মধ্যপ্রাচ্যে সত্যিই উত্তেজনা কমাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র?
আবদুল মজিদ চৌধুরী
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০২:৩০ পিএম
গাজা যুদ্ধে ইসরাইলকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র
হিজবুল্লাহর বিশেষ যোগাযোগ যন্ত্র ‘পেজার’ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে ইসরাইল। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের কারসাজিতে মঙ্গলবার দক্ষিণ লেবাননে শত শত পেজার বিস্ফোরিত হয়।
এ ঘটনায় ইসরাইলকে অর্থনৈতিক সহায়তা এবং সর্বোচ্চ অস্ত্র সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্র বলছে, লেবাননের ঘটনায় ইসরাইল তাদের অবহিত করেনি। তবে বুধবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, লেবাননে অভিযানের আগে যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে রেখেছিল ইসরাইল। এ সময় অভিযানের বিস্তারিত তথ্য তারা সরবরাহ করেনি।
গত ৭ অক্টোবরে ইসরাইলে হামাসের পর উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি। টানা ১১ মাস ধরে পাল্টা হামলা চালিয়েও ইসরাইলের প্রতিশোধ স্পৃহা থামছে না। বিশ্বজুড়ে তীব্রভাবে যুদ্ধবিরতির দাবি উঠলেও বিবেক নড়ছে না ইসরাইলের। এরমধ্যে কাতার, মিশর এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র।
প্রশ্ন উঠেছে, ইসরাইলকে লেবাননে হামলার ব্যাপারে সম্মতি দিয়ে ঠিক কোনো প্রক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র! বলা হচ্ছে, গত ৭ অক্টোবর গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দশবার মধ্যপ্রাচ্য সফর করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন।
সর্বশেষ বুধবার কায়রো সফর করেছেন এই মার্কিন কূটনীতিক। ব্লিঙ্কেন মিশরে গেলেন, গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা অগ্রগতির লক্ষ্যে। আর সে সময় লেবাননে নজিরবিহীন কায়দায় পেজার বিস্ফোরণ ঘটালো ইসরাইল। ইসরাইলের প্রতিটি পদক্ষেপ মার্কিন প্রশাসন ওয়াকিবহাল থাকলে, এ ধরনের সামরিক অভিযানের কথাও মার্কিন প্রশাসনের গোপন থাকার কথা নয়।
পেজার বিস্ফোরণের ঘটনায় বিবৃতিতে ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ বলেছে, ‘এই অপরাধমূলক আগ্রাসনের জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী ইসরায়েল। অবশ্যই এই পাপপূর্ণ আগ্রাসনের জন্য তারা ন্যায্য শাস্তি পাবে’।
আর ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস জানিয়েছে, ‘পেজার বিস্ফোরণ বড় পরিসরে ইসরাইলের যুদ্ধ বাধানো পরিকল্পনা। আর এই প্রবণতা ইসরাইলকে শুধুমাত্র ব্যর্থতা ও পরাজয়ের দিকে নিয়ে যাবে’।
সবমিলিয়ে যুদ্ধ থামাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্রের দূতিয়ালি বিরাট প্রশ্নের সম্মুখে। ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনি আন্দোলনরত হামাসের পক্ষ থেকে সর্বশেষ যা বলা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে চলমান যুদ্ধ আরো বিলম্বিত হবে।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ত জানিয়েছে, যুদ্ধের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে ইসরাইল। সেনাদের সঙ্গে সাক্ষাতে এমন মন্তব্য করেন তিনি। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সায় জানিয়ে আসছে হামাস। নতুন কোনো শর্ত ছাড়াই গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি চায় গোষ্ঠীটি। কিন্তু ইসরাইলের অনড় অবস্থানের কারণে হামাসের নতুন রাজনৈতিকপ্রধান ইয়াহিয়া সিনওয়ার বলেছেন, গাজায় দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস।
গাজা যুদ্ধ অবসানে দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান চায় সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব মেনে না নিলে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না বলেও জানিয়েছে দেশ দু'টি। ১১ মাস ধরে গাজায় ইসরাইল যে নৃশংসতা চালিয়ে যাচ্ছে, তা বন্ধ করতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদেশগুলো রাজি নয় বলে দাবি করেছে সৌদি আরবের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান প্রিন্স তুর্কি আল-ফয়সাল।
প্রিন্স তুর্কি সৌদি আরবের প্রগতিশীল শীর্ষ কূটনৈতিকদের অন্যতম। যিনি বলা যায়, ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণে ইতিবাচক। কিন্তু এরপরও যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার করতে বাধ্য হচ্ছেন। যার কারণ এমন টানা যুদ্ধ কোনো পক্ষের জন্য স্বস্তির নয়।
এছাড়া ফিলিস্তিন ইস্যুতে মার্কিন নীতির কঠোর সমালোচনা করে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইউএস গ্রিন পার্টির প্রার্থী ড. জিল স্টেইন। ড. জিলের দাবি, ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয় শিবিরই ইসরাইলে অর্থ পাঠাচ্ছে। এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তহবিল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আর যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা বন্ধ করলে চোখের পলকে গাজা যুদ্ধ বন্ধ হতে পারে।
সম্প্রতি দি রে হানানিয়া রেডিও শোতে সাক্ষাতকারের সময় ড. জিল বলেন, গাজায় এটি ইসরাইলের নয় যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ।
এই মার্কিন রাজনীতিবিদ বলেন, ‘নারী, শিশু ও নিরীহ বেসামরিক নাগকিরদের হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রের ৮০ ভাগ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র দিচ্ছে। আমরা অর্থ, সামরিক সমর্থন, এবং কূটনৈতিক রক্ষাকবজ এবং গোয়েন্দা তথ্যও দিয়ে যাচ্ছি। ফলে এখানে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে।’
‘এটা আমাদের যুদ্ধ। একে ইসরাইলের যুদ্ধ বলা অনেক দিক দিয়েই ভুল। এটা যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ। আমরা এই যুদ্ধের দায়িত্বে আছি। আমরা এই যুদ্ধ চোখের পলকে থামাতে পারি।’
সবমিলিয়ে এই আলোচনা এবং বয়ান তুলে ধরার সময় এসেছে, গাজায় যুদ্ধ বন্ধে ইসরাইলের প্রশাসনের দিকে দায় তোলা ‘শিশুসুলভ’। কারণ ইসরাইলজুড়ে গত কয়েক সপ্তাহে যুদ্ধ বন্ধের ব্যাপক বিক্ষোভের পরও গাজা ইস্যুতে নমনীয় হচ্ছে না বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকার। তার কারণ, অস্ত্র এবং অর্থের যোগান বন্ধ না করে যুদ্ধের দামামা থামানো যায় না। আর এই কাজটিই করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।
আর এটিই গত কয়েকমাস আগে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। গাজা যুদ্ধের প্রতিবাদে গত এপ্রিল-মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে যায় ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, কলম্বিয়া ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে।
ওই সময় শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়ায় পুলিশি দমনপীড়নের ঘটনাও ঘটে। বিক্ষোভকারীদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রর সামরিক অস্ত্র তৈরি খাতে বিনিয়োগ কমানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরপরও ইসরাইলি অস্ত্র সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো থেকে বিনিয়োগ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। এই শিক্ষার্থীরাই একসময় ভিয়েতনাম যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছে। বলা হয়ে থাকে, ভিয়েতনামে সফল হয়নি যুক্তরাষ্ট্র। এখন গাজায় যুদ্ধ বন্ধের বড় পদক্ষেপ যদি নিতে হয়, সেটা যুক্তরাষ্ট্রকেই নিতে হবে।