
প্রিন্ট: ২২ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৮ এএম
১২ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত ‘ডায়ার নেকড়ে’ কীভাবে ফিরে এলো?
প্রকাশ: ১০ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৬ পিএম

আরও পড়ুন
বিখ্যাত টিভি সিরিজ ‘গেইম অব থ্রোনস’-এ একটি সাদা নেকেড়ে সবার নজর কাড়ে। স্টার্ক ফ্যামিলির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে দেখা যায় ‘ডায়ার ওলফ’ নামে সেই নেকড়েদের। স্টার্ক সন্তানদের রক্ষা থেকে শুরু করে তাদের নিষ্ঠা, শক্তি, স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে দেখা হয় এই ডায়ার নেকড়েদের।
সিনেমার পর্দায় টিকে থাকলেও বাস্তবের জগতে প্রায় ১২ হাজার ৫০০ বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে যায় প্রাণীটি। তবে সেই প্রাণীকেই এবার জীবিত করে তোলার দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের বায়োটেক প্রতিষ্ঠান কলোসাল বায়োসায়েন্স।
প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, এটি বিশ্বের প্রথম সফলভাবে ‘ডি-এক্সটিঙ্ক্ট’ বা পুনরুজ্জীবিত প্রাণী।
সোমবার প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণা দেয়, তাদের গবেষণার মাধ্যমে তিনটি ডায়ার নেকড়ে ছানা জন্ম নিয়েছে। এগুলোর নাম রাখা হয়েছে— রোমুলাস, রেমাস ও খালিসি।
তবে সমালোচকরা বলছেন, এই নবজাতক ছানাগুলোর ডিএনএ প্রকৃতপক্ষে ‘সাদা নেকড়ে’র সঙ্গে অনেক বেশি মিলে; ফলে এগুলোকে সত্যিকারের ডায়ার নেকড়ে বলা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ডায়ার নেকড়ে কী?
ডায়ার নেকড়ের বৈজ্ঞানিক নাম অ্যানোসায়ন ডায়রাস। এরা একটা সময় উত্তর আমেরিকার শীর্ষ শিকারী প্রাণী ছিল। এদের দেহ ছিল অন্যান্য নেকড়ের চেয়ে অনেক বেশি মজবুত ও পেশিবহুল। প্রাণীটির উদ্ধারকৃত জীবাশ্ম বিশ্লেষণে জানা গেছে, তারা আকারে বড় হলেও বিভিন্ন পরিবেশে চলাচল ও শিকার করতে পারত সহজেই। বরফ যুগের বাইসন, ঘোড়া, এমনকি ম্যামথের মতো বিশালাকৃতির প্রাণীও শিকার করত তারা।
এ বিষয়ে গেইম অব থ্রোনস-এর লেখক ও কলোসালে বিনিয়োগকারী জর্জ আর আর মার্টিন বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন ডায়ার নেকড়ে শুধু কল্পকাহিনির প্রাণী। কিন্তু বাস্তবে এদের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে।’
ধূসর নেকড়ে এবং ডায়ার নেকড়ের মধ্যে পার্থক্য কী?
চেহারায় কিছুটা মিল থাকলেও ডায়ার নেকড়ে ও ধূসর নেকড়ের মধ্যে তেমন একটা মিল নেই। জেনেটিক গবেষণা বলছে, দুই প্রজাতির বিচ্ছেদ ঘটেছিল কয়েক মিলিয়ন বছর আগে। ডায়ার নেকড়ের পা, মাথা, ঘাড় ছিল মোটা ও বেশি মাংসল, গঠন ছিল ভারি ও শক্তিশালী।
ডায়ার নেকড়ে কীভাবে ফিরে এলো?
দু’টি প্রাচীন ডায়ার নেকড়ের জীবাশ্ম (১৩ হাজার বছরের পুরনো একটি দাঁত ও ৭২ হাজার বছরের পুরোনো কানের হাড়) থেকে বিজ্ঞানীরা ডিএনএ সংগ্রহ করেন। এতে ধূসর নেকড়ের সঙ্গে তুলনায় ২০টি গুরুত্বপূর্ণ জেনেটিক পার্থক্য চিহ্নিত করা হয়।
পরে জিন বিশ্লেষণ প্রযুক্তি (সিআরআইএসপিআর) ব্যবহার করে ধূসর নেকড়ের জেনোমে এই ২০টি পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে বৃহৎ দেহ, মোটা লোম ও প্রশস্ত মাথা ইত্যাদি। এগুলো ডায়ার নেকড়ের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। এরপর এই সম্পাদিত ডিএনএ একটি গৃহপালিত কুকুরের ডিম্বাণুতে সংযোজন করা হয় এবং তার গর্ভেই ভ্রূণ প্রতিস্থাপন করা হয়।
এর ৬২ দিন পর জন্ম নেয় রোমুলাস, রেমাস ও খালিসি।
রোমুলাস, রেমাস ও খালিসি সম্পর্কে যা জানা গেছে
ডায়ার নেকড়ের এই তিনটি ছানার মধ্যে রোমুলাস ও রেমাস (পুরুষ) জন্ম নেয় ১ অক্টোবর ২০২৪ এবং খালিসি (মেয়ে) জন্ম নেয় ৩০ জানুয়ারি ২০২৫।
বর্তমানে ৬ মাস বয়সি রোমুলাস ও রেমাস প্রায় ৪ ফুট লম্বা এবং ৮০ পাউন্ড (৩৬ কেজি) ওজনের। এরা পূর্ণবয়স্ক হলে ৬ ফুট (১৮৩ সেমি) ও ১৫০ পাউন্ড (৬৮ কেজি) ওজন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খালিসি এখন ৩ মাস বয়সেও অনুরূপভাবে বেড়ে উঠছে।
ইতোমধ্যে এদের দেহে দেখা যাচ্ছে সাদা লোম, প্রশস্ত মাথা ও বড় গঠন—যা ডায়ার উলফের বৈশিষ্ট্য বহন করে।
কলোসাল-এর চিফ অ্যানিম্যাল অফিসার ম্যাট জেমস বলেন, ‘প্রথম ছানাটিকে সিজারিয়ান প্রসবের মাধ্যমে নেওয়ার পর আমি যখন সেটিকে তোয়ালে দিয়ে মুছছিলাম, তখন মনে হয়েছিল— ওহ! এটা কি বিশাল!’
তার মানে ডায়ার নেকড়ে কি সত্যিই ফিরে এসেছে?
কলোসাল যদিও বলছে যে, তারা ডায়ার নেকড়েকে ‘ডি-এক্সটিঙ্ক্ট’ করেছে। অবে অনেক বিজ্ঞানী মনে করছেন— এগুলো আসলে জেনেটিকালি পরিবর্তিত (মডিফায়েড) সাদা নেকড়ে, পুরোপুরি ডায়ার নেকড়ে নয়।
কলোসাল-এর উপদেষ্টা ও স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাভ ডালেন বলেন, ‘এই প্রাণীগুলোর জেনেটিক কাঠামোর ৯৯.৯% সাদা নেকড়ে। তবে তারা কিছু বিশেষ ডায়ার নেকড়ের জিন বহন করে। যেগুলো এদের দেখতে ও গঠনে অনেকটা ডায়ার নেকড়ের মতো করে তুলেছে। এটাই দারুণ বিষয়।’
এতো বছর পর প্রাণীটিকে কেনো ফিরিয়ে আনা হলো?
কলোসাল বলছে, এই প্রকল্পটি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সীমানাকে প্রসারিত করেছে এবং বিপন্ন প্রাণীদের সংরক্ষণে নতুন উপায় খুঁজে পাওয়ার নতুন পথ খুলে দিয়েছে। ডায়ার নেকড়ের মতো একটি ‘অভিজাত শ্রেণি’র প্রাণীর মাধ্যমে এই সক্ষমতা প্রদর্শন করাই ছিল এর লক্ষ্য।
প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা অ্যান্ড্রু পাস্ক বলেন, ‘ডায়ার নেকড়ের এই প্রকল্পটি প্রমাণ করে যে, হারিয়ে যাওয়া বৈচিত্র্য ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা এখন মানুষের হাতে রয়েছে।’
প্রাণী তিনটি নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কলোসাল এখন ছানাগুলোর বৃদ্ধি, স্বাস্থ্য ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করবে। ভবিষ্যতে তারা উলি ম্যামথ (হাতির একটি বিলুপ্ত প্রজাতি)-এর মতো অন্য বিলুপ্ত প্রজাতিকেও ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করতে পারে।
কানাডার অ্যাসোসিয়েশন অব জুস অ্যান্ড অ্যাকুরিয়াম-এর প্রেসিডেন্ট ড্যান অ্যাশ বলেন, ‘পৃথিবীতে যে পরিমাণ প্রাণী আছে, সেগুলোই তো আমরা ঠিকভাবে রক্ষা করতে পারছি না।’
তবু এটি নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।