
প্রিন্ট: ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৫৫ পিএম
রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই দেশের প্রধান নায়ক

হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
আবারও প্রমাণিত হলো, রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই দেশের রিয়েল হিরো। এ দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির প্রধান নায়ক, যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা প্রতিকূল পরিবেশে অমানবিক পরিশ্রম করে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ করছেন। যে রেমিট্যান্সের প্রতিটি স্তরে রয়েছে অভিবাসী শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ আর দেশের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী-সন্তান, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন-সবাইকে দূরে রেখে হাসিমুখে শ্রমে-ঘামে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিনের পর দিন প্রেরণ করে আসছেন আমাদের অভিবাসী ভাই-বোনেরা। অল্প বয়সে বিদেশ গিয়ে, কাছের মানুষ দূরে রেখে, শখ-আহ্লাদ ভুলে গিয়ে, দিন-রাত কাজ করে, সত্য বুকে চাপা দিয়ে হাসিমুখে আপন মানুষকে ভালো থাকতে ও ভালো রাখতে তারা দেশে এ অর্থ প্রেরণ করে থাকেন।
বিগত সরকারের আমলে নানা শর্তের বেড়াজালে আইএমএফ আমাদের চার বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত আমরা পেয়েছি ১.৭৫ বিলিয়ন এসডিআর। আইএমএফ-এর ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকারকে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন সরকারি সেবার মূল্যবৃদ্ধি করতে হয়, যার ফলে মূল্যস্ফীতিসহ সমষ্টিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং জনমনে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রত্যেক কিস্তিতেই এ ঋণ পাওয়ার আগে আমাদের আইএমএফ কর্তৃক প্রদত্ত শর্তগুলো বাধ্যতামূলকভাবে প্রতিপালনের প্রমাণাদি প্রদান করতে হয়।
অথচ আমাদের প্রবাসীরা কোনো শর্ত ছাড়াই প্রতিবছর বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছে, যা বিগত ২০২৪ সালে ছিল ২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে চলতি বছরের ১ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২.৯৫ বিলিয়ন ডলার। এ বিবেচনায় মার্চে রেমিট্যান্স ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে বলে আশা করা যাচ্ছে; যা স্বাধীনতার পর দেশে একক কোনো মাসে সর্বোচ্চ প্রাপ্ত রেমিট্যান্স। ২০২৪ সালের ১ থেকে ২৬ মার্চ প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ১.৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২৪-এর তুলনায় ২০২৫ সালের ১ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত প্রাপ্ত রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির হার ৮৩.২৩ শতাংশ। মার্চে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে, যার পরিমাণ ৪৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। দ্বিতীয় প্রধান প্রবাসী আয় এসেছে বিশেষায়িত ব্যাংক বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে, যার পরিমাণ ২৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সরকারি ব্যাংকের মধ্যে ২১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স প্রাপ্তির মাধ্যমে শীর্ষে রয়েছে জনতা ব্যাংক।
পতিত আওয়ামী সরকারের শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মুজিব পরিবারের বিরুদ্ধে ৫৯ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে, যার সঙ্গে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগনি যুক্তরাজ্যের পদত্যাগকৃত সাবেক অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিকের যোগসূত্রতা রয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতি নিয়োগের মাধ্যমে অর্থ পাচারকারীদের সুরক্ষা দিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। সেসময় সরকার, কতিপয় রাজনীতিক, আমলা ও ব্যবসায়ী-এ চার চক্রের নেক্সাস দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। দেশের খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য কখনো জানতে দেওয়া হয়নি। যে পরিমাণে ঋণ আদায় হতো, তার চেয়ে বেশি অবলোপন হতো। ঋণের টাকা ব্যাপক অপচয়, দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। ঋণ পরিশোধে বাস্তবভিত্তিক কোনো পরিকল্পনা না থাকায় এ ঋণ এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিগত সরকারের সময় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সূচকের ডেটা ছিল মিথ্যা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোকে (বিবিএস) নির্দেশদানের মাধ্যমে মনমতো ডেটা ব্যবহার করে উন্নয়নের ফিরিস্তি গাওয়া হতো। অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যকে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক অনুষ্ঠানে বোগাস বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। সিপিডি, পিআরআই, সানেমসহ অর্থনীতিবিষয়ক সব স্বনামধন্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিগত সরকারের আমলের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ভুল ও অতিরঞ্জিত বলে আখ্যায়িত করেছে। ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন পাঁচতারকা হোটেলে বসে সুদহার ও ডলারের মূল্য নির্ধারণ করে দিত। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বিদেশে রোড শোর নামে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করে প্রমোদভ্রমণ করা হয়েছিল।
অন্যদিকে অভিবাসী ভাই-বোনদের মধ্যে রয়েছে প্রবল দেশপ্রেম। বিগত ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিদেশে অবস্থান করে রেমিট্যান্স প্রেরণ বন্ধ করার মাধ্যমে বিগত আওয়ামী সরকারের পতন নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন প্রবাসী ভাই-বোনেরা। আওয়ামী সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলসহ জুলাই-আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে হত্যার প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের প্রতি সমর্থন জানিয়ে দেশে রেমিট্যান্স প্রেরণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। পতিত আওয়ামী সরকারের মুজিব পরিবারের ঘনিষ্ঠ সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রী অভিবাসীদের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলেও তারা দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ রাখা অব্যাহত রেখেছিলেন। আওয়ামী সরকারের পতনের পর অভিবাসীরা আবারও রেমিট্যান্স পাঠানো শুরু করলে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হতে থাকে। ফলে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমানে আমাদের রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। রপ্তানি আয়ের সঙ্গে তুলনা করলে যোগ-বিয়োগের হিসাবে প্রবাসীদের প্রেরিত এ আয়কেই আমরা প্রধান আয় হিসাবে বিবেচনা করতে পারি। কারণ, রেমিট্যান্স আহরণে সরকারের তেমন কোনো বিনিয়োগ নেই। অথচ আরএমজি খাতে নানা রকম প্রণোদনা প্রদানের পাশাপাশি শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণ করা বড় এক চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও আরএমজি খাত ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ কলকারখানা স্থাপনের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ দেওয়া হয়েছে; যার বড় একটা অংশ ব্যাংকগুলো ফেরত পাচ্ছে না। বিগত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে।
কমবেশি সব মিলিয়ে এক কোটির বেশি প্রবাসী বিদেশে অবস্থান করছেন। একজন অভিবাসীর উপার্জনের ওপর পরিবারের চার থেকে পাঁচজন সদস্য নির্ভরশীল। সেই হিসাবে এক কোটি অভিবাসী দেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রদান করছেন। হাজার হাজার অভিবাসী নারী আছেন, যারা সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করে নিজের পরিবারকে দরিদ্র থেকে মুক্ত করে সুন্দর অর্থনৈতিক ভিত তৈরিতে সমর্থ হয়েছেন। নিজের আয়ের টাকা দিয়ে নতুন ঘরবাড়ি তৈরি করেছেন। ভবিষ্যতের জন্য ব্যাংকে সঞ্চয় রেখেছেন। ছেলেমেয়েদের ভালো করে লেখাপড়া শিখিয়ে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। যাদের অবদানের কথা দেশবাসী সবসময় স্মরণ করে।
প্রবাসী শ্রমিকদের সম্মান জানিয়ে ঈদের প্রধান জামাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে বলেছেন, ‘আমাদের প্রবাসী শ্রমিকরা যারা বিদেশে আছেন, সারা বছর কষ্ট করেছেন, আজকে হয়তো ঈদের জামাতে যেতে পারবেন কিংবা পারবেন না, জাতির পক্ষ থেকে আমরা তাদের ঈদ মোবারক জানাচ্ছি। যেসব বাংলাদেশি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রয়েছেন, আমরা তাদের ভুলে যাইনি, তাদের অবদান এ জাতি সবসময় সম্মানের সঙ্গে মনে রাখবে।’ আমরা দেখেছি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল প্রবাসীদের জন্য লাউঞ্জ, এয়ারপোর্টে সাবসিডাইজড মূল্যে খাবার প্রদান, রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া, প্রবাসীদের এমআরপি পাসপোর্ট প্রদান করা, অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের জন্য হাসপাতাল চালু ও অভিবাসন ব্যয় নিয়ন্ত্রিত রেখে কর্মীবান্ধব নানা কর্মপরিকল্পনায় কাজ করছেন। একই সঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্যা ভূঁইয়া দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতে এ খাতের অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময়সহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। ট্রেডিশনাল শ্রমবাজারের পাশাপাশি নতুন শ্রমবাজার খোলার চেষ্টা করছেন। অভিবাসীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করলে, সামাজিকভাবে তাদের স্বীকৃতি প্রদান করলে, সম্মানিত করাসহ তাদের প্রতি মমতা বাড়ালে তারা দেশ ও জাতীর প্রতি অবদান রাখতে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হবেন। বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণ করবেন।
তাই সরকারের নীতি সহায়তার পাশাপাশি কর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে সম্পৃক্ত করে অভিবাসী কর্মীদের মর্যাদা বৃদ্ধি করা উচিত। শুধু সরকারি কর্মকর্তা ও ভিআইপিদের জন্য নয়, রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের জন্য সরকারিভাবে জমি বরাদ্দের সুযোগ রাখা উচিত। মাইগ্রেশন ডিপ্লোমেসি জোরদারের মাধ্যমে কুয়েত, কাতার, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়াসহ বন্ধ হওয়া শ্রমবাজারগুলো আবারও চালু করার উদ্যোগ নেওয়া; ইউরোপ-আমেরিকার নতুন টেকসই শ্রমবাজার খুঁজে বের করা; ভারত, শ্রীলংকা, ফিলিপাইনের মতো দক্ষ ও অতিদক্ষ কর্মীসহ প্রফেশনালস প্রেরণে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা; নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতে বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে সম্পৃক্ত করে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিতভাবে কাজ করা; দেশের রিয়েল হিরো রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা এবং সর্বোপরি আমাদের অভিবাসী ভাই-বোনেরা বিদেশে অবস্থান করেও দেশপ্রেমের যে উদাহরণ রেখে চলছেন, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে আমাদের প্রবাসী আয় আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। পতিত সরকারের আমলের ভেঙে পড়া অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে।
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি
kirondebate@gmail.com