Logo
Logo
×

বাতায়ন

নিউইয়র্কের চিঠি

আমেরিকায় জোরালো হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের আন্দোলন

Icon

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমেরিকায় জোরালো হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের আন্দোলন

সংগৃহীত ছবি

যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়ে আবার বিতর্ক দানা বেঁধে উঠেছে। দেশটির উত্তরে অবস্থিত বিশাল দেশ কানাডা এবং দক্ষিণে অবস্থিত মেক্সিকোতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া ও বেলারুশ ছাড়া সব দেশে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১১১টি দেশে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা হয়েছে, ৫৫টি দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বহাল রয়েছে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র অন্যতম। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর বিশ্বাস, যুক্তরাষ্ট্র যদি মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিলোপ করে, তাহলে যেসব দেশে এখনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, সে দেশগুলোর অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করবে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ‘মানবাধিকারের মহান দেশ’ হিসাবে খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র থেকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান বিলোপ করার জন্য দাবি জানিয়ে এলেও দেশটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে যাচ্ছে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলিনায় ফায়ারিং স্কোয়াডে এক ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। লুইজিয়ানায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক ব্যক্তি, যার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে, তিনি আরও মানবিক উপায়ে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আবেদন করেছেন। আর আইডাহো স্টেট মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রাথমিক উপায় হিসাবে ফায়ারিং স্কোয়াড ব্যবহারের আইন অনুমোদন করতে যাচ্ছে। এ তিনটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার সংগঠনগুলো আবারও সোচ্চার হয়েছে দেশ থেকে মৃত্যুদণ্ড সম্পূর্ণ বিলোপে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ২৭টি স্টেটে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। এর মধ্যে ২৫টি স্টেটে মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্ত জুরিগণ, ২৩টি স্টেটে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার জন্য জুরিদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হয়।

কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে, যেমন রাষ্ট্রদ্রোহিতা, গুপ্তচরবৃত্তি, ব্যাপক পরিমাণে মাদক পাচারের মতো অপরাধের শাস্তি বিধানে স্টেটের এখতিয়ার নেই, এগুলো ফেডারেল অপরাধ হিসাবে গণ্য এবং ফেডারেল আইনে এসব অপরাধে জড়িতদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে চূড়ান্ত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি দিতে পারে ৬টি স্টেটের সর্বোচ্চ আদালত। এ স্টেটগুলো হচ্ছে-আরকানসাস, ক্যালিফোর্নিয়া, জর্জিয়া, লুইজিয়ানা, মিসিসিপি ও সাউথ ক্যারোলিনা। বড় ধরনের মাদক পাচারে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে দুটি স্টেট : ফ্লোরিডা ও মিজৌরি। বিমান হাইজ্যাকের ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে জর্জিয়া ও মিসিসিপি। ভারমন্ট ১৯৬৫ সালে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করলেও রাষ্ট্রদ্রোহিতায় দায়ী ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের দুটি স্টেট নেব্রাস্কা ও মন্টানা মৃত্যুদণ্ডের রায় দিতে জুরিদের ব্যবহার করে না। নেব্রাস্কায় তিনজন বিচারকের বেঞ্চ যদি অভিযুক্তকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদানে বাধা থাকে না। কিন্তু যদি তিনজনের মধ্যে একজন আপত্তি উত্থাপন করেন, সেক্ষেত্রে অভিযুক্তের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিণত হয়। অন্যদিকে মন্টানা যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র স্টেট, যেখানে বিচারিক আদালতের বিচারক একাই অভিযুক্তের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিতে পারেন।

চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীর সংখ্যা ২,০৯২, যার মধ্যে ৪৬ জন নারী। এসব অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে বিচারিক আদালত। আপিল আদালতে রায়ের হেরফের হতে পারে। অনেক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তের রায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিবর্তিত হতে পারে, অল্পকিছু অপরাধী উচ্চ আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীর সংখ্যা ছিল ২,২৮৩। কিন্তু আপিল আদালতে মৃত্যুদণ্ডের রায় কারাদণ্ডে পরিবর্তিত হওয়ায় ২০২৪ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। অনেক সময় প্রেসিডেন্ট মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমাও করে দিতে পারেন। যেমন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যিনি মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে সোচ্চার এবং মৃত্যুদণ্ডের আওতা সম্প্রসারণের প্রবক্তা, তিনি দায়িত্ব গ্রহণের তিন সপ্তাহ আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ফেডারেল আইনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৪০ জনের মধ্যে ৩৭ জনের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করেছেন, যারা এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করবে। এ নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট তার এখতিয়ারে দণ্ড মওকুফ করতে পারেন। মওকুফপ্রাপ্তরা পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের হত্যা, ফেডারেল ভূখণ্ডে হত্যা, ব্যাংক ডাকাতি, মাদক পাচার ও ফেডারেল স্থাপনায় প্রহরী বা বন্দিদের হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল বলে তারা ফেডারেল আইনে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল। যে তিনজন বাইডেনের ক্ষমার আওতায় পড়েনি, তাদের একজন ২০১৫ সালে সাউথ ক্যারোলিনায় এক চার্চে গুলি করে নয়জন কৃষ্ণাঙ্গকে হত্যা করেছিল। আরেকজন ২০১৩ সালে বোস্টন ম্যারাথন উৎসবে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল এবং তৃতীয়জন ২০১৮ সালে পিটসবুর্গে এক সিনাগগে হামলা চালিয়ে প্রার্থনারত ১১ জন ইহুদিকে হত্যা করেছিল, যেটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ভয়াবহতম সেমিটিক-বিরোধী হামলা।

মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করার পর্যায় পর্যন্ত আসা এক বিলম্বিত প্রক্রিয়া। ১৯৭৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ১,৬১৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, যাদের ১৮ জন নারী। ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’ বা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদাররা যদিও ঢালাওভাবে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের সব অপরাধে অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করে, কিন্তু বাস্তবে গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ও দণ্ডপ্রাপ্ত অধিকাংশই শ্বেতাঙ্গ। যে ১৮ নারী অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, তাদের মধ্যে ১২ জনই শ্বেতাঙ্গ। বিচারিক আদালতে কোনো অপরাধীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করা হলেও উচ্চ আদালতে আপিল, এবং বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যালোচনার পর রায় কার্যকর করায় দীর্ঘসূত্রতা একটি সাধারণ ব্যাপার। সে হিসাবে ২০২৫ থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত ৩৮ জন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার কথা। এর মধ্যে গত ৭ মার্চ পর্যন্ত ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, যাদের মধ্যে তিনজন শ্বেতাঙ্গ এবং তিনজন কৃষ্ণাঙ্গ। আরও ১২ জন অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ে কার্যকর হবে। তবে ২০ মার্চের মধ্যে তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে। গত বছরের (২০২৪) আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল বিভিন্ন স্টেট।

ডেথ পেনাল্টি ইনফরমেশন সেন্টারের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে ইতোমধ্যে যে ছয়জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, তাদের মধ্যে গত ৭ মার্চ সাউথ ক্যারোলিনায় ব্র্যাড সিগমনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে তিন সদস্যের ফায়ারিং স্কোয়াডে। ২০০১ সালে সাবেক গার্লফ্রেন্ডের বাবা-মাকে বেসবল ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সিগমন ইলেকট্রিক চেয়ার বা প্রাণঘাতী ইঞ্জেকশনে মৃত্যুর চেয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুবরণ করার আবেদন করার পর তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে সাউথ ক্যারোলিনায় ১৫ বছর পর কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো।

লুইজিয়ানা স্টেটে আগামী ১৮ মার্চ নাইট্রেজেন হাইপোক্সিয়া গ্যাস ব্যবহার করে এক নারী হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জেসি হফম্যান জুনিয়র নামে এক ব্যক্তির দণ্ড কার্যকর হওয়ার দিন ধার্য ছিল। কিন্তু তিনি আবেদন করেছেন আরও মানবিক উপায়ে তার দণ্ড কার্যকর করতে। তার আইনজীবীরা যুক্তি প্রদর্শন করেছেন, এ গ্যাস ব্যবহার করে হফম্যানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলে তা আমেরিকান সংবিধান অনুযায়ী হফম্যানের ধর্ম, বিশেষ করে তার বৌদ্ধরীতির প্রাণায়াম ও ধ্যানচর্চার স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার শামিল হবে। কারণ নাইট্রোজেন হাইপোক্সিয়া ব্যবহার নিষ্ঠুর ও অস্বাভাবিক ধরনের শাস্তি, যা মানসিক নিপীড়নের কারণ ঘটায়। তাছাড়া দণ্ড কার্যকর করার এ পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা নেই এবং আইনজীবীর উপস্থিত থাকার সুযোগ নেই। তার চেয়ে ফায়ারিং স্কোয়াড পদ্ধতি, মৃত্যুতে সহায়ক চিকিৎসা পদ্ধতি, আপেল জুসের সঙ্গে প্রাণঘাতী মাদক মিশিয়ে দণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতি অধিকতর মানবিক বলে হফম্যানের আইনজীবীরা আদালতকে বলেন। কিন্তু লুইজিয়ানার আইনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার তিনটি উপায়ের কথা বলা হয়েছে : নাইট্রোজেন হাইপোক্সিয়া ব্যবহার, প্রাণঘাতী ইঞ্জেকশন প্রদান এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করার মাধ্যমে। তবে গত দুই দশক ধরে লুইজিয়ানা স্টেট প্রাণঘাতী ইঞ্জেকশনের ওষুধ সংগ্রহ নিয়ে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে ইঞ্জেকশন পুশ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারেনি। সরকারপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য হলো, নাইট্রোজেন হাইপোক্সিয়া ব্যবহার ব্যথাহীন এবং লুইজিয়ানার আইনে অনুমোদিত পদ্ধতি। তারা অভিযোগ করেন, আসামিপক্ষ দণ্ড কার্যকরে অযৌক্তিক কারণ দাঁড় করিয়ে ফরিয়াদি পরিবারের সুবিচারপ্রাপ্তিকে বিলম্বিত করছে। লুইজিয়ানায় ১৫ বছর আগে শেষ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছিল প্রাণঘাতী ইঞ্জেকশন দেওয়ার মধ্য দিয়ে। রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত এ স্টেটের আইনসভা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পদ্ধতিতে নাইট্রোজেন হাইপোক্সিয়া গ্যাস ব্যবহার যুক্ত করেছে গত বছর। লুইজিয়ানার কারাগারগুলোতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ৫৬, যাদের মধ্যে এ বছর চারজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারগুলোতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২০৯২ জন বন্দির মধ্যে শ্বেতাঙ্গ ৮৮৬ জন, অর্থাৎ মোট মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তের ৪২.৩ শতাংশ, কৃষ্ণাঙ্গ ৮৪৩ জন বা মোট সংখ্যার ৪০.৩ শতাংশ, হিসপানিক ৩০৪ জন বা মোট সংখ্যার ১৪.৫ শতাংশ, এশিয়ান ৩৯ জন বা মোট সংখ্যার ১.৮ শতাংশ এবং নেটিভ আমেরিকান ২০ জন বা ০.৯ শতাংশ। তাছাড়া স্টেটওয়ারিভাবে ক্যালিফোর্নিয়ায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি-৬০১ জন; ফ্লোরিডায় ২২৭, টেক্সাসে ১৭৫, আলাবামায় ১৫৮, নর্থ ক্যারোলিনায় ১২১, ওহাইয়োতে ১১৪, অ্যারিজোনায় ১১২ এবং পেনসিলভেনিয়ায় ৯৫ জন। অন্য স্টেটে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।

সহজেই অনুমান করা যায়, ট্রাম্প প্রশাসনের মেয়াদে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার হার বাড়বে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার মেয়াদ শেষ হওয়ার মুহূর্তে ৩৭ জনের মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করায় ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষুব্ধ। ট্রাম্পের এক মুখপাত্র বাইডেনের সিদ্ধান্তকে ‘ঘৃণ্য’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘এসব লোক বিশ্বের জঘন্যতম ঘাতক এবং জো বাইডেনের ঘৃণ্য সিদ্ধান্ত ভুক্তভোগী, তাদের পরিবার ও প্রিয়জনের মুখে চপেটাঘাতের শামিল। আইনের শাসনের পক্ষে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান দৃঢ়, যা তিনি পুনর্বহাল করতে বদ্ধপরিকর। কারণ তিনি আমেরিকান জনগণের ব্যাপক ম্যান্ডেট নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।’

২০১৭ সালে সাউথ ক্যারোলিনায় এক ব্যাংক ডাকাতির সময় নিহত এক মহিলার পুত্র হেদার টার্নার বাইডেনের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘বাইডেন অপরাধের ভুক্তভোগীদের যন্ত্রণার কথা বিবেচনা করেননি। বিগত সাত বছর ধরে আমরা অবর্ণনীয় দুঃখ-বেদনা ভোগ করে আসছি। আমরা সুবিচার পাওয়ার আশায় আদালতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ ঘুরেছি, এখন মনে হচ্ছে, আমরা কেবল সময়ের অপচয় করেছি। আমাদের বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আমাদের সরকার তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। জো বাইডেনের সিদ্ধান্ত ক্ষমতার মারাত্মক অপপ্রয়োগ। তার ও তার সমর্থকদের হাতে রক্ত লেগে আছে।’

বাইডেন প্রশাসন ২০২১ সালে ফেডারেল আইনে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের দণ্ড কার্যকর করা স্থগিত ঘোষণা করেছিল। প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সন্ত্রাস, বিদ্বেষপ্রসূত হত্যা ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা ছাড়া অন্যান্য মৃত্যুদণ্ডের কার্যকারিতা স্থগিত করা হবে। তিনি তার ২০২০-এর নির্বাচনি প্রচারাভিযানেও ফেডারেল পর্যায়ে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করার কথা বলেছিলেন, যাতে ফেডারেল সরকারের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে স্টেটগুলো মৃত্যুদণ্ড না দিতে উৎসাহী হয়। কিন্তু ২০২৪-এর নির্বাচনি অভিযানে তিনি এ প্রতিশ্রুতি থেকে এবং প্রার্থিতা থেকেও নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৩৭ জনের দণ্ড মওকুফ ঘোষণা করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ঘাতকদের ঘৃণা করি, তাদের ঘৃণ্য কাজের শিকারদের জন্য শোক প্রকাশ এবং ভুক্তভোগীদের পরিবার, যারা অবর্ণনীয় যাতনা সহ্য করেছে ও অপূরণীয় ক্ষতির স্বীকার করেছে, তাদের জন্য দুঃখবোধ করি। কিন্তু আমি বিবেক দ্বারা তাড়িত হয়ে এবং একজন আইনজীবী, সিনেট জুডিশিয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান, যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমানে প্রেসিডেন্ট হিসাবে আমার অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে আমি নিশ্চিত যে আমাদের অবশ্যই ফেডারেল পর্যায়ে মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করতে হবে।’

ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে বহু বিষয়ে বিরাজমান দ্বন্দ্ব ও মতানৈক্যের মতো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নিয়েও বিরাট অনতিক্রম্য মতপার্থক্য রয়েছে এবং এ দ্বন্দ্ব সহজে দূর হওয়ার নয়। ডেমোক্রেটরা মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করার পক্ষে, অন্যদিকে রিপাবলিকানরা মাদক বিক্রেতা ও মানব পাচারের মতো ক্ষেত্রেও চীনের মতো কঠোর আইন করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পক্ষে। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ফেডারেল আইনে ১৩ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক ইতিহাসে যে কোনো প্রেসিডেন্টের অধীনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সর্বোচ্চ সংখ্যা।

ফেডারেল মৃত্যুদণ্ড বিলোপের জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চাপের মধ্যে ছিলেন। তারা দাবি করছিলেন, বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ফেডারেল বন্দিদের মৃত্যুদণ্ড বিলোপে এমন কঠিন বিধান করেন, যাতে তা ট্রাম্পের পক্ষে বাতিল করা সম্ভব না হয়। ‘ইউএস কনফারেন্স অফ ক্যাথলিক বিশপস’ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মৃত্যুদণ্ড সম্পূর্ণ বিলোপ করার আহ্বান জানিয়ে আসছে। তারা বাইডেনের দণ্ড মওকুফের সিদ্ধান্তকে মানবিক মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে আমেরিকান জাতির এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া বলে বর্ণনা করেছে, যা তাদের মতে জীবনের সংস্কৃতি গড়ে তোলার কাছাকাছি এক পদক্ষেপ।

যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশে এখনো মৃত্যুদণ্ডের বিধান বহাল রয়েছে, সেসব দেশ থেকে মৃত্যুদণ্ড বিলোপে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অব্যাহত আন্দোলন এবং মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অচিরেই পৃথিবী মৃত্যুদণ্ডমুক্ত হবে বলে আশা করা যায়। কারণ এখনো বহু দেশে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে কেবল ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এ শাস্তি প্রয়োগ করার মাধ্যমে ভীতির সংস্কৃতি চালু রেখে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ ও চিরস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে, যা দূর করা সময়ের দাবি।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম