
প্রিন্ট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:৩৯ পিএম

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
কে বলে আমেরিকায় দাসত্বের অবসান হয়েছে! স্বেচ্ছা দাসত্ব এবং বাধ্যতামূলক দাসত্ব এখনো টিকে আছে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ আমেরিকায়। ১৮৬৫ সালে আমেরিকান সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে দাসত্ব বিলোপ করা হলেও তা বিলুপ্ত হয়নি। শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদাররা কৃষ্ণাঙ্গ ও অশ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে এখনো দাস বিবেচনায় আচরণ করে। যখনই কোনো এলাকায় গুরুতর কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তালিকায় থাকা ওই এলাকার অশ্বেতাঙ্গদের অনিবার্য অপরাধী বিবেচনা করে সতর্কতা ছাড়া গুলি করে হত্যা করে, গ্রেফতার করার সময় শ্বাসরোধে মৃত্যুর কারণ ঘটায়। সাম্প্রতিককালে এমন বহু ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করেছে। কোনো বিহিত হয়নি। অপরাধী শ্বেতাঙ্গ হলে সেক্ষেত্রে আচরণ হয় ভিন্ন এবং অভিযুক্তকে জেরা করার পর তাকে মানসিক ভারসাম্যহীন বলে ঘোষণা করে। অশ্বেতাঙ্গ কোনো অভিযুক্তকে অদ্যাবধি ‘মানসিক ভারসাম্যহীন’ ঘোষণার দৃষ্টান্ত নেই। শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানরা তাদের দেশের সীমান্তের মধ্যে দাসত্বের অবসান বিবেচনা করে না। আমেরিকা এখনো স্বেচ্ছা দাস ও বাধ্যতামূলক দাসের দেশ।
অতীতের দৃষ্টান্ত থেকে মানুষ অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে। কিন্তু মানুষ চেতনা বা বোধ হারিয়ে ফেললে কোনোকিছু থেকেই অনুপ্রেরণা গ্রহণ করে না। সেজন্য মানবাধিকারের মহান দেশ খ্যাত আমেরিকায় বর্তমান যুগের দাসেরা বিদ্রোহ করার কথা ভাবে না। প্রভুর হুকুমে তারা অহর্নিশি কাজ করে যায়। তারা আর মানুষ নেই, মেশিন হয়ে গেছে। প্রাচীন রোমের দাসেরাও বিদ্রোহ করেছে অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে। খ্রিষ্টপূর্ব ৭৩৩-৭১১ সালে গ্ল্যাডিয়েটার স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ রোমের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল দাস-বিদ্রোহ হিসাবে রয়ে গেছে। পরপর কয়েকটি বড় ধরনের দাস-বিদ্রোহের পর তৃতীয় বিদ্রোহ ছিল স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে বিদ্রোহ, যেটি ইতিহাসে ‘সার্ভিল যুদ্ধ’ হিসাবে পরিচিত। একথা সত্য, রোম স্পার্টাকাসের বিদ্রোহ দমন করেছিল এবং বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী হাজার হাজার দাসকে হত্যা করে রাস্তার দু’পাশে খুঁটিতে পেরেকবিদ্ধ করে রেখেছিল দীর্ঘদিন পর্যন্ত; তবুও বিদ্রোহের চেতনাকে নিপীড়করা হত্যা করতে পারেনি। স্পার্টাকাসের দাস বিদ্রোহের ঘটনা যুগে যুগে নিপীড়কের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক হিসাবে রয়ে গেছে। স্পার্টাকাসের কাহিনি ইতিহাসবিদ, ঔপন্যাসিক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতারা নানাভাবে তুলে ধরেছেন এবং বিদ্রোহের বাণী বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন; তা সত্ত্বেও আজও অনেক ক্ষেত্রে মানুষের নতজানু মনোবৃত্তির অবসান ঘটেনি।
এমনকি কার্ল মার্কস তার এক চিঠিতে এঙ্গেলসকে লিখেছিলেন, ‘স্পার্টাকাস প্রাচীন বিশ্বের নায়ক না হলেও সর্বশ্রেষ্ঠদের মধ্যে ছিলেন এবং তাকে অনুসরণ করার মতো একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে ছিলেন।’ আমেরিকান ঔপন্যাসিক হাওয়ার্ড ফাস্টের ‘স্পার্টাকাস’ অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র রোমান দাসত্বের অত্যাচারী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকে তুলে ধরেছে। প্রকৃত স্পার্টাকাস সর্বহারা বিপ্লবী বা শাসকের কবল থেকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামরত মানুষের নায়ক ছিলেন না; তিনি এমন এক ব্যক্তি ছিলেন, যিনি দাসত্বের রোমান প্রতিষ্ঠানকে সহ্য না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিদ্রোহ করেছিলেন।
১৬২৮ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত ২৩২ বছরে আনুমানিক ৩ লাখ ৯০ হাজার আফ্রিকান কালো মানুষকে জবরদস্তিমূলকভাবে উত্তর আমেরিকার ইউরোপীয় কলোনিগুলোতে দাস হিসাবে এনেছিল, যারা আর কখনো তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেনি। এ সংখ্যা কেবল দীর্ঘ সমুদ্রপথে জাহাজের খোলে শেকল বাঁধা অবস্থায় পাড়ি দেওয়ার পরও যারা জীবিত ছিল, তাদের। এর বাইরে পথে মারা গিয়েছিল আনুমানিক ৮৪ হাজার আফ্রিকান। দাসপ্রথা বিলুপ্তির পরও আমেরিকান সমাজ কী কারণে এখনো মানসিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়ে আফ্রিকা থেকে ধরে এনে দাসত্বে নিয়োজিতদের আমেরিকান প্রজন্মকে দাস বলেই বিবেচনা করে? এর আসল কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্রে দাসপ্রথা কখনো বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি। এটা বাস্তব, এখন রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলের মধ্যে দাসদের অধস্তন প্রজন্ম বেশ সমর্থন লাভ করে। প্রায় ৮ লাখ আমেরিকান কয়েদি, যাদের অধিকাংশই কৃষ্ণাঙ্গ, তারা মূলত দাস জীবন কাটাচ্ছে। এটি একটি কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান। এর বাইরেও স্থানীয় কারাগার বা ডিটেনশন সেন্টার, কিশোর সংশোধনকেন্দ্র এবং ইমিগ্রেশন ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে আরও বেশিসংখ্যক কয়েদির সঙ্গে দাসসুলভ আচরণ করা হচ্ছে। যে দুটি রাজনৈতিক দল, রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট, পালা করে আমেরিকাকে শাসন করে, তারা এ ধরনের দাসত্বকে সমর্থন করে এবং এ ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে আমেরিকার বর্ণবাদ এবং ‘চ্যাটেল স্লেভারি’র সম্প্রসারণ ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। ‘চ্যাটেল স্লেভারি’ হচ্ছে সেই ধরনের দাসত্ব, যেখানে মানুষকে সম্পত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং পণ্য হিসাবে বেচাকেনা করা যায়। এ ব্যবস্থা আমেরিকান সিভিল ওয়্যারের আগে প্রচলিত ছিল এবং সতেরো, আঠারো ও উনিশ শতকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। বর্তমানে এটিকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে এনে দাসত্বকে পুনঃস্থাপনের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
ডেভিড এস ডি’আমাতো নামে এক আমেরিকান আইনজীবী ও গবেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন দাসত্ব হচ্ছে মানবাধিকার সংরক্ষণের বাগাড়ম্বর এবং প্রত্যেক মানুষের মানবিক মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের ভান বা ছলনা করার এক লজ্জাজনক স্মারক, যা বর্ণ ও জাতিভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস এবং আধিপত্যের সর্বশেষ অধ্যায়। সংবিধান সংশোধন করার মধ্য দিয়ে যখন আমেরিকা থেকে দাসপ্রথাকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিলোপ করা হয়েছিল, তখন বড় ধরনের একটি অস্পষ্টতা রেখে দেওয়া হয়েছিল, যা বর্ণ ও জাতিভিত্তিক দাসপ্রথাকে অদ্যাবধি টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। এখনো যাদের দাস বিবেচনা করা হয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের অপরাধী হিসাবে গণ্য করা হয়, ততক্ষণ দাসত্ব পুরোপুরি আইনানুগ ও অনুমোদিত। এ আইন কারারক্ষীদের নিরাপত্তার স্বার্থে কয়েদিদের ওপর যে কোনো ধরনের নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তাদের দ্বারা বন্দিদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে তা আইনে বিচারযোগ্য নয়। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দাসত্বের বিরুদ্ধে সাধারণ নিয়মের এ ব্যতিক্রম মূলত কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের অস্তিত্বকে অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করার জন্য প্রযোজ্য। আমেরিকান ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম কৃষ্ণাঙ্গ বন্দিদের দ্বারা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নেওয়ার একটি সুযোগ সৃষ্টি করে রেখেছে, যা দাসপ্রথা বিলোপসংক্রান্ত ঘোষণার সম্পূর্ণ পরিপন্থি। বন্দিদের এভাবে দাস বিবেচনা করে তাদের বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য করায় কর্তৃপক্ষ শ্রম খাতে প্রতিবছর বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় সাশ্রয় করছে। তারা দুরভিসন্ধিমূলকভাবে বর্ণবাদী ও দুই স্তরের বিচারব্যবস্থা চালু রেখেছে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের মাঝে সমাজের একটি অংশের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে রাখার জন্য। এ সমস্যাটি যে আমেরিকান সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করেছে, তা অনেকের দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে যায়। কারাগারে এমন একটি ব্যবস্থা চালু রাখা বর্ণ ও জাতিভিত্তিক কলঙ্কিত দাসপ্রথাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
সব তথ্য-প্রমাণে দেখা যায়, কেউ যত দীর্ঘ সময় কারাগারে কাটায়, তারা সমাজে ফিরে আসার পরও আবার অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তত বেশি থাকে। কারণ কারাগারে থাকাকালে একজন সাজাপ্রাপ্তকে সংশোধন করার প্রচেষ্টার পরিবর্তে বিনা পারিশ্রমিকে খাটিয়ে নেওয়ার প্রবণতা থাকে বেশি। কারামেয়াদ শেষে মুক্তজীবনে তার পক্ষে সমাজে যে অবদান রাখা সম্ভব, অনুরূপ কোনো মানসিকতা সৃষ্টির কোনো সুযোগ রাখা হয়নি আমেরিকান কারাব্যবস্থায়। সেজন্য সমাজতাত্ত্বিকরা আমেরিকান ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমকে যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে করেন। আমেরিকায় বিপুলসংখ্যক মানুষ বন্দিজীবন কাটাচ্ছে। বন্দিদের সাজার মেয়াদ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কারাগারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও বেড়ে চলেছে। বলা হয়ে থাকে, আমেরিকার কারাগারগুলোয় মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনের ঘটনা বিশ্বব্যাপী আমেরিকার জন্য লজ্জার ব্যাপার। কর্তৃপক্ষ বা সরকার এ লজ্জার কোনো পরোয়া করে না।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান ও সূত্র অনুসারে আমেরিকার বিভিন্ন পর্যায়ের কারাগার এবং আটক কেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন মেয়াদে বছরে প্রায় ২০ লাখ মানুষ কাটায়। তাদের মধ্যে গুরুতর অপরাধে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত থেকে শুরু করে তুচ্ছ অপরাধে একদিন কারাগারে কাটানো ব্যক্তিও অন্তর্ভুক্ত। তবে কারাগারে দণ্ডপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন বন্দির বার্ষিক গড় সংখ্যা কম-বেশি ১২ লাখ, যারা নির্যাতন ও অবহেলার কঠোর পরিস্থিতিতে বাস করে এবং একটি অংশ, বিশেষ করে দণ্ডপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ বন্দিদের বিনা পারিশ্রমিকে কঠোর শ্রমে নিয়োগ করা হয়। কারাবন্দিদের সংখ্যা সম্পর্কিত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে আমেরিকার কারাগারগুলোতে বন্দি ছিল প্রতি ১ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে ৯৩ জন, যা ২০০৯ সালে সাতগুণ বেশি হয়ে যায়। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এক দশকে কারাগারগুলো বন্দিসংখ্যা বার্ষিক গড়ে ৮ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বলা বাহুল্য, কারাগারে যারা বন্দি অবস্থায় কাটায়, তাদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের সংখ্যাই সবসময় বেশি থাকে। ২০২৪ সালে আমেরিকার কারাগার সংস্কার উদ্যোগের অংশ হিসাবে যখন বন্দিদের বর্ণগত সংখ্যা গণনা করা হয়, তখন দেখা যায়, কারাবন্দি কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের সংখ্যা শ্বেতাঙ্গ কারাবন্দির সংখ্যার চেয়ে ৬০০ শতাংশ বেশি। এমন অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, কৃষ্ণাঙ্গরা একবার দণ্ডিত হয়ে কারাগারে প্রবেশ করলে তাদের অবস্থা করুণ হয়ে ওঠে। তারা অসুস্থ হলে সুচিকিৎসা লাভ করে না, ভালো খাবার পায় না। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে ‘নির্যাতন’ হিসাবে বিবেচিত শর্তগুলোর প্রতিটি লঙ্ঘিত হয় কৃষ্ণাঙ্গদের ক্ষেত্রে।
আমেরিকায় যখন দাসপ্রথা বহাল ছিল, তখন দাসরা ছিল ভিন্ন ভিন্ন মালিকের অধীনস্থ। দাসরা অপরাধ করলে শাস্তি বিধান করত দাস মালিকরা। আদালতে যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত না। অভিযুক্তের অর্থাৎ কৃষ্ণাঙ্গ দাসের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ ছিল না। দাসপ্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর আমেরিকার কোথাও যদি কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় এবং ঘটনাস্থলের আশপাশে যদি কিছু কৃষ্ণাঙ্গ বসবাস করে, তাহলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো তদন্ত ছাড়াই কৃষ্ণাঙ্গদের অভিযুক্ত করা যুক্তরাষ্ট্রে একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। পুলিশ, আদালত এবং কারাব্যবস্থা প্রাথমিক মাধ্যম হয়ে উঠেছে, যার মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা তাদের স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে এবং সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তারা দ্বিতীয়, এমনকি তৃতীয় শ্রেণির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রান্তিক অবস্থানে চলে গেছে। গত বছর (২০২৪) ক্যালিফোর্নিয়ায় অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটাররা ব্যালটের একটি সংস্কার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে, যে প্রস্তাবে স্টেটের সংবিধানে এমন একটি বিধানকে বিলোপ করার কথা ছিল, যা কারাগারে আটক বন্দিদের শাস্তি হিসাবে স্বেচ্ছা দাসত্ববরণকে অনুমোদন করবে; অর্থাৎ বন্দিরা বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে বাধ্য হবে। এ প্রস্তাবে আরও বিধান করতে চাওয়া হয়েছিল যে, ক্যালিফোর্নিয়ার কারাগারগুলোতে আটক ব্যক্তিদের মধ্যে যারা কাজ করতে অস্বীকার করবে, তাদের কারাবিধি অনুযায়ী শাস্তির আওতায় আনা হবে। ভোটাররা এটাও বাতিল করেছে। কিন্তু এ ধরনের একটি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট চাওয়ার অর্থ হচ্ছে, মানবাধিকার সংরক্ষণের পক্ষে কট্টর অবস্থান গ্রহণকারী নমনীয় দল হিসাবে পরিচিত ডেমোক্র্যাট নিয়ন্ত্রিত স্টেটও দাসপ্রথা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে এখনো উৎসাহী।
তবে হ্যাঁ, আমেরিকার কারাগারে যেসব বন্দিকে শ্রমে নিয়োগ করা হয়, তাদের কিছু মজুরি দেওয়া হয়। এ মজুরির পরিমাণ রীতিমতো হাস্যকর। আমেরিকার অন্যতম কৃষিপ্রধান রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ায় একজন কৃষিশ্রমিকের ন্যূনতম গড় মজুরি যেখানে প্রতি ঘণ্টায় ১৬.৫০ ডলার, সেখানে একজন কারাবন্দিকে যখন কাজে নিয়োগ করা হয়, কাজের ধরন বিবেচনায় তার মজুরি ধার্য করা হয় প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১৩ থেকে ৫২ সেন্টের মধ্যে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ কারাগারে বন্দিদের কাজে নিয়োগ করা হলে তাদের কোনো মজুরিই দেওয়া হয় না। অথচ তাদের নিয়োগ করা হয় সবচেয়ে বিপজ্জনক ও অপ্রীতিকর কাজে।
আমেরিকান কারাগারগুলোতে বন্দিরা এত নাজুক অবস্থায় থাকে যে, কারা কর্তৃপক্ষ তাদের চরম শোষণের পথ বেছে নেয়। তাদের যে কাজেই নিয়োগ করা হোক না কেন, কোনো অধিকার থাকে না কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানোর। প্রতিবছর তারা যেসব পণ্য উৎপাদনে শ্রম দেয় এবং যেসব সার্ভিস সেক্টরে কাজ করে, তার সম্মিলিত বার্ষিক অর্থমূল্য ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। যারা এ দাসত্বের শর্তে কাজ করতে অস্বীকার করে, তাদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয়। জাতিসংঘ মানবাধিকার আইনে ১৫ দিনের বেশি সময় ধরে কোনো বন্দিকে কারাপ্রকোষ্ঠে একা কাটাতে বাধ্য করা হলে তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু আমেরিকান কারাগারে প্রতি চারজন বন্দির মধ্যে তিনজনই অভিযোগ করেছেন, তাদের একা কারাপ্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছে, তাদের সাজা হ্রাস করার সুযোগ অস্বীকার করা হয়েছে এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ কমানো হয়েছে, এমনকি গোসল করতে সাবানের মতো প্রয়োজনীয় সামগ্রীও সরবরাহ করা হয় না। বিভিন্ন আইনি সংগঠন ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত প্রতিটি জরিপে উঠে এসেছে, অধিকাংশ কারাবন্দি দাসত্বে নিয়োজিত।
বিশ্বের দেশে দেশে মানবাধিকার রক্ষায় এগিয়ে যাওয়া আমেরিকায় মানবাধিকারের গলাটিপে হত্যা করার ঘটনা খুব কম মানুষই জানেন।
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক