ঘটিয়ে সত্যিকার অর্থেই উন্নয়ন কাণ্ড ঘটানো উচিত। না হলে, শেষ পর্যন্ত ইন্ডিয়ার গণ্ডুদের অনুকরণে গোমূত্র পানের উৎসব করতে হবে। আমাদের দেশে যদি কোভিড ব্রেকআউট হয়, তাহলে কী হবে? ভয়াবহ অবস্থা হবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
হয়তো তা আমাদের চিন্তাতেও নেই। নিউইয়র্ক থেকে একজন সাংবাদিক লাইভে বলছিলেন সামাজিকমাধ্যমে। তিনি জানালেন, পনেরো দিন আগেও তিনি লাইভ করেছিলেন। তখন তিনি দেখেছিলেন মানুষজনের চলাচলে তেমন অস্বাভাবিকতা নেই। সবাই অনেকটা ড্যামকেয়ার। কিন্তু পনেরো দিনের ব্যবধানে চিত্র পুরো উল্টো।
মানুষজন প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছেন না। টাইম স্কয়ারে যেখানে পায়ে পা বাধিয়ে হাঁটতে হয়, সে জায়গা ফাঁকা। প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। অ্যামেরিকার মতন একটি দেশে যদি অবস্থা এমন দাঁড়ায় তবে, আমাদের অবস্থা কি হতে পারে!
অথচ আমেরিকার তুলনায় প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থার অসম্ভব রকম অপ্রতুলতা নিয়ে আমরা ড্যামকেয়ার। রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ রীতিমত ভাঁড়ের মতন বক্তব্য দিচ্ছেন এমন অবস্থাতেও। বলিহারি এসব নেতাদের। আমরা এতদিনে সায়েন্স ফিকশন পড়ে এমন পরিস্থিতির কথা জেনেছি।
কিন্তু সেই ফিকশন এখন আমাদের সমুখে মূর্তিমান। দেখুন আক্রান্ত দেশগুলোর দিকে। বিশেষ পোশাকে সারা শরীর ঢাকা। নিদেনপক্ষে হাতে গ্লাভস, মুখে মাস্ক। রাস্তায় মানুষজন নেই, সুনসান। মাঝে-মধ্যে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। ঘরের ভেতর থেকে মানুষ ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের সাহায্যে জানাচ্ছে তাদের অবস্থা।
তাদের প্রাণ বাঁচানোর আকুলতা শুনেও কারো কিছু করার নেই। ইতালিতে বলা হচ্ছে বেছে বেছে চিকিৎসা দিতে। যাদের দিয়ে লাভ নেই, তাদের বাদ দিয়ে অন্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করতে। ইতালির মতন একটা দেশ এমন অবস্থায়। সায়েন্স ফিকশনের সিনেপ্লেক্সে দেখা চিত্র নয়, বাস্তব দৃশ্যচিত্র।
এতসবের পরেও আমাদের দেশের প্রস্তুতি এবং নড়াচাড়া বিস্ময়ের উদ্বেগ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৫ মার্চ পর্যন্তও বন্ধ করা হয়নি। অথচ পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে আরও আগেই। আর আমাদের দেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর ব্যানার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার দাবী জানাতে হয়।
সরকারি পর্যায়ে চলছে এ নিয়ে দড়ি টানাটানি। এক মন্ত্রণালয় বলছে এতো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। আরে জরুরি সময়ে শুধু বন্ধ করার নির্দেশ লাগে মন্ত্রণালয় লাগে না, এটা কে বোঝাবে আমাদের কথিত বুদ্ধিমানদের?
জানি না, শেষ পর্যন্ত আমরা কোন অবস্থায় পড়তে যাচ্ছি। হঠাৎ করে যদি সব লকডাউন করতে হয়, তাহলে তো আমাদের পূর্ব প্রস্তুতিও নেই। অন্তত পনেরো দিনের খাবারের জোগাড়ও আমরা করিনি। আমাদের জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশটিই দরিদ্র। তাদের পনেরো দিন তো দূরের কথা, দুদিনের খাবার জোগাড় করাও কঠিন।
এমন অবস্থায় হঠাৎ সব লকডাউন হলে পরিস্থিতি অসুস্থতার চেয়ে মানবিক বিপর্যয়ের দিকে বেশি গড়াবে। চিকিৎসার সঙ্গে সরকারের সেদিকেও দৃষ্টি রয়েছে তো? মানুষের খাবার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্বগুলো অন্যতম। অবস্থা যেন এমন না দাঁড়ায়, শেষ পর্যন্ত মানুষ বলতে বাধ্য হয়, ‘ভাত দেবার মুরোদ নেই কিল মারার গোসাই’।
লেখক: কাকন রেজা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট