স্মৃতিতে আল মাহমুদ । ছবি সংগৃহীত
কবি আল মাহমুদের সঙ্গে আমি সরাসরি কথা বলেছি। আমি তখন ঢাকা মেডিকেলের প্রথম বর্ষের ছাত্র। হঠাৎ মাথায় খেয়াল চাপলো, প্রিয় কবির সঙ্গে দেখা করব। খবর নিলাম কবিকে কোথায় পাওয়া যাবে। সরাসরি চলে গেলাম তার অফিসে।
তার ডেস্কের সামনে দাঁড়ালাম। সালাম দিলাম, বললাম ‘আমি আপনার কবিতার ভক্ত, দেখা করতে এসেছি’। তিনি হেসে দিয়ে বললেন, ‘বস’।
কোন ডায়েরি ছিল না সঙ্গে। আমি আমার একটা ফটো বের করে বললাম, ‘স্যার, একটা অটোগ্রাফ দেন’। তিনি আবারও স্মিত হেসে বললেন, ‘ফটোতে অটোগ্রাফ দিব....'?। আমি বললাম, ‘জ্বী’। (প্রায় ২১ বছর আগের ঘটনা)
ছাত্র রাজনীতির খুনসুঁটিতে পড়ে একবার আমার রুম জ্বালিয়ে তছনছ করে দেয় আমার বিপরীত আদর্শের বন্ধুরা। অবশ্য তার আগে বন্ধুরা আমাকে ‘পলায়নের’ পরামর্শ দিয়ে দেয়।
তখন আল মাহমুদের অটোগ্রাফ সম্বলিত সেই ছবিটি পুড়ে যায়। তার জন্য অবশ্য পরে চরম দুঃখ প্রকাশ করে আমার বন্ধুরা।
কবির কিছু বই আমি আফরাজ ভাই এর কাছ থেকে নিয়েছিলাম। আফরাজ ভাই ছিলেন কলেজের অনার্সের ছাত্র । অল থ্রু ফার্সক্লাস ফার্স্ট। আর আমি ছিলাম ইন্টার মেডিয়েটের প্রথম বর্ষের ছাত্র।
তিনি আমার পাশের রুমেই থাকতেন। সব সময় তার পিছনে ঘুর ঘুর করতাম আর গল্প কবিতা নিয়ে গালগল্পে মেতে রইতাম।
আমার জন্যে আফরাজ ভাই তার ক্লাসমেটদের কাছে কথা শুনতেন, ‘পুঁচকে ছেলেটাকে বেশি লাই দাও'। তারপর ও আমাদের গল্প কবিতার আড্ডা চলতো নিয়মিত।
আফরাজ ভাই তার বিসিএস পরীক্ষার ভাইভার আগের দিন হঠাৎ ঢাকা মেডিকেলে আমার রুমে এসে উপস্থিত।
বললেন, ‘কাল ভাইভা, আমাকে ভোরে জাগিয়ে দিও। পারবেতো? টেনশন হচ্ছে..’!
আমি বললাম ‘রাতে পড়তে পড়তে আমার ভোর হয়ে যায়, শোবার আগেই আপনাকে জাগাবোনে। সমস্যা নেই ঘুমান। আর টেনশন কেনো ভাই, আপনিতো অলথ্রু ফার্সক্লাস্ট ফার্স্ট... ’। আফরাজ ভাই এখন ডেপুটি সেক্রেটারি।
আল মাহমুদের কবিতার বই ছাড়াও ইংলিশ অনার্স পড়ুয়া খয়ের ভাইয়ের কাছ থেকে শেক্সপিয়ার, মিলটনের রচনাগুলো মাঝেমধ্যে এনে পড়তাম। খয়ের ভাই সারমর্ম বুঝিয়ে দিতেন।
তিনি এখন কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। আমার রুমমেট ছিলেন বশির ভাই। ইকোনোমিক্স এর ছাত্র। এরকম মেধাবী ছাত্র দেখিনি।
একবার পড়লেই হু হু মুখস্থ বলে দিতেন সব। তার কাছ থেকে জেনেছিলাম ম্যালথাসের সুত্র, ‘খাদ্যশষ্যের উৎপাদন গাণিতিকহারে বৃদ্ধি পেলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে’। বশির ভাই এখন ভাইস প্রিন্সিপাল ও বিভাগীয় প্রধান। বশির ভাইয়ের টেবিল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে সাপ্তাহিক ‘যায় যায় দিন’ পড়ার তীব্র নেশা এখনো মনে আছে।
সাবজেক্ট, আফরাজ ভাইয়ের বোটানি, খয়ের ভাইয়ের ইংরেজি, বশির ভাইয়ের ইকোনমিক্স, আর আমার পাঁচমিশালী হলেও আমাদের সাহিত্যের আড্ডার প্রথম বিষয় ছিলো, ‘আল মাহমুদ’।
আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে, হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে। নদীর কাছে গিয়েছিলাম, আছে তোমার কাছে? হাত দিওনা আমার শরীর ভরা বোয়াল মাছে।
কিংবা, এপার ওপার দুই পারের কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিকদের কাছে চির নমস্য এ মহান লোকটির সঙ্গে দেখা করতে, কবি জয় গোস্বামী ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর এক সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন।
এই সময়ে কবি আল মাহমুদের সঙ্গে তিনি দেখা করেন। কবি আল মাহমুদের সঙ্গে তার সে সাক্ষাতকে জয় গোস্বামী ‘তীর্থ দর্শন’ বলে অভিহিত করেছিলেন।
‘কোন এক ভোর বেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালো মন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ"
কি ভবিষ্যৎ বাণী-ঠিক শুক্রবারেই মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে হাজির। কবি বলে দাও, তোমার তিরোধানকে কীভাবে নেব ঈদ হিসেবে। কবির আত্মাকে আল্লাহ জান্নাত নসিব করুন।
সাইকিয়াট্রিস্ট, মেম্বার, আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন