Logo
Logo
×

বাতায়ন

কাগমারী সম্মেলন : ঐতিহাসিক ‘আসসালামু আলাইকুম’

Icon

এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া

প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কাগমারী সম্মেলন : ঐতিহাসিক ‘আসসালামু আলাইকুম’

ছবি: সংগৃহীত

উপমহাদেশের ব্রিটিশবিরোধী আজাদী আন্দোলনের মহান নেতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মসূচির আয়োজন করেছিলেন। এর মধ্যে তার অবিস্মরণীয় কীর্তি ১৯৫৭ সালের ‘কাগমারী সম্মেলন’। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় রূপমহল সিনেমা হলে। এ অধিবেশনে বলা হয়- ‘...পাকিস্তান সরকার গত কয়েক বছর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি, সিয়াটো চুক্তি প্রভৃতি এমন সব চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছে, যেসব চুক্তির দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসাগত ও বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়েছে।’

১৯৫৬ সালের ১৯-২০ মে ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনেও যুদ্ধজোটের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, ‘কোনো বৈদেশিক শক্তির লেজুড়’ হিসাবে না থেকে পাকিস্তান সরকারের উচিত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করা। এ ধরনের প্রস্তাব আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ নেতার বিতৃষ্ণার কারণ হয় এবং মওলানা ভাসানী হন তাদের বিরাগভাজন।

দুটি প্রধান বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর মতপার্থক্য শেষ পর্যন্ত মীমাংসার অযোগ্য বিরোধে পর্যবসিত হয়, যার একটি হলো অবহেলিত-শোষিত পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আর অপরটি হলো সব সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ। এ দুটি বিষয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন নমনীয়। পক্ষান্তরে মওলানা ভাসানী ছিলেন আপসহীন। অবশ্য এ দুটি কোনো ব্যক্তিগত বিষয় ছিল না। এগুলো ছিল আওয়ামী লীগেরই নীতি।

দলের দুই প্রধান নেতার মধ্যে যখন মতবিরোধ চরমে, তখনই মওলানা ভাসানী দলীয়প্রধান হিসাবে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বান করেন। মওলানা ভাসানী যখন কাগমারী সম্মেলনের আয়োজন করেন, তখন তারই প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ও পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তদুপরি ওই সময়ে বৈদেশিক নীতি, বিশেষ করে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সম্পাদনসহ ‘দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সামরিক চুক্তি’ ও ‘বাগদাদ চুক্তি’ সংস্থার সদস্যভুক্তির প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতদ্বৈধতা চরম আকার ধারণ করে বলে কাগমারী সম্মেলনটি ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

প্রকৃতপক্ষে বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে মতবিরোধ নিয়ে সৃষ্ট অনিশ্চিত রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে কাগমারী সম্মেলনের ঘোষণা পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। কাগমারী সাংস্কৃতিক সম্মেলন পূর্ব বাংলা তথা আজকের বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক সম্মেলনে রূপ নেয়। এ সম্মেলনকে ঘিরে যেমন পাকিস্তানি ‘দর্শন’র সমর্থকরা বিরূপ সমালোচনায় মুখর হয়, তেমনই আওয়ামী লীগের মুখপাত্র বলে পরিচিত এবং প্রকৃত প্রস্তাবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক পত্রপত্রিকাগুলোও কাগমারী সম্মেলনকে সুনজরে না দেখে বরং ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বিরূপ সমালোচনা করে।

কাগমারী সম্মেলন হওয়ার স্বল্পসময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রিত্বের পদ থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অপসারণ এবং সবশেষ ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল ও সামরিক শাসন জারির মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এসব কারণেই স্বাধীন জাতিরূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক ভিত্তিভূমি নির্মাণে কাগমারী সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ।

কাগমারী সম্মেলন উপলক্ষ্যে ১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারি পূর্ব বাংলার গরিব চাষি, মজুর, ছাত্র, যুবক ও জনসাধারণের প্রতি এক আবেদনে মওলানা ভাসানী বলেন : ‘এ দেশ শুধু মন্ত্রী, মেম্বার, সরকারি কর্মচারীদের নহে, এ দেশ অগণিত জনসাধারণের দেশ। যারা এ দেশ পরিচালিত করেন, তারা শতকরা ৯৫ জন গরিব চাষি, মজুর, কামার, কুমার প্রভৃতি শ্রেণির জনসাধারণের টাকা দিয়েই চলে। ...পূর্ব বাংলার বাঁচার দাবি পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের দাবি এবং ২১ দফার বাকি ১৪ দফা দাবি পূরণের জন্য বিচ্ছিন্ন জনশক্তিকে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। দেশের নানাবিধ সমস্যার সমাধানের উপায় উদ্ভাবন এবং আন্দোলনকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য আমি আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সপ্তাহব্যাপী সন্তোষের কাগমারীতে এক বিরাট সম্মেলন আহ্বান করেছি। দল-মত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে উক্ত সম্মেলনে যোগদান করে জনগণের দাবি আদায়ের আন্দোলন জোরদার করুন।’

৩ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী ‘কাগমারীর ডাক’ শীর্ষক আরেকটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। তাতে বলা হয়-সাড়ে চার কোটি বাঙালির বাঁচার দাবি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ডাক; ঐতিহাসিক ২১ দফা আদায়ের ডাক; চাষি-মজুর, কামার-কুমার, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী সব শ্রেণির মিলনের ডাক; পূর্ব বাংলার ৬০ হাজার গ্রামে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার ডাক; ২১ দফার পূর্ণ রূপায়ণের জন্য আমাদের নিরবচ্ছিন্ন আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। তা সারা পাকিস্তানের সামাজিক ও আর্থিক পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তির মহান সনদ, যেন আমরা কখনো বিস্মৃত না হই। মওলানা ভাসানীর দল যখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে এবং আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তখন এ বক্তব্য দিয়ে একটি মহাসম্মেলনের আয়োজন করাটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কাগমারী সম্মেলনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খানসহ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্যই যোগ দেন। কাগমারী সম্মেলন সফল করতে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে যে প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়, এর বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য সদস্যরা হলেন-ইয়ার মোহাম্মদ খান, কাজী মো. ইদরীস, ফকির সাহবুদ্দিন আহমেদ, খায়রুল কবির, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, সদর ইস্পাহানী, আবু জাফর শামসুদ্দিন।

সম্মেলনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এ সম্মেলন উপলক্ষ্যে টাঙ্গাইল শহর থেকে সন্তোষের কাগমারী পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তায় তোরণ নির্মিত হয়। সেই তোরণগুলোর নামকরণ করা হয় বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) থেকে শুরু করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং ব্রিটিশবিরোধী উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী নেতাদের নামে। উল্লেখযোগ্য তোরণগুলোর নাম হলো-হজরত মোহাম্মদ (সা.) তোরণ, মহাত্মা গান্ধী তোরণ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী তোরণ, কাজী নজরুল ইসলাম তোরণ, মহাকবি ইকবাল তোরণ, নেতাজী সুভাস বোস তোরণ, হাজী শরিয়তউল্লাহ তোরণ, শহিদ তিতুমীর তোরণ, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু তোরণ, হাজী মোহাম্মদ মহসীন তোরণ, সি আর দাস তোরণ, লেনিন তোরণ, স্ট্যালিন তোরণ, মাও সেতুং তোরণ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ তোরণ, বায়রন তোরণ, শেলী তোরণ, মাওলানা রুমী তোরণ, হজরত ইমাম আবু হানিফা তোরণ, হজরত ইমাম গাজ্জালী তোরণ। এভাবে ৫১টি তোরণের নামকরণ করেন মওলানা ভাসানী। সর্বশেষ তোরণটি ছিল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর নামে।

এ সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য মওলানা ভাসানী আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রনায়ককে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু, মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের, চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ সুকর্নো, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় ও ব্রিটেনের বিরোধী দলের নেতা। জওহরলাল নেহেরু, বিধান চন্দ্র রায় ও জামাল আবদুল নাসের চিঠি দিয়ে সম্মেলনের সাফল্য কামনা করেন। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী তার ভাষণের একপর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশে তার সুপরিচিত ও সুবিখ্যাত ‘আসসালামু আলাইকুম’ উচ্চারণ করেন। এই ‘আসসালামু আলাইকুম’র তাৎপর্য বিশাল। উপস্থিত শ্রোতাদের মতে, ‘এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রথম স্পষ্ট দাবি এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় সংগ্রাম ও ত্যাগের সংকল্প এই ধ্বনির মাধ্যমে ঘোষিত হয়েছিল।’ সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্যে মওলানা ভাসানী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দুই ধরনের বক্তব্যই রাখেন। উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপরও দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন তিনি।

পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন এই বলে যে, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন না দিলেও সামরিক-বেসামরিক চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পায়ন, কৃষি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংখ্যাসাম্য নীতি পালিত না হলে পূর্ব পাকিস্তান ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলবে। ৮ ফেব্রুয়ারি মূল অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন ড. কাজী মোতাহের হোসেন।

কাগমারী সম্মেলন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক-বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাসে এক স্মরণীয় ঘটনা। সম্মেলনের সময় মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল-কাগমারী সড়কের নাম দিয়েছিলেন বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতা সড়ক। এ নামকরণ যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কাগমারী সম্মেলনে অধিবেশনের আলোচনা ও প্রস্তাবগুলো সর্বসম্মত না হলেও সাংস্কৃতিক সম্মেলনটি সুচারুরূপে সমাপ্ত হয়। এ সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানী ও তার সমর্থিত নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে।

প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান এবং তাদের সহকর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে নীতির প্রশ্নে আপসের কোনো সুযোগ ছিল না। তারা বলেছিলেন, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন হয়েই গেছে এবং মার্কিনপন্থি জোটভুক্ত পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট বাতিলেও প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনীহা ছিল। এসব প্রশ্নে মওলানা ভাসানী ছিলেন অবিচল ও আপসহীন। তিনি তার মনস্থির করে ফেলেছিলেন, তবে দল ত্যাগের ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। যে দলটির তিনি শুধু প্রতিষ্ঠাই নন-আপ্রাণ চেষ্টায় দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন, যে দলটির পতাকার নিচে সমবেত করেন দেশের সব এলাকার, সব সম্প্রদায়ের মানুষকে, যে দলটি কেন্দ্রে ও প্রদেশে ক্ষমতাসীন, যে দলের প্রধান তিনি, সেই দল পরিত্যাগ করার মুহূর্তে তিনি মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু আদর্শ ও নীতির সঙ্গে আপস করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর কঠোর ভাষণ এবং তার ‘আসসালামু আলাইকুম’ যে বিতর্কের সূচনা করে, তাতে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যিনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাও বটে, বিব্রত হন। পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে তিনি মওলানা ভাসানীর সমর্থনে একটি নমনীয় বিবৃতিও প্রদান করেন, যা ’৫৭-র ১৬ ফেব্রুয়ারি দেশের সব পত্রপত্রিকার প্রকাশিত হয়। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলেন; পক্ষান্তরে সম্মেলন থেকে ঢাকায় ফিরে সলিমুল্লাহ হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়ে গেছে। এ নিয়ে দুই দল ছাত্রের মধ্যে প্রচণ্ড মারামারিও হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় বামপন্থিদের সঙ্গে একটি বোঝাপড়ার চেষ্টা চালান, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়।

১৯৫৫ সালের মে অধিবেশনের প্রস্তাবাবলী পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন, পাকিস্তানের জোটনিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি, বাগদাদ চুক্তি বাতিলের দাবি ইত্যাদি নিয়ে সে সভায় দীর্ঘ আলোচনা চলে। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তার সমর্থকদের মার্কিনঘেঁষা ও পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে সহযোগিতার নীতির বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী ও তার অনুগতরা অবিচল থাকেন। উভয় পক্ষই তাদের এ অনমনীয় মনোভাবের পরিণতি কী তা-ও জানত। আদর্শগত অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে।

সম্মেলনের পর ২৬ মার্চ ১৯৫৭ মওলানা ভাসানী একটি প্রচারপত্র বিলি করেন, যার শিরোনাম ছিল ‘আওয়ামী লীগ কর্মী ও দেশবাসীর প্রতি আবেদন’। এতে বলা হয়, ‘ভাইসব, উভয় পাকিস্তানের সংহতি ও মিলন নির্ভর করে একমাত্র আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দানের ওপর। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ব্যতীত সাড়ে চার কোটি বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সমাজজীবনে মুক্তি অসম্ভব। ...গদির মোহে মুসলিম লীগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সাড়ে চার কোটি বাঙালিকে চিরকালের জন্য কৃতদাস বানাইতে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র পাশ করেছিল, তারাই আবারও সাম্রাজ্যবাদী ও কোটিপতি শোষকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বর্তমানে আমার এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে বিবৃতি, পোস্টার, বিজ্ঞাপন ছড়াইয়া সারা দেশে মিথ্যা প্রচার শুরু করেছে। এসব কুচক্রীকে দেশবাসী ভালো করেই চিনে। তারা গত ৯ বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তান তথা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামোকে চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।’

কাগমারী সম্মেলনের পরই মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং একপর্যায়ে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন এবং আওয়ামী লীগের ভ্রান্তনীতির বিরুদ্ধে জনমত প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তানের মেহনতি জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যেই ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে নিখিল পাকিস্তান গণতান্ত্রিক কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)।

ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়। সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও সচেতন করতে এ সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী যে গুরুত্বপূর্ণ ও জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন, তা আজও আমাদের দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, পতাকা-মানচিত্র রক্ষার সংগ্রাম এবং সব আধিপত্যবাদবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও লড়াইয়ে এখনো অনুপ্রেরণা জোগায়।

এম গোলাম মোস্তফা ভুইয়া : মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি

gmbhuiyan@gmail.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম