Logo
Logo
×

যুক্তরাষ্ট্র

মিডল ইস্ট মনিটরের নিবন্ধ

ট্রাম্পের ২.০: যুক্তরাষ্ট্র কি বৈশ্বিক নেতৃত্ব হারাচ্ছে?

Icon

ড. আব্দুল্লাহ খলিফা আশ-শায়জী

প্রকাশ: ২০ মার্চ ২০২৫, ০৮:২৮ পিএম

ট্রাম্পের ২.০: যুক্তরাষ্ট্র কি বৈশ্বিক নেতৃত্ব হারাচ্ছে?

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ওভাল অফিসে বিতর্ক জুড়ে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: মিডল ইস্ট মনিটর

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় ফেরার ফলে আরব অঞ্চলের যে বিষয়গুলো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ সেগুলো হলো: ইসরাইলি দখলদারিত্ব, গাজা গণহত্যা, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা। শত্রুদের সঙ্গে ট্রাম্পের বন্ধুসূলভ মনোভাব আমেরিকার বন্ধুরাষ্ট্রগুলোকেও বেশ চিন্তায় ফেলেছে। বিশেষ করে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার সখ্যতা সত্যিই উদ্বেগজনক। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সনদ, চুক্তি, আলোচনা বা আইনি বাধ্যবাধকতার প্রতি ট্রাম্পের তুচ্ছতাচ্ছিল্য ও অনভিপ্রেত আচরণ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। 

আগে ধারণা ছিল, ইসরাইলের প্রতি সবচেয়ে সহাভূতিশীল মার্কিন প্রেসিডেন্ট হলেন বাইডেন। দেশটির (ইসরাইলের) সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারে বাইডেনের চেয়ে বেশি সহায়ক আর কেউ হতে পারে না। জো বাইডেনের সময় গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা অব্যাহত রাখতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচবার ভেটো দিয়েছে আমেরিকা।

এবার বাইডেনের জায়গা দখল করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। যদিও গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। 

গাজা উপত্যকা দখল করে ফিলিস্তিনিদের মিশর বা জর্ডানে (সম্প্রতি ফাঁস হওয়া সুদান, সোমালিয়া এবং অন্যান্য দেশে) সরিয়ে দিতে ট্রাম্পের প্রস্তাবে বেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে আরব বিশ্ব। ওই সময় হোয়াইট হাউসে একটি পূর্বনির্ধারিত সফর ছিল জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহর। তিনি ওই সফরে বেশ বিব্রতই হয়েছিলেন বলা চলে। 

গাজার সংকট সমাধানে মিশরের প্রস্তাবিত পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য ঐকমত্যে পৌঁছাতে এবং ট্রাম্পের দাদাগিরির প্রতিক্রিয়া জানাতে সম্প্রতি রিয়াদে একটি মিনি-শীর্ষ সম্মেলন এবং কায়রোতে একটি পূর্ণ-শীর্ষ সম্মেলন ডেকেছিল আরব লীগ। সম্মেলনে গাজার বাসিন্দাদের বাস্তুচ্যুত না করে যুদ্ধবিরতি এবং গাজা পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে আরবীয়রা। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু আরব দেশগুলোর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বলেই ধরে নেওয়া যায়। যদিও ট্রাম্পের ওই প্রস্তাবকে বিশ্ব সম্প্রদায় ‘জাতিগত নির্মূল’ বলে আখ্যা দিয়েছে। 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দিয়েছিলেন, ধসে যাওয়া গাজার বাসিন্দাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যই এ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে গাজায় এই নির্মম ধ্বংসযজ্ঞের জন্য কারা দায়ী তা উল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। 

ট্রাম্পের ভাবখানা এমন যেন দ্বিতীয় মেয়াদে ডিপ স্টেটকে ভেঙে ফেলা, বিরোধীদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিশোধ নেওয়ার ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসেছেন। ইতোমধ্যে ফেডারেল আমলাতন্ত্র এবং সরকারের পরিসর ছোট করে এনেছেন ট্রাম্প। অনেক ফেডারেল এজেন্সি বন্ধ করে দিয়েছেন। অসংখ্য আমেরিকানকে চাকরিচ্যুত করে এবার তাদের গালি ও সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র ধনকুবের ইলন মাস্ক। 

অনেক আমেরিকান ট্রাম্পের সাম্প্রতিক নীতির কারণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন এবং তাকে তুলোধুনো করছেন। কানাডা, মেক্সিকো, চীন ও ইউরোপিয় ইউনিয়নের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেও তোপের মুখে পড়েছেন তিনি। এসব শুল্কনীতির ফলে আমেরিকায় কি মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিতে পারে না?

২০১৭ সালে ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদকালে ছয়টি মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। তবে বাইডেন এসে সেটি বাতিল করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, বিভিন্ন মতের ও পথের মানুষকে জায়গা দিতে আমেরিকার দীর্ঘ উদারবাদী ইতিহাস রয়েছে। এটি আমাদের জাতীয় বিবেকের ওপর ‘কলঙ্ক’। 

এবার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতার মসনদে বসে ট্রাম্প আগের সেই নীতিই হাতে নিলেন। এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে তিনি প্রায় ৪৩ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিতে মনস্থ করেছেন। দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো। রেড লিস্টের মধ্যে রয়েছে লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, সুদান, সোমালিয়া, ইরান ও আফগানিস্তান। অরেঞ্জ লিস্টে রয়েছে পাকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও দক্ষিণ সুদান। আর ইয়েলো লিস্টে রয়েছে মৌরিতানিয়া ও আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলো। 

ট্রাম্পের যে আচরণে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাষ্ট্রগুলো সবচেয়ে অবাক হয়েছে তা হলো ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে তার অবস্থান। ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছেন, ন্যাটোর সদস্য দেশগুলো প্রতিরক্ষা বাজেট না বাড়ালে তাদের রক্ষা করবে না। যা স্পষ্টভাবে ন্যাটো সনদের লঙ্ঘন। এই সনদের পাঁচ নম্বর অধ্যায়ে বলা হয়েছে, ন্যাটো সদস্যগুলো একে-অপরকে রক্ষায় সর্বদা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে।

ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও হামাসের (এটি ১৯৯৭ সাল থেকে মার্কিন আইনে একটি নিষিদ্ধঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন) সঙ্গে একটি গোপন আলাপের নথি প্রকাশ করেছে। ওই আলাপে তারা হামাসের সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধবিরতি ও মার্কিন পাঁচ জিম্মির মুক্তির বিষয়ে আলাপ করেছিল। নেতানিয়াহু তখনও গণহত্যা বন্ধ করতে রাজি ছিল না। তবে তাকে উপেক্ষা করেই হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা চালিয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসন। তখন হামাসকে হুমকিও দিয়েছিলেন ট্রাম্প। তিনি বলেছিলেন, জিম্মিদের মুক্তি না দিলে জাহান্নামের সব দরজা খুলে যাবে। 

এখন ফের গাজায় ইসরাইলের বর্বর হামলা শুরু হয়েছে। আর এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন রয়েছে হোয়াইট হাউসের। গত সোমবার একদিনেই পাঁচ শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে ইসরাইল।

এসবকিছুর ফল হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে গত দুই মাসে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে ৪৫ শতাংশ। তদুপরি, ইউরোপ ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর ৬০ থেকে ৮৮ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, ট্রাম্পের দর্শন ও নীতি শান্তির জন্য হুমকি। এটা ভয়ংকর সত্য যে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ আমেরিকার সঙ্গে মিত্রদের সম্পর্ক বিষাক্ত করে তুলেছে। 

আমরা জানি যে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের পদটি ঐতিহ্যগতভাবে ‘বিশ্বনেতা’ বলে বিবেচিত। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন ট্রাম্প তার পশ্চিমা মিত্রদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছেন, মধ্যপ্রাচ্যের রাজধানীগুলোতে ঘণ্টাধ্বনি বাজাচ্ছেন (আতঙ্কিত করে তুলছেন)। তাই বলা বাহুল্য, ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসে প্রত্যাবর্তন বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে এরই মধ্যে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। আর আমেরিকা তার বৈশ্বিক নেতৃত্ব হারাচ্ছে।

লেখক: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়

অনুবাদ: সজীব হোসেন

ঘটনাপ্রবাহ: হামাস ইসরাইল যুদ্ধ


আরও পড়ুন

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম