জাত নিমের পাতা
রাজনৈতিক আন্দোলনের চেয়ে এখন জরুরি সাংস্কৃতিক আন্দোলন

মাহবুব কামাল
প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
স্বাধীন বাংলাদেশে জেলা মাগুরার নাম দুই দুইবার ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’ হয়েছে। প্রথমবার হয়েছিল ১৯৯৪ সালে মাগুরা-২ উপনির্বাচনের সময়। ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল এবং এই কারচুপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল। দ্বিতীয়বার এই সেদিন, জেলাটির নাম উঠে এলো মুখে মুখে। এই জেলারই ৮ বছর বয়সি আছিয়া এখন যৌন নিপীড়নের প্রতীক যেন। এর মানে অবশ্য এই নয় যে, আছিয়ার মতো অথবা তার চেয়ে বেশি নিপীড়িত হয়নি আর কোনো শিশু। গত রেজিমে আমরা ৩ বছরের শিশুকেও ধর্ষণের শিকার হতে দেখেছিলাম। আছিয়া যে প্রতীক হয়ে উঠলো, এর কারণ ঘটনাটা ক্লিক করে গেছে। কখনো কখনো একটি ঘটনায় ক্লিক করার অনেক শর্ত থাকলেও তা ক্লিক করে না, আবার কোনো কোনো ঘটনায় অপেক্ষাকৃত কম শর্ত থাকলেও সেটা ক্লিক করে যায়। শেষেরটির ক্ষেত্রে কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক ফ্যাক্টর যুক্ত হয়। যেমন, রিমি হত্যা কিংবা দিনাজপুরের ইয়াসমিন হত্যার চেয়েও রোমহর্ষক ঘটনার উদাহরণ রয়েছে দেশে; কিন্তু ওই দুটি হত্যার সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক ফ্যাক্টর যুক্ত হওয়ায় তা দেশব্যাপী আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। আছিয়ার ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে। এই শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন দেশব্যাপী চলছে একের পর এক ধর্ষণ অথবা যৌন হয়রানি। সরকারবিরোধীরা আছিয়াকে পিক করেছে সরকারের ব্যর্থতা প্রমাণ করতে।
হ্যাঁ, আমাদের সমাজে যৌন নিপীড়নের ইতিহাস ও তালিকা অনেক দীর্ঘ। এই নিপীড়নের অন্তত ৮০ শতাংশের খবর আমরা জানি না। জানি না, কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিপীড়নের শিকার নারী কিংবা তার পরিবার সামাজিক সম্ভ্রমের কথা চিন্তা করে মামলা করা দূরের কথা, ঘটনাটা বেমালুম চেপে যায়। আবার মামলা করার ইচ্ছা থাকলেও ধর্ষকের ভয়ে অথবা পুলিশি বিব্রতকর জেরা অ্যাভয়েড করতে থানায় যায় না। আমরা সেইসব যৌন নিপীড়নের ঘটনাই জানি, যেগুলো পত্রিকায় প্রকাশ পায়।
কথা হলো, হঠাৎ করেই যৌন নিপীড়নের ঘটনা এত বেড়ে গেল কেন? একশ্রেণির মানুষের দেহে ফিজিওলজিক্যাল এমন কী সমস্যা দেখা দিল যে, তাদের প্রোস্টেট বেড়ে গেল? সবচেয়ে বড় উত্তরটি হলো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিই এর কারণ। অন্যান্য কারণও আছে। তবে সব কারণ ব্যাখ্যা করার আগে প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।
মানুষের ভেতর, তা তিনি বাংলাদেশি অথবা ভিনদেশি কেউ, দুটি সত্তা দ্বান্দ্বিক নিয়মে ক্রিয়াশীল থাকে। একটি হিউম্যানিট অর্থাৎ মনুষ্যত্ব, অন্যটি অ্যানিমিলিটি অর্থাৎ পশুত্ব। মানুষ ভালো থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ অ্যানিমিলিটির ওপর হিউম্যানিটি রাজত্ব করে অর্থাৎ অ্যানিমিলিটির শক্তি চাপা পড়ে যায়। এই সময়টিই দীর্ঘ। কোনো কারণে যদি অ্যানিমিলিটি হিউম্যানিটির ওপর Overrule করতে পারে, তাহলেই লোকটির আচরণ পশুর মতো নির্দিষ্ট হয়ে যায়। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটটি বুঝতে হলে দ্বিতীয় আরেকটি বিষয়ের ফ্রায়েডীয় মনস্তত্ত্ব প্রয়োগ করতে হবে। মানুষের ভেতর দুটি instinct বা প্রবৃত্তি থাকে। একটি life instinct বা বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি, অন্যটি death instinct অর্থাৎ মরে যাওয়ার প্রবৃত্তি। প্রথমটির বশীভূত হয়ে মানুষ আনন্দ-স্ফূর্তি এবং পারস্পরিক সৌহার্দ ও সহযোগিতার মধ্যে বেঁচে থাকতে চায়। আর দ্বিতীয়টির কারণে সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে, ঝুঁকি নেয়, কখনো কখনো মৃত্যুকে পরোয়া না করে ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ে। এ দুই প্রবৃত্তির যেটি প্রি-ডমিনেন্ট থাকে, সেটি দ্বারাই নির্ধারিত হয় একটি বিশেষ সময়ে তার অস্তিত্ব। মানুষ যখন আবৃত্তি করে ‘মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দর ভুবনে’, তখন বুঝতে হবে তার life instinct প্রবলভাবে সক্রিয় আর যখন বলে ‘দেখে নেবো, তাতে যা হওয়ার হবে’, তখন তার death instinct তাকে শাসন করে। ওই যে প্রবাদ, ‘উঠলো বাই, তো কটক যাই’, বর্তমান বাংলাদেশে এখন একশ্রেণির মানুষের মধ্যে কটক যাওয়ার বাই উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। দেশের বৃহত্তর সাধারণ মানুষের মধ্যে এখন life instinct প্রবল আর একটি ক্ষুদ্র অংশ তাড়িত হচ্ছে death instinct দ্বারা। এ দুটি প্রবৃত্তির সংঘাত-সংঘর্ষে life instinct যে শেষ পর্যন্ত জিতবে, তা বলাই বাহুল্য।
হ্যাঁ, বলছিলাম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও এর সঙ্গে একশ্রেণির মানুষের অ্যানিমিলিটি জাগ্রত হওয়ার সম্পর্কের কথা। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার মোটা দাগে দুটি কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, পুলিশের মরাল ভেঙে যাওয়ায় তারা প্রয়োজনমতো সক্রিয় হতে পারছে না। আবার এমনও হতে পারে, এই বাহিনীর অনেক সদস্য অভ্যুত্থানকারীদের হাতে নিহত হওয়ায় শ্রেণি-সহমর্মিতায় তারা বর্তমান সরকারকে চাকরিবিধি অনুযায়ী সহযোগিতা করছে না।
দ্বিতীয়ত, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যেসব স্টেকহোল্ডার ভূমিকা পালন করেছে, বিজয়-পরবর্তী সময়ে তারা তাদের ঐক্য ভেঙে যার যার এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়েছে, ফলে বেড়ে চলেছে সংঘাত-সংঘর্ষ ও অপরাধ। এমন একটা পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে বিশৃঙ্খলা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও তা ব্যর্থ হয়েছে এবং হচ্ছে। এর এক বড় কারণ, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বড় ভূখণ্ডে ১৮ কোটি মানুষের কে কোথায় ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি করছে, আনুপাতিক হারে এত কমসংখ্যক সেনাসদস্যের পক্ষে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। অক্সিলারি বাহিনীর যে নতুন সিদ্ধান্ত, সেটা কতটা কার্যকর হবে, এসব বিষয় নিয়ে আরেকটি কলাম লেখার ইচ্ছা রইল। আজ আমরা ধর্ষণেই সীমাবদ্ধ থাকছি।
ধর্ষণ থেকে মুক্তির উপায় হিসাবে একটা কমন প্রেসক্রিপশন হলো ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। অথচ এ সংকট থেকে উত্তরণে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কার্যকারিতা খুব বেশি নয়। বলা যায় এটি একটি হাতুড়ে চিকিৎসা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিই যদি রেমিডি হতো, তাহলে কুখ্যাত এরশাদ শিকদারের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পরদিনই আরেকটি হত্যাকাণ্ড হতো না। ওই ফাঁসির খবর দেশব্যাপী টেবিলে টেবিলে আলোচিত হয়েছিল। এই দৃষ্টান্ত কোনো কাজে আসেনি এবং এরশাদ শিকদারের নিজ এলাকা খুলনায়ই পরদিন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যে অপরাধপ্রবণদের মনে ভয় তৈরি করে না, তার কারণ অপরাধপ্রবণরা যখন অপরাধ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তারা ধরেই নেয় যে, তারা ধরা পড়বে না। তো যে লোক ভাবে সে ধরা পড়বে না, তার চোখের সামনে হাজারটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দৃষ্টান্ত ঝুলিয়ে রাখলেও যে কোনো কাজ হবে না, তা ব্যাখ্যা করার দরকার পড়ে না। মিথ্যা কথা নয়, এদেশের শিশু ও কিশোরীদের একটা বড় অংশ যৌন নিপীড়নের শিকার হয় নিজ বাড়িতে অথবা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে এসে এবং তার নিকটাত্মীয়রাই এটা করে থাকে। এসব নিকটাত্মীয় ছদ্মবেশের ভদ্রলোক। তারা যদি বুঝতো তার সেই অপকর্মটি জানাজানি হয়ে যাবে, তাহলে তাদের ভদ্রতা রক্ষার তাগিদ থেকেই সেটা তারা করত না। সে নিশ্চিত থাকে যে, সে ধরা পড়বে না, তাই কাজটি করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ তার কাছে কোনো ব্যাপার না।
তাহলে মূল সমাধানটা কী? সেটা হলো, সমাজে এমন একটা আবহ থাকতে হবে যে, অপরাধপ্রবণরা মনে করবে, সে যত কায়দা করেই অপরাধ করুক না কেন, সে ডিটেক্টেড হবেই। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, বিচারের প্রশ্নটি সেকেন্ডারি, প্রাইমারিটা হলো, অপরাধীকে উইদাউট ফেইল ডিটেক্ট করার ব্যবস্থা চালু করা। ডিটেক্ট করা গেলে তার যদি শাস্তি নাও হয়, সমাজে তো তার একটা কলঙ্কময় চেহারা ফুটে উঠবে, সেটাও এক বড় শাস্তি। অপরাধীকে ডিটেক্ট করতে না পারার বিপত্তিটা দেখুন। সাগর-রুনীর হত্যাকারীদের এখনো ডিটেক্ট করা যায়নি। এই ব্যর্থতায় অন্য কোনো অপরাধপ্রবণ যদি আরেক সাংবাদিককে হত্যা করতে প্ররোচিত হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমরা যদি পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষত স্ক্যান্ডিনিভিয়ান কান্ট্রিগুলোর দিকে তাকাই, দেখতে পাব এমন কোনো অপরাধ নেই যে, অপরাধীকে ডিটেক্ট করা যায়নি। এদেশে অধিকাংশ ধর্ষক আনডিটেক্টেড থেকে যায়। আর যারা ডিটেক্টেড হয়, দেশব্যাপী হইচই না পড়লে, তাদের অনেকেরই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সময় লাগে না। শেখ হাসিনার প্রথম টার্মে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র রুবেলকে হত্যা করেছিল তখনকার প্রেসিডেন্ট পদকপ্রাপ্ত এসি আকরামের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল। হত্যাকারীরা যদি ডিটেক্টেড না হতো এবং হত্যাকাণ্ডটি ব্যাপকভাবে আলোচনায় না আসত, এসি আকরামের কিছুই হতো না। আমি তখন লিখেছিলাম, এ হত্যাকাণ্ড ক্লিক করে গেছে। এসি আকরাম যত শক্তিশালীই হোক, শাস্তি তাকে পেতেই হবে। পেয়েওছিল। এমনিভাবে রিমি হত্যা, ইয়াসমিন হত্যাসহ আরও কিছু হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছিল, সেগুলো ক্লিক করেছিল বলেই।
এবার একটি বড় বিতর্কযোগ্য বিষয় টাচ করা যাক। অনেকেই ধর্ষণের দ্রুত বিচার প্রত্যাশা করছেন। আমিও করি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ধর্ষণের বিচার একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং এ বিচার প্রক্রিয়ায় সঠিক রায় দেওয়াটাও কঠিন। প্রথমত, এ মামলায় সাধারণত সাক্ষী থাকে না, কারণ সাক্ষী রেখে কেউ ধর্ষণ করে না, অবশ্য গ্যাং রেপ হলে সেটা ভিন্ন কথা। ধর্ষণের বিচার হয় মূলত ভিকটিমের অভিযোগ ও সারকামসটেন্সিয়াল এভিডেন্সের ভিত্তিতে। তো এ দু’য়ের ওপর নির্ভর করে অভিযুক্তের দোষ প্রমাণ করার বিষয়টি ভুলের কোলে ঢলে পড়তে পারে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। তার আগে বলি, আমরা তো কোনোকিছুই সিরিয়াসলি নিই না, আসলে এ জাতির সিরিয়াসনেস বলতে কিছু নেই। অথচ পশ্চিমা দেশগুলোয় যখনই কোনো গুরুতর প্রশ্ন দেখা দেয়, তখনই সেটা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। তো নব্বই দশকের গোড়ার দিকে আমেরিকার কলোরাডোয় ক্যাথেলিন নামের এক নারী ধর্ষণের শিকার হলেন। বিচারে ধর্ষকের ৮ বছরের কারাদণ্ড হলো। তার কারাবাসের ৪ বছরের মাথায় যাকে ধর্ষণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল, তিনি তার বান্ধবীকে বললেন, আরে ওটা তো ধর্ষণ ছিল না, আমরা মিউচুয়ালি সেক্স করেছি। ওর সঙ্গে একটা পূর্বশত্রুতা ছিল আর তাই তাকে আমি ফাঁসিয়েছি! তার এই কথা এক কান, দু’কান হয়ে ছড়িয়ে গেল গোটা আমেরিকায়। আর যায় কোথায়? লিগ্যাল এক্সপার্ট তো বটেই, সবাই বলাবলি করতে লাগলো, এ কেমন কথা, একজন নির্দোষ ব্যক্তি কারাগারে! লিগ্যাল এক্সপার্টরা বিষয়টা সিরিয়াসলি নিলেন এবং শুরু হলো ধর্ষণ মামলার সুষ্ঠু নিষ্পত্তি কীভাবে করা যায়, তা উদ্ভাবনের চেষ্টা। একজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, এটা ডাক্তারি পরীক্ষাতেই জানা সম্ভব; কিন্তু সেটা উভয়ের সম্মতিতে হয়েছে, নাকি তার ওপর বলপ্রয়োগ করা হয়েছে, তা কীভাবে নির্ণয় করা যাবে? তাহলে উপায় হচ্ছে, ভিক্টিম আদালতে মিথ্যা বলছেন কিনা, সেটাই বুঝতে হবে প্রথম। এটা বুঝতে পারলেই আর কিছুর দরকার পড়বে না। লিগ্যাল এক্সপার্টরা বিষয়টি ফরোয়ার্ড করে দিলেন মনস্তত্ত্ববিদদের কাছে, তারাই বলবেন মিথ্যা কথা কীভাবে বোঝা সম্ভব। মনস্তত্ত্ববিদরা বললেন, মানুষ যখন মিথ্যা বলে, তখন তার শরীর ও কথায় কিছু লক্ষণ স্পষ্ট হয়। মিথ্যা বলার সময় মানুষ কথা বলতে বলতে পজ নেয়, কিছু রেটোরিক, যেমন so to say, I mean, to be very frank ইত্যাদি ব্যবহার করে। চোখে-মুখে একটা ব্যাখ্যাযোগ্য ভাব ফুটে ওঠে।
মনস্তত্ত্ববিদদের এই অবজারভেশন তাদেরই আরেকটি পক্ষ অকার্যকর আখ্যা দিয়ে বললেন, এই লক্ষণগুলো দিয়ে কোনো কথাকে নিশ্চিতভাবে মিথ্যা বলা যাবে না। প্রথমত, এমন মানুষও আছেন, যারা এত স্টেডি অবস্থায় অবলীলায় মিথ্যা বলবে যে, কোনো lie detector-এর পক্ষেও মিথ্যা ধরা সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়ত, যিনি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন, তার ভাবান্তরে সময়ভেদে সত্যটা মিথ্যা হয়ে যেতে পারে, আবার মিথ্যা হতে পারে সত্য। আদালতে দাঁড়িয়ে তিনি যেটাকে সত্য মনে করছেন, ঘটনাকালে অর্থাৎ time of occurrence-এ সেটা তার কাছে ছিল মিথ্যা। একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারীর সম্পর্ক ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আলাদা দার্শনিক ভিত্তি পেতে পারে।
এতসব জটিলতার পরও আমেরিকার লিগ্যাল এক্সপার্টরা থেমে থাকেননি। তারা দ্রুত বিচার এবং সঠিক রায়ের পদ্ধতি বের করেছেন। সেটা আরেক বড় আলোচনা। ওসব বলতে গেলে আসল কথা বলার স্পেস কমে যাবে। আমাদের সমাজেরও ধর্ষণের দ্রুত ও নির্ভুল বিচারের বিষয়টির আরও গভীরে যেতে হবে অবশ্যই। তা না হলে প্রতিশোধপরায়ণতার এ সমাজে অনেক নির্দোষ ফেঁসে যেতে পারেন।
এবার মূল কথা। দেশে নৈতিক অবক্ষয়ের পারদ ক্রমেই উপরে উঠছে। ন্যায়-অন্যায়বোধের ফারাক করতে না পারলে ন্যায়বোধ মসলিন কাপড়ের মতো লুপ্ত হয়ে যাবে একদিন। মানুষ খুব সহজেই বেপরোয়া হয়ে পড়ছে, বাহ্যজ্ঞানলুপ্ত হয়ে উদ্ধত আচরণ করছে। এই যে উত্তেজনা, এর কারণ নির্ণয়ে একটা সর্বব্যাপী গবেষণা হওয়া দরকার বোধকরি। দ্বিতীয় কথা, আমরা তো যে যার মতো রাজনীতি সাজাচ্ছি, লক্ষ্য অর্জনে করছি রাজনৈতিক আন্দোলন, এ আন্দোলনে ক্ষমতায় যাওয়া যাবে হয়তো, জাতির পেছনের দিকে যাত্রা ঠেকানো যাবে না। এবং তাই আমাদের দরকার হয়ে পড়েছে সর্বদিকবিস্তৃত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের। এমন আন্দোলন, যে আন্দোলন আমাদের মনোকাঠামোকে নতুনভাবে গড়ে তুলবে, পুনঃবিন্যস্ত সেই মানসিকতা আমাদের নিয়ে যাবে সত্য-সুন্দরের জগতে। আমরা জানি, ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর চীনে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত মাও-জে-দংয়ের নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিচালনা করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল অবশ্য অন্যরকম। সমাজতন্ত্র সংরক্ষণ এবং পুঁজিবাদের অবশিষ্টাংশ ও পুরোনো ধ্যান-ধারণার মূলোৎপাটনই ছিল এ সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উদ্দেশ্য। আমাদের প্রস্তাবিত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের লক্ষ্য কী, সেটা আগেই বলেছি। সব রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সামাজিক সংগঠন, গোষ্ঠী, সাধারণ মানুষ সবাইকেই এ ধরনের আন্দোলনে যুক্ত হতে হবে। শুধু রাজনৈতিক আন্দোলনে খুব বেশি দূর যাওয়া যাবে না।
আমরা বলে থাকি, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। আসলে এ জাতির মেরুদণ্ড এখন আর শিক্ষা নয়। আমাদের মেরুদণ্ড এখন লজ্জাবোধ। প্রত্যেক নাগরিকের স্বভাবে লজ্জাবোধ ফিরিয়ে আনাও হতে হবে প্রস্তাবিত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম লক্ষ্য।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক