
মো. হাবিবুল আলম
গত এক দশকে দেশের উন্নয়নের একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র ছিল ‘গণমাধ্যম’। সরকারের উদার নীতির ফলে দেশে গণমাধ্যমের ব্যাপক প্রসার হয় যার প্রভাবে সৃষ্টি হয় কর্মসংস্থান অন্যদিকে বিনোদন কিংবা খবরের জন্য তৈরি হয় বিকল্প গণমাধ্যম।
প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার পাশাপাশি গত দশকে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় ছিল অনলাইন মিডিয়ার বিকাশ, যার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে ‘ইন্টারনেট’। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে দেশেও ইন্টারনেট বিকশিত হতে শুরু করে। এই প্রবণতাকে পুঁজি করেই শুরু হয়েছিল দেশে শুরু করেছিল বিডিনিউজ ও বাংলানিউজ। পরবর্তীতে একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে হাজারও অনলাইন নিউজ পোর্টাল।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ২ হাজারের বেশি অনলাইন নিবন্ধনের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। আশা করা হচ্ছে ৪জি প্রযুক্তির পর ৫জি চালু হলে দেশে ইন্টারনেট গ্রাহক আরও বাড়বে। ফলে অদূর ভবিষৎতে দেশে অনলাইন সাংবাদিকতার আরও বিকাশ হবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নতুন কর্মসংস্থান, পাঠকের কাছে দ্রুত সংবাদ পৌছে দেয়া ইত্যাদি ইতিবাচক হলেও উল্টো চিত্রও আছে। ভুল সংবাদ, পুরাতন সংবাদ, অসংলগ্ন ছবি, ভাষাগত ও তথ্যগত বিভ্রাটের কারণে সমালোচিত হচ্ছে অনলাইন সাংবাদিকতা।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব অপেশাদার ভুলগুলো করছে শীর্ষ অনলাইনগুলো। অনলাইনের উল্লেখযোগ্য একটি বৈশিষ্ট্য হল পেশাদারিত্ব বজায় রেখে দ্রুত সংবাদ পাঠকদের কাছে পৌছে দেয়া। তবে দ্রুত সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়েই যেন পেশাদারিত্ব হারাচ্ছে আমাদের অনলাইন মিডিয়া। যেমন ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় শীর্ষ একটি অনলাইনে, জেএসসি পরীক্ষায় সংবাদে পাশের হার বাড়লেও কমেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ-৫ এর সংখ্যার পরিবর্তে লেখা হয়, পরীক্ষায় পাশের হার, কমেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে জিপিএ-৫ এর সংখ্যা। দ্রুত লিখতে গিয়ে ‘ বাড়লেও’ শব্দটি যুক্ত করতে ভুলে যায় অনলাইনটি।
এর আগেও খেলা বিষয়ক একটি সংবাদে ভুল ক্যাপশন প্রকাশ করে একই অনলাইন। চলতি বছরের আগস্টে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা রোমা ও বার্সেলোনার একটি ম্যাচের ফলাফল নিয়ে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, ম্যাচে রোমা জয়ী হলেও ক্যাপশনে লেখা হয়েছে জয়ী বার্সেলোনা।
একইভাবে অন্য একটি শীর্ষ ইংরেজি দৈনিকে একটি সংবাদ ইভিএম নিয়ে হলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা সংবাদের ক্যাপশনে লিখা হয়েছে ৩০ জেলা থেকে ৯০ জন অলিম্পিয়াডে জন্য নির্বাচিত হয়েছেন, যা মূল প্রতিবেদনের সাথে পুরোটাই অসঙ্গতিপূর্ণ। এসব ভুলের পাশাপাশি ভুল তথ্যের ভিত্তিতেও সংবাদ পরিবেশন করেছে আমাদের গণমাধ্যম। যেমন গত বছর ফুটবল বিশ্বকাপে মরক্কো ও স্পেন এর মধ্যকার ম্যাচের ফলাফল ড্র হলেও একটি সংবাদপত্রে শিরোনামে বলা হয় মরক্কোর কাছে হেরেও শেষ ১৬ তে পৌঁছাল স্পেন। এসব হাস্যকর ভুল প্রমাণ করে আমাদের মিডিয়া পেশাদার নয় এমনকি পাঠকের প্রতি দায়িত্বশীলও নয়।
সংবাদের অন্যতম একটি অনুসঙ্গ হচ্ছে ছবি। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে দ্রুত সংবাদ প্রকাশ করতে গিয়ে আজকাল অসংলগ্ন ছবি জুড়ে দিচ্ছেন সাংবাদিকরা। যেমন মণিকর্নিকার ট্রেলার প্রকাশ, মুগ্ধতা ছড়ালেন কঙ্গনা শীর্ষক সংবাদে সিইসির ছবি আপলোড করা হয়।
এমনকি আলিয়াভাটের সংবাদে সালমান মুক্তাদির কিংবা জাফর হত্যা চেষ্টায় আটকের সংবাদে ক্রিকেটার-আম্পায়ারের ছবি আপলোড করার মত ঘটনাও ঘটছে। জাতীয় নির্বাচন সংক্রান্ত একটি সংবাদে ভারতীয় সাবেক ক্রিকেটারদের ছবি ; ১ হাজার এফপিএস ক্যামেরা আনছে স্যামস্যাং সংবাদে বাংলাদেশ দলের উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহিমের ছবি; একইভাবে রাজনীতিক দলের কোন্দল নিয়ে সংবাদ হলেও সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা ক্যাপশনে লেখা হয়েছে ডায়বেটিক সংক্রান্ত তথ্য, যা কেবল অপ্রাসঙ্গিকই নয় হাস্যকরও বটে। ।
অবস্থাদৃষ্টে এখন মনে হচ্ছে তাজা খবরের পরিবর্তে পাঠকদের যেন বাসি সংবাদই বেশি খাওয়াচ্ছে অনলাইনগুলো। ঢাকায় রিকশাওয়ালাকে নারীর পেটানো; ঢাকার আকাশে হঠাৎ মুখোমুখি দুই বিমান; বিমানবালা মাসুমার অন্ধকার জগতের খুঁজে গোয়েন্দারা; স্টিম বান গার্ল বিকামস ইন্টারনেট সেনসেশন শীর্ষক সংবাদগুলোও একাধিকবার প্রকাশ করেছে শীর্ষ অনলাইনগুলো।
অন্য পোর্টালের সংবাদ চালিয়ে দেয়া অনৈতিক হলেও ‘ পাচার হওয়া নারী নিজেই যেভাবে হয়ে গেলেন পাচারকারী, ৫০০ কিলো জুড়ে থাকা গাছ থেকে ১২৭ কেজি পেরেক তুললেন যশোরের রাজমিস্ত্রি, বাংলাদেশে কেন অনেক মানুষের জন্ম পহেলা জানুয়ারি, এবার আ’লীগ কি তরুণদের ভোট পাবে ; যে কারণে মেয়েদের কাছে গোপনাঙ্গের ছবি পাঠায় পুরুষ শীর্ষক সংবাদও প্রায় অবিকলভাবে প্রকাশের ঘটনা ঘটেছে, যা মূলত ছিল বিবিসি বাংলার সংবাদ।
শীর্ষ অনলাইনের কাছে পাঠকের প্রত্যাশা নিত্যনতুন খবর কিংবা বিশ্লেষণ হলেও মনে হচ্ছে পাঠকরা ভুল শিরোণাম ও ক্যাপশন, বাসি সংবাদ, অসংলগ্ন ছবি, ভাষাগত ও তথ্যগত বিভ্রাটাই মনে হয় বেশি পাচ্ছেন। বলতে দ্বিধা নেই সবার আগে সংবাদ পৌছে দেয়ার নামে শীর্ষ অনলাইনগুলো এসব ভুল করছে, যা পাঠকের সাথে প্রতারণা শামিল। অপেশাদার এসব ভুল নিঃসন্দেহে পাঠকের জন্য ইতিবাচক নয় বরং এখন তারা প্রশ্ন তুলছেন শীর্ষ অনলাইনগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে।
আশার কথা এসব অপেশাদার ভুলগুলো সংবাদমাধ্যমের চোখ এড়িয়ে গেলেও পাঠকরা কিন্তু ঠিকই এসব অসংলগ্ন বিষয়গুলো চিহিৃত করেছেন এবং সংবাদের মন্তব্য অংশে অনলাইন পোর্টালগুলোর বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
পুরাতন সংবাদ, ভাষাগত সমস্যা ও তথ্যগত বিভ্রাটের মত কিছু ভুল এড়াতে পাঠকের সহায়তাও নিতে পারেন সংবাদ মাধ্যম। পুরাতন সংবাদ ও তথ্যগত বিভ্রাট সাংবাদিকদের চোখ এড়িয়ে গেলেও পাঠকের চোখ এড়ায় না।
মন্তব্য অংশে গিয়ে পাঠকরা গণমাধ্যমের ভুলগুলো ধরিয়ে দিচ্ছেন। এজন্য নিজেদের ফেসবুক পেইজ ও নিজস্ব পোর্টাল নিয়মিত পর্যালোচনা করলে ভুলগুলো দ্রুত সংশোধন করা যাবে। পাশাপাশি সংবাদ আপলোড হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ ভালভাবে সংবাদটি পর্যালোচনা করলেও ভুলগুলো দ্রুত শুধরে নেয়ার সুযোগ থাকে। সর্বোপরি, সম্পাদকীয় নীতিমালাসহ অন্যান্য গাইডলাইনগুলো শক্তিশালী ও বাস্তবমূখী হলে এসব অপ্রত্যাশিত ও অপেশাদার ভুলগুলোর সমাধান হবে, ফিরবে পাঠকের আস্থা।
লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাবি

