
২২ অক্টোবর ২০১৯ নারুহিতো ক্রিসেনথেমাম চন্দ্রমল্লিকা (বামে) জাপানের ১২৬তম সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। ছবি সংগৃহীত
গত ২২ অক্টোবর ২০১৯ তারিখে জাপানী রাজপ্রাসাদে ১৭৪ দেশ ও অঞ্চলের প্রায় দুই হাজার নেতা এবং প্রতিনিধির সামনে নারুহিতো ক্রিসেনথেমাম (চন্দ্রমল্লিকা) দেশটির ১২৬তম সম্রাট হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
সম্রাটের অভিষেকে বিদেশি অতিথি হিসেবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছাড়াও ছিলেন নেদারল্যান্ডের রাজা উইলিয়াম অ্যালেক্সান্ডার, স্পেনের রাজা ৬ষ্ঠ ফিলিপ, বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ, ভুটানের রাজা জিগমে খেসার নামগেয়েল ওয়াংচুক, ব্রিটিশ যুবরাজ প্রিন্স চার্লস, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের নেতা ও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
অভিষেক অনুষ্ঠানটি সারা বিশ্বের প্রিন্ট, ইলেক্ট্রনিক, অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়ায় গুরুত্বের সাথে প্রচারিত হয়েছিল।
খবরে প্রকাশ জাপান সম্রাটের প্রাসাদ ইমপেরিয়াল প্যালেসের মূল অনুষ্ঠান কক্ষ সেদিন মাৎসু-নো-মা’র সামনের দিকের উঁচু অংশে নীল রঙের পর্দায় ঢেকে ষড়ভুজ আকারের দুটি মঞ্চে অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পাদিত হয়। একটু উঁচু মঞ্চের বেদির উপর ছিল সম্রাটের সিংহাসন। পাশেই কিছুটা নিচু ও ছোট সিংহাসনটি ছিল সম্রাজ্ঞীর।
সম্রাটের সিংহাসনের মত সম্রাজ্ঞীর সিংহাসনও যদি সমান হত এবং একই রকম উঁচু বেদিতে অধিষ্ঠিত হত তাহলে বিশ্বজুড়ে লিঙ্গ সমতার বিষয়ে একটি শক্তিশালী বার্তা যেত বলে মনে করি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নারুহিতো হলেন জাপানের রাজকীয় পরিবারের নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব।
তিনি যদি হাজার বছর ধরে চলে আসা জাপানী সম্রাটদের এই অভিষেক অনুষ্ঠানে সম্রাজ্ঞী মাসাকোকে তার পাশে একই বেদিতে একই রকম উঁচু সিংহাসনে বসাতেন তাহলে মানুষের মনের মধ্যে নারীদের নিচু করে দেখার মনোভাবের বিরুদ্ধে একটি কড়া বার্তা যেত।
কারণ জাপানের সম্রাটের পদ আলংকারিক হলেও জাপানী সংস্কৃতিতে তাদের ব্যাপক প্রভাব আছে। জাপানের যুদ্ধ পরবর্তী সংবিধানে দেশ ও জনগণের ঐক্যের প্রতীক হচ্ছেন সম্রাট। সম্রাটের এই অভিষেক অনুষ্ঠান জাপানের এক হাজার বছরের ঐতিহ্যের অংশ।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্নভাবে নারীদের হেয় করছি। নারীরা দুর্বল ও তাদের উপর ভরসা রাখা যায়না এই ভাব সমাজে এখনও প্রবল। প্রথম যখন নারীরা কমার্শিয়াল প্লাইটের পাইলট হলেন তখন অনেক যাত্রী ভয়ে বিমান থেকে নেমে যেত।
নারীরা সেনাবাহিনীতে যোগ দিবে, রাষ্ট্র প্রধান হবে এই রকম আরও বহুকিছু এক সময় কল্পনাও করা যেত না। বর্তমানে শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান, ব্যবসা, প্রশাসন, রাষ্ট্র পরিচালনাসহ সর্বক্ষেত্রে তারা তাদের দক্ষতার চাপ রেখে চলেছে।
এক সময় বলা হত “Men are bread earners, women are care givers”। বর্তমানে এই কথাটা মোটেও সত্য নয়। নারীরাও পরিবারের উপার্জনে অবদান রাখছে। কিন্তু এখনও আমরা আমাদের গল্প, সাহিত্য, কৌতুক, সিনেমা, সামাজিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত আচরণে নারীদের হেয় করে উপস্থাপন করি।
এখনও আমরা সিনেমায় দেখাই বন্দী নায়িকাকে নায়ক এসে উদ্ধার করে। কেউ উল্টা পাল্টা আচরণ করলে বলি মহিলাদের মত আচরণ কর কেন। ভিতুদেরকে বলি কাপুরুষ।
মেন’স ওয়ার্ক, মাস্টার্স ডিগ্রী, চেয়ারম্যান, নগরপিতা (মেয়র), রাষ্ট্রনায়ক, ওয়াচম্যান, আঙ্কেল স্যাম (ইউএস), ন-মেন’স- ল্যান্ড, মিডশিপম্যান, মিডলম্যান, মাস্টারপিস, হাউস ওয়াইফ, হেডমাস্টার, লেম্যান, জ্যাক-অব-অল-ট্রেডস, কান্ট্রিম্যান, কাউবয়, কমনম্যান, ক্যামেরাম্যান, ম্যান অব দা ম্যাচ, ম্যানমেড, ম্যানহোল ইত্যাদি লিঙ্গ বৈষম্যমুলুক শব্দ আমরা প্রতিনিয়ত জেনে না জেনে ব্যবহার করি।
এই সব বৈষম্যমুলুক শব্দ দ্বারা আমরা বুঝাতে চাই যে- কিছু কাজ শুধু পুরুষরাই করবে, কিছু কাজ শুধু নারীরাই করবে, কিছু পদে শুধু পরুষরাই বসতে পারবে, দক্ষতার সঙ্গে শুধু পুরুষরাই কাজ করতে পারে ইত্যাদি।
সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের (ইউডিএইচআর) প্রথম অনুচ্ছেদেই বলা হয়েছে সমস্ত মানুষ স্বাধীন হিসেবে জন্ম গ্রহণ করে এবং মর্যাদা ও অধিকারে সমান। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের দেশীয় আইনে নারীদের সম অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি দিয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে নারী-পুরুষভেদের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না। রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন। নারীদের অগ্রগতির জন্য রাষ্ট্র বিশেষ বিধান প্রণয়ন করিতে পারিবে।
তবে শুধুমাত্র আইন করে নারীদের প্রতি অবজ্ঞামুলুক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা বা তাদের ক্ষমতায়ন করা সম্ভব নয়। সমাজে, ঐতিহ্যে, আচরণে বিদ্যমান নারীর প্রতি অবজ্ঞাসূচক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে পরিপূর্ণভাবে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে না।
লেখক: শাহনেওয়াজ, আইনজীবী ও অধিকারকর্মী, newazuaplaw@gmail.com